এফওসি সীমা বাড়ানোর উদ্যোগ
ধস নামবে টেক্সটাইল অ্যাকসেসরিজ শিল্পে
আলোচনা ছাড়া এ ধরনের উদ্যোগ দেশের শিল্প খাতকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করবে -শওকত আজিজ রাসেল * পরোক্ষভাবে তৈরি পোশাকশিল্পেও এর প্রভাব পড়বে -মো. শাহরিয়ার
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ঋণের উচ্চ সুদ, জ্বালানি স্বল্পতা ও সীমান্ত পথে অবাধে ভারতীয় সুতা প্রবেশের কারণে টেক্সটাইল ও অ্যাকসেসরিজ শিল্প খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। উপরন্তু তৈরি পোশাকশিল্পের ফ্রি অব কস্টের (বিনামূল্যে কাপড় ও অ্যাকসেসরিজ আমদানির সুযোগ) সীমা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার, যা এই দুই শিল্পকে আরও বিপদের মুখে ফেলবে। খাতসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া এ ধরনের সিদ্ধান্ত শিল্পের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকবে। যুগান্তরের কাছে এমন আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করেন ভুক্তভোগী মহল।
আমদানিনীতি আদেশ ও কাস্টমসের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী বর্তমানে রপ্তানিকারকরা এফওসির মাধ্যমে আগের বছরের মোট রপ্তানিকৃত অর্থের ৫০ শতাংশের সমপরিমাণ অর্থের কাঁচামাল শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করতে পারেন। সাধারণত বন্ড লাইসেন্সধারী রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান এ সুবিধা পেয়ে থাকে।
আমদানিনীতি আদেশ সংশোধনের মাধ্যমে এফওসির সীমা তুলে নেওয়া হচ্ছে-এমন খবরে টেক্সটাইল ও অ্যাকসেসরিজ শিল্প মালিকরা হতবাক হয়েছেন। আলাপ-আলোচনা ছাড়াই এ ধরনের সিদ্ধান্ত শিল্প খাতের জন্য আত্মঘাতী হবে বলে মনে করছেন টেক্সটাইল মিলমালিকরা। তাদের দাবি, এফওসির সীমা তুলে দিলে প্রথম বছরেই অতিরিক্ত ৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় হবে, দ্বিতীয় বছরে তা ১০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে-গার্মেন্ট ও অন্য রপ্তানিমুখী শিল্পমালিকদের এ ধরনের তথ্য একেবারেই ভিত্তিহীন। প্রকৃতপক্ষে এফওসির মাধ্যমে কাঁচামাল আমদানি করলে পোশাকশিল্প কেবল সেলাইয়ের (কাটিং অ্যান্ড মেকিং) মূল্য পাবে। যার পরিমাণ সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ হতে পারে। এতে সরকার কোনো ধরনের রাজস্ব পাবে না। আপাতদৃষ্টিতে এই সিদ্ধান্ত ইতিবাচক মনে হলেও বাস্তবে তা সঠিক নয়। উলটো দেশের পশ্চাৎপদ এই শিল্পকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবে।
স্পিনিং, উইভিং ও ডাইং-প্রিন্টিং-ফিনিশিং মিলসহ দেশে বিটিএমএ’র সদস্যভুক্ত প্রাইমারি টেক্সটাইল রয়েছে এক হাজার ৮৬৯টি। এ খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার, যা বেসরকারি খাতে একক বিনিয়োগ হিসাবে সর্বাধিক। রপ্তানি আয়ে তৈরি পোশাকশিল্পের অবদান ৮৫ শতাংশ হলেও এর পেছনে বড় ভূমিকা রয়েছে টেক্সটাইল খাতের। গার্মেন্ট শিল্পের পশ্চাৎপদ শিল্প হিসাবে টেক্সটাইল এবং অ্যাপারেল খাত প্রায় ৭০ শতাংশের জোগানদাতা। এ খাতের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার রিটেনশন প্রায় ৩০ শতাংশ।
এদিকে গত ২৯ নভেম্বর এফওসি সীমা সংশোধনে আপত্তি জানিয়ে বাণিজ্য সচিবকে চিঠি দেয় বাংলাদেশ টেক্সটাইলস মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)। এতে বলা হয়, এমন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সরকারের সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত। এমনিতে মিলগুলো দীর্ঘদিন থেকে সুদের হার বৃদ্ধি, জ্বালানি স্বল্পতা ও টাকার অবমূল্যায়নসহ নানা কারণে উৎপাদন সক্ষমতার অনেকাংশ ব্যবহার করতে পারছে না। উপরন্তু এফওসির সীমা তুলে অতিরিক্ত কাঁচামাল আমদানির সুযোগ দেওয়া হলে দেশীয় টেক্সটাইল শিল্পের জন্য মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কারণ এতে স্থানীয় সুতা, কাপড় ও অ্যাকসেসরিজের চাহিদা কমবে এবং স্থানীয় মূল্য সংযোজনও কমবে। ফলে ২৩ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়বে এবং এর প্রভাবে ব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। চিঠিতে আরও বলা হয়, দেশের জ্বালানি ও সম্পদ ব্যবহার করে আমাদের পরিশ্রমে রপ্তানি হবে, অথচ আমাদের দেশ লাভবান হবে না, এটা দুঃখজনক।
এ বিষয়ে বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল যুগান্তরকে বলেন, সাধারণত নির্বাচনের আগে এমনিতে পোশাকশিল্পের অর্ডার কমে যায়। এছাড়া গ্যাসের স্বল্পতার কারণে দিনের বড় অংশ শ্রমিকরা কাজ করতে পারছে না, তাদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিতে হয়। অর্ডারের অভাব ও জ্বালানি স্বল্পতার কারণে মিলগুলো সক্ষমতার ৫০ শতাংশও উৎপাদন করতে পারছে না। এ অবস্থায় এফওসি সীমা বাড়ানো হলে টেক্সটাইল শিল্পের সংকট আরও ঘনীভূত হবে। এ ধরনের একটি পদক্ষেপ গ্রহণের আগে সরকারকে অবশ্যই খাতসংশ্লিষ্ট সব অংশীজনকে নিয়ে বৈঠক করা উচিত ছিল।
বিটিএমএ পরিচালক রাজিব হায়দার বলেন, একতরফাভাবে ও তাড়াহুড়া করে এফওসি সীমা বাড়ানো হচ্ছে। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যে ধরনের গবেষণা করা দরকার ছিল, তা করা হয়নি। তিনি আরও বলেন, স্থানীয় শিল্প কাঁচামাল জোগান দিতে না পারলে শতভাগ এফওসি সুবিধা দেওয়া যেত, তাতে কারও আপত্তি থাকত না। কিন্তু যেসব কাঁচামাল স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয়, সেগুলোর জন্য এ ধরনের সুবিধা দেওয়া যৌক্তিক নয়। এ ধরনের সুবিধা দেওয়া হলেও ভবিষ্যতে আর এ ধরনের পশ্চাৎপদ সহায়ক শিল্প গড়ে উঠবে না। যেগুলো আছে সেগুলোও বন্ধ হয়ে যাবে।
রাজিব হায়দার বলেন, এ প্রক্রিয়ার শুরুটা হয়েছিল ১৫ শতাংশ এফওসি দিয়ে। ধাপে ধাপে সেটি ৫০ শতাংশে উন্নীত করা হয়। কিন্তু এতে কি গার্মেন্ট শিল্পে মূল্য সংযোজন বেড়েছে? বাড়েনি। উলটো গার্মেন্ট সেলাইশিল্পে পরিণত হয়েছে। শতভাগ এফওসি সুবিধা দিলে এখন যেমন বাজার ভারতীয় সুতায় সয়লাব, তখন বিদেশি ফ্যাব্রিকের চাপে দেশের কাপড় ও ডেনিম মিলগুলোও বন্ধ হয়ে যাবে। তাছাড়া ট্রাম্প ট্যারিফ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের জিএসপি প্লাসের অন্যতম একটি শর্ত হচ্ছে, স্থানীয় পর্যায়ে মূল্য সংযোজন বাড়ানো। এখন প্রশ্ন হলো-সরকারের গৃহীত এফওসি নীতি কি সেই শর্তকে সমর্থন করে।
একই উদ্বেগ জানিয়ে বুধবার বাণিজ্য সচিবকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ গার্মেন্ট অ্যালসেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএপিএমইএ)। এতে বলা হয়, আমদানিনীতি আদেশ সংশোধন করে এফওসি সীমা তুলে অতিরিক্ত কাঁচামাল আমদানির সুযোগ দেওয়া হলে বন্ড লাইসেন্সধারী গার্মেন্ট অ্যাকসেসরিজ ও প্যাকেজিং খাতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এ বিষয়ে সংগঠনের সভাপতি মো. শাহরিয়ার বলেন, এফওসির প্রভাব শুধু অ্যাকসেসরিজ শিল্পে নয়, পরোক্ষভাবে তৈরি পোশাকশিল্পেও পড়বে। ফলে দেশের বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়বে এবং অর্থনীতি আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের সঙ্গে সরকারের পরামর্শ করা সমীচীন।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, শতভাগ রপ্তানিমুখী গার্মেন্ট ও অন্য রপ্তানিমুখী শিল্পের অ্যাকসেসরিজ ও প্যাকেজিং তৈরি করে থাকে বিজিএপিএমইএ’র সদস্যভুক্ত ২ হাজার ১০০টি প্রতিষ্ঠান। এ শিল্প সেক্টর কার্টন, পলি, লেবেল, সুইং থ্রেড, জিপার, বাটন, হ্যাঙ্গার, ইলাস্টিক, গাম টেপ, হ্যাং ট্যাগ, আইস ট্যাগ, ফটোকার্ড, ন্যারো ফ্যাব্রিক্স ও আরএফআইডি ট্যাগসহ ৫০-৬০ প্রকার অ্যাকসেসরিজ ও প্যাকেজিং পণ্য উৎপাদন করে রপ্তানি খাতের শিল্পপ্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করে। প্রচ্ছন্ন রপ্তানিকারক হিসাবে এ খাতের মোট রপ্তানি আয় প্রায় সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার। তৈরি পোশাকশিল্পের অ্যাকসেসরিজ ও প্যাকেজিং পণ্যের সংযোজনের হিস্যা ১৭-১৯ শতাংশ। এ খাতে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। যাতে ৭ লাখ শ্রমিক কাজ করছে।
এফওসির অপব্যবহার হরহামেশাই : এফওসির মাধ্যমে শুল্কমুক্ত সুবিধা আনা কাপড় ও অ্যাকসেসরিজ খোলাবাজারে বিক্রি হয়ে থাকে। এনবিআরের শুল্ক গোয়েন্দা এ ধরনের একাধিক ঘটনা উদঘাটন করেছে। এরপরও গার্মেন্ট মালিকদের চাপে গত অর্থবছরের এফওসির পরিমাণ বাড়ানো হয়। ২০১৯ সালে এফওসি সুবিধা অপব্যবহারের মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকির দায়ে ৯ প্রতিষ্ঠানের ২৪ জনের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করে এনবিআর। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো-মিশওয়্যার হোসিয়ারি, আসিয়ানা গার্মেন্টস, অ্যাপারেল অপশনস, ফ্যাশন ক্রিয়েট লিমিটেড, ডি কে অ্যাপারেলস লিমিটেড, ক্যাপরী অ্যাপারেলস, সাদ ফ্যাশন ওয়্যার, লিলাক ফ্যাশনওয়্যার ও নাব ফ্যাশন। প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে শুল্ক গোয়েন্দা এফওসির (ফ্রি অব কস্ট) ক্ষেত্রে প্রাপ্যতার চেয়ে অতিরিক্ত পরিমাণ পণ্য আমদানি ও জাল বা ভুয়া এফওসি দলিলের মাধ্যমে পণ্য আমদানি দেখিয়ে ২৩ লাখ ৪৯ হাজার ডলারের সমপরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচারের প্রমাণ পায়।
