Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

গাজায় নতুন গণকবর

ত্রাণ আনতে গেলে গুলি বুলডোজারে বালিচাপা

সিএনএনের অনুসন্ধান

Icon

যুগান্তর ডেস্ক

প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ত্রাণ আনতে গেলে গুলি বুলডোজারে বালিচাপা

দক্ষিণ গাজার নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্সসংলগ্ন গণকবর থেকে উদ্ধারের পর লাশ সারি করে রাখা হয়েছে। তাদের পরিচয় শনাক্তের জন্য বৃহস্পতিবার জড়ো হয়েছেন কয়েকজন -এএফপি

গাজার বাসিন্দা আম্মার ওয়াদি জীবনের ঝুঁকি নিয়েই জুনে জিকিম ক্রসিংয়ে পরিবারের সদস্যদের জন্য আটা আনতে গিয়েছিলেন। কিন্তু এরপর তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফোনের স্ক্রিনে তিনি লিখে রেখেছিলেন-আমার কিছু হলে, ক্ষমা করে দিও মা। আমার ফোন যিনি পাবেন, পরিবারকে জানাবেন আমি মাকে খুব ভালোবাসি। ত্রাণ প্রার্থীদের লক্ষ্য করে ইসরাইলের নিয়মিত গুলিবর্ষণের শিকার আম্মার ওয়াদি আর নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারেননি। পরে এক অজ্ঞাত ব্যক্তি সেই ফোনটি খুঁজে পেয়ে তার পরিবারের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।

আম্মার ওয়াদির মতো আরও অনেক ফিলিস্তিনিই জিকিমে ত্রাণ সংগ্রহ করতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছেন। তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা কারও জানা নেই। এমন নিখোঁজদের নিয়ে অনুসন্ধান করে সম্প্রতি চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছে সিএনএন। এতে বলা হয়েছে গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের নতুন গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। যারা মানবিক সহায়তা আনতে গিয়ে নিহত হয়েছেন, তাদের বুলডোজার দিয়ে বালিচাপা দিয়েছে দখলদার ইসরাইলি বাহিনী।

‘বুলডোজড কর্পসেস অ্যান্ড আনমার্কড গ্রেভস, সিএনএন ইনভেস্টিগেটস দ্য ফেট অব গাজা’স মিসিং এইড সিকার্স’ শিরোনামে বুধবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, উপত্যকার জিকিম ক্রসিংয়ের কাছে ত্রাণ নিতে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ এবং নিহতদের লাশ বুলডোজার দিয়ে বালিতে চাপা দেওয়ার প্রমাণ সামনে এসেছে। সিএনএন জানিয়েছে, জিকিম সীমান্তের আশপাশে গুলিবর্ষণে নিহতদের দেহ অনেক ক্ষেত্রেই মিলিটারি জোনে ফেলে রাখা হতো। অনেক সময় বুলডোজার চালিয়ে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে, আর অনেক দেহ উদ্ধার না হওয়ায় খোলা জায়গায় পচে-গলে পড়ে ছিল। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, এভাবে বুলডোজার দিয়ে মাটিতে মিশিয়ে মৃতদেহকে অচিহ্নিত স্থানে কবরস্থ করার প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।

স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে-গ্রীষ্মজুড়ে জিকিম এলাকায় ব্যাপক বুলডোজার কার্যক্রম চালানো হয়েছে। জুনে ঘটে যাওয়া এক হামলার পরের ভিডিওতে দেখা যায় উলটে যাওয়া একটি ত্রাণ ট্রাকের চারপাশে আংশিক মাটিচাপা পড়ে থাকা দেহ। সাবেক দুই আইডিএফ সদস্য সিএনএনকে জানিয়েছেন, গাজার অন্যান্য অঞ্চলেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। তারা বর্ণনা করেছেন কিভাবে যুদ্ধের সময় ফিলিস্তিনিদের মৃতদেহ অগভীর কবরস্থানে বুলডোজার দিয়ে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে। ইসরাইলি সামরিক বাহিনী আইডিএফ দাবি করেছে-তারা মৃতদেহ সরানোর জন্য বুলডোজার ব্যবহার করেনি। তবে তা দিয়ে কবর দেওয়া হয়েছিল কিনা সে প্রশ্নের উত্তর তারা এড়িয়ে গেছে। আইডিএফ বলেছে, এলাকা সুরক্ষা, বিস্ফোরকের ঝুঁকি মোকাবিলা বা রুটিন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জন্য বুলডোজার ব্যবহৃত হয়।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের বিশেষজ্ঞ জানিনা ডিল বলেন, যুদ্ধরত পক্ষগুলোর দায়িত্ব নিহতদের এমনভাবে কবর দেওয়া যাতে তাদের পরিচয় শনাক্ত করা যায়। মৃতদেহ বিকৃত করা বা অসম্মানজনকভাবে কবরস্থ করা জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধ। জিকিম এলাকায় গুলির মাঝে ত্রাণ বহনকারী ফিলিস্তিনিদের ছুটে আসার একাধিক ভিডিও সিএনএন যাচাই করেছে। এক ভিডিওতে দেখা যায়-একজন ত্রাণ বহনকারীকে পেছন থেকে গুলি করা হচ্ছে। আরেকটিতে আহতদের উদ্ধার করতে গিয়ে আবার গুলি চলছে। এক ত্রাণের ট্রাকচালক বলেন, জিকিম দিয়ে গেলে প্রতিবারই লাশ দেখতে পাই। ইসরাইলি বুলডোজারগুলোকে মৃতদেহ মাটিচাপা দিতে দেখেছি। আরেকজন বলেন-এটা যেন বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল। সেখানে কী ঘটে কেউ জানে না।

জুনের মাঝামাঝি এক ঘটনায় একটি ত্রাণ ট্রাক ঘিরে ধরেন ক্ষুধার্ত মানুষজন। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, তখনই আইডিএফ গুলি চালায় এবং বহু মানুষ ট্রাকের নিচে পড়ে মারা যান। কয়েক দিন পর সিভিল ডিফেন্সের অ্যাম্বুলেন্স গিয়ে ১৫টি লাশ উদ্ধার করতে পারে, কিন্তু প্রায় ২০টি দেহ উদ্ধার না করেই ফিরে আসতে হয়। কারণ অ্যাম্বুলেন্স ভর্তি হয়ে গিয়েছিল।

এক আইডিএফ সদস্য জানান, ২০২৪ সালের শুরুতে তাদের ঘাঁটির পাশে দুদিন ধরে পড়ে থাকা নয়টি মৃতদেহ বুলডোজার দিয়ে ঢেকে ফেলা হয়। তিনি বলেন, কুকুরগুলো লাশ টেনে খাচ্ছিল। যে দৃশ্য দেখা ছিল অসহনীয়। মৃতদেহের পরিচয় নথিভুক্ত করার কোনো চেষ্টা হয়নি। ইসরাইলি সৈন্যদের বয়ান সংগ্রহকারী সংগঠন ‘ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স’ও জানিয়েছে-এ ধরনের আরও অনেক সাক্ষ্য তাদের কাছে এসেছে।

আম্মার ওয়াদি নিখোঁজের ৬ মাস পারও পরিবার তার খোঁজ পায়নি। তার মা নাওয়াল মুসলেহ বলেন, ছেলের কথা মনে পড়লেই চোখের পানি থামে না। আমরা যা-ই হোক মেনে নেব। শুধু জানতে চাই, তার কী হয়েছিল।

গাজার সীমান্তবর্তী এই অঞ্চল এখন নিখোঁজদের কবরস্থান হয়ে উঠেছে। যেখানে বহু মানুষ যে পথ ধরে ত্রাণ নিতে গিয়েছিলেন, সেই পথই তাদের শেষ যাত্রাপথ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এসব নিখোঁজদের পরিবার ও স্বজনরা এখনো তাদের ফেরার আশায় পথ চেয়ে বসে আছেন। নিখোঁজ আম্মার ওয়াদির ভাই হোসাম যেমনটা বলছিলেন, তিনি যদি শহীদ হয়ে থাকেন, আল্লাহ তার সহায় হন। আর যদি তিনি বেঁচে থাকেন, তাহলে তার ফেরার আশা তো অন্তত আমরা করতে পারি।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম