Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

মিত্রদের মধ্যে হতাশা

বিএনপির ২৮ আসন নিষ্পত্তির অপেক্ষায়

তারিকুল ইসলাম

তারিকুল ইসলাম

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিএনপির ২৮ আসন নিষ্পত্তির অপেক্ষায়

সম্প্রতি দুই ধাপে ২৭২ আসনে সম্ভাব্য একক প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিএনপি। এসব প্রার্থী ঘোষণার পর অনেক মিত্র রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা বিস্মিত ও হতাশ হয়েছেন। কারণ এদের মধ্যে কয়েকজন এতদিন নিজ আসনে ভোটের গণসংযোগে বেশ সক্রিয় ছিলেন। এখনো ২৮টি আসন ফাঁকা রেখেছে বিএনপি। দলটির নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, এসব আসনের বেশিরভাগই যুগপৎ আন্দোলনের মিত্র দলগুলোর জন্য রাখা হয়েছে। তবে কয়েকটি বিরোধপূর্ণ আসনও রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দ্রুত সময়ের মধ্যে মিত্রদের সঙ্গে আসন সমঝোতার বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে চাইছে বিএনপিও।

দলটির নেতাদের মতে, যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গী ও শরিক দলগুলোর চাহিদামতো আসন সমঝোতার ক্ষেত্রে তারা কিছুটা জটিলতায় পড়েছেন। কিন্তু তার চেয়েও বড় সমস্যা মনে করা হচ্ছে জোটগতভাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেও নিজস্ব প্রতীকে ভোট করার বিধানটি নিয়ে। আরপিওর সংশোধনীর কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে; যা জোটবদ্ধ ছোট দলগুলোর জয়ের সম্ভাবনাকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। এই বাস্তবতা মাথায় রেখে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আসার মতো জোটের প্রভাবশালী প্রার্থীদের বিএনপি ছাড় দিতে চায়। এদিকে ফাঁকা ২৮টি আসনের মধ্যে কয়েকজনকে ইতোমধ্যে ‘সবুজ সংকেত’ও দেওয়া হয়েছে।

দলটির একাধিক নীতিনির্ধারক জানান, জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হবে, এমন বিধানের ফলে ভোটের হিসাব-নিকাশ করে ভেবেচিন্তে অগ্রসর হতে হচ্ছে বিএনপিকে। কারণ, এমন বিধানে ভোট করে অন্য কোনো দল লাভবান হবে কিনা তাও বিবেচনায় রাখতে হচ্ছে। এর হিসাবটা হচ্ছে, ছোট দলগুলো বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে আছে একসঙ্গে নির্বাচন করার জন্য এবং সংসদ-সদস্য পদে জোটের প্রার্থী হওয়ার আশায়। সে ক্ষেত্রে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীককে ছোট দলগুলোর নেতারা জয়ের ক্ষেত্রে বড় ভরসা হিসাবে দেখেন। আরপিওর প্রতীকসংশ্লিষ্ট ধারাটি সংশোধনের ফলে এতে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। বিএনপির সমর্থন পেলেও ব্যক্তিজনপ্রিয়তা না থাকলে ছোট দলগুলোর নেতাদের নিজ দলীয় প্রতীকে জয়ী হওয়া কঠিন হয়ে পড়বে বলে রাজনীতিতে আলোচনা আছে।

বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে জানা গেছে, দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা শরিক বা মিত্র দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের প্রার্থিতার বিষয়টি নানাভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করছেন। বিগত আন্দোলনে শরিক দলগুলোর নেতাদের ভূমিকা, তাদের রাজনৈতিক অবস্থান, ভবিষ্যৎ সরকার গঠনে তাদের প্রয়োজনীয়তাসহ বিভিন্ন বিষয় প্রার্থিতার ক্ষেত্রে বিবেচনায় নিচ্ছেন। সে হিসাবে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দল ও জোটের জন্য সর্বোচ্চ ২২ আসন ছাড়ের কথা ভাবা হচ্ছে।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বৃহস্পতিবার বলেন, আমাদের সমমনা মিত্র যারা আছেন তাদের আসনসহ আরও দু-একটা দলীয় প্রার্থীর আসনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে পারে। সেগুলো আরও পরে এবং যথাসময়ে ঘোষণা করা হবে বলে জানান তিনি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান যুগান্তরকে বলেন, প্রার্থী বাছাইয়ে দলের সামগ্রিক লাভ-ক্ষতি হিসাব-নিকাশ করা হয়। সেই হিসাব-নিকাশ শেষে উপযুক্ত প্রার্থীকেই দল বেছে নেয়। ভোট তো এক রকম উৎসবের মতো। ভোটের আগে নানা গুঞ্জন উঠবে, সেটা নিয়ে নানা পক্ষের নানা মত-দ্বিমত থাকবে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মিত্রদের ছাড় দেওয়ার জন্যই তো এখনো আসন ফাঁকা রাখা হয়েছে। নানা কারণে মিত্রদের কেউ বাদ পড়লে তাদের ভিন্ন ভাবে যথাযথ মূল্যায়ন করা হবে।

কার জন্য কোন আসন ফাঁকা : পিরোজপুর-১ আসনে জাতীয় পার্টির (জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দারের মনোনয়নের বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য এখনো ওই আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেনি বিএনপি। এছাড়া বগুড়া-২ আসনে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নার জন্য, ঢাকা-১৭ আসনে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ, লক্ষ্মীপুর-১ আসনে বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিমের জন্য রাখা হয়েছে। এছাড়া ঢাকা-১৩ আসনে এনডিএমের চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ আসনে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, চট্টগ্রাম-১৪ আসনে এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদের ছেলে অধ্যাপক ওমর ফারুক, কুমিল্লা-৭ আসনে দলটির মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ, পটুয়াখালী-৩ আসনে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর ও ঝিনাইদহ-২ আসনে দলটির সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খানের কারণে ঘোষণা করা হয়নি। এসব আসনে তাদেরকেই মনোনয়ন দেওয়ার সিদ্ধান্ত একরকম নিশ্চিত আছে। তবে কৌশলগত কারণে ঘোষণা করা হয়নি।

অন্যদিকে, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের আমির উবায়দুল্লাহ ফারুকের জন্য সিলেট-৫, মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দীর জন্য নীলফামারী-১, দলটির কেন্দ্রীয় নেতা মোহাম্মদ আলী সিলেট-৪, জুনায়েদ আল হাবিব ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২, মনির হোসেন কাসেমী নারায়ণগঞ্জ-৪, মোখলেছুর রহমান চৌধুরী কিশোরগঞ্জ-১, শোয়ায়েব আহমদ সুনামগঞ্জ-২ আসন চাইছেন। তবে ড. রেদোয়ান আহমেদ, শাহাদাত হোসেন সেলিম, আন্দালিব রহমান পার্থ, অধ্যাপক ওমর ফারুক ও ববি হাজ্জাজকে বিএনপি থেকে ‘সবুজ সংকেত’ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

এছাড়া গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব শারীরিক অসুস্থতার জন্য এবার নির্বাচনে দাঁড়াতে চাইছেন না। তবে তার স্ত্রী জেএসডির সহসভাপতি তানিয়া রবের জন্য লক্ষ্মীপুর-৪ আসনটি চাইছেন। কিন্তু এই আসনটি ছাড়তে রাজি নয় বিএনপি। দলটির একটি সূত্র জানায়, এই আসনে বিএনপির প্রার্থী সাবেক দুবারের সংসদ-সদস্য এবিএম আশরাফ উদ্দিন নিজানকে ইতোমধ্যে সবুজ সংকেত দেওয়া হয়েছে। সূত্র জানায়, নিজানের মনোনয়ন নিশ্চিত হওয়ার খবর জেনে জেএসডি এখন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও এবি পার্টির সঙ্গে জোট করতে চাইছে। ইতোমধ্যে একাধিক বৈঠকেও অংশ নিয়েছে জেএসডি।

ময়মনসিংহ-১০ (গফরগাঁও-পাগলা) আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী এলডিপির (অলি) প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ। ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি জোটের প্রার্থী ছিলেন। এবারও তাকে ছেড়ে দেওয়া হতে পারে আলোচনা আছে। এজন্য বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করেনি।

২০১৮ সালের নির্বাচনে পাবনা-১ (সাঁথিয়া) আসনটি গণফোরাম নেতা ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদকে ছেড়ে দিয়েছিল বিএনপি। এবারও তিনি আলোচনায় এগিয়ে আছেন। এছাড়া বিএনপির তিনজন মনোনয়নপ্রত্যাশী হলেন-নির্বাহী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ, উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক ভিপি শামসুর রহমান, কেন্দ্রীয় যুবদলের সদস্য মাসুদুর রহমান মাসুদ।

হতাশ ও ক্ষুব্ধ অনেক মিত্র, সোমবার ১২ দলীয় জোটের সংবাদ সম্মেলন : দ্বিতীয় দফায় ঘোষিত আসনগুলোর মধ্যে কমপক্ষে চারটি আসনে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের মিত্ররা আসন ছাড় প্রত্যাশা করেছিলেন। তারা হলেন, নড়াইল-২ আসনে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের আহ্বায়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, কিশোরগঞ্জ-৫ আসনে ১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদা, ঝালকাঠি-১ আসনে বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান ও যশোর-৫ আসনে ১২ দলীয় জোট শরিক জমিয়তের যুগ্ম মহাসচিব রশিদ বিন ওয়াক্কাস। তাদের মধ্যে একাদশ সংসদ নির্বাচনে নড়াইল-২ থেকে ফরিদুজ্জামান ফরহাদ এবং পিরোজপুর-২ থেকে মোস্তাফিজুর রহমান ইরান ধানের শীষ প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। আর যশোর-৫ থেকে নির্বাচন করেন রশিদ বিন ওয়াক্কাসের পিতা জমিয়তের মরহুম মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস। এহসানুল হুদাকে সহযোগিতা করার জন্য চিঠি দিয়ে নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দিয়েছিল বিএনপি। নির্বাচন সামনে রেখে এ চার দলের প্রধানরা এলাকায় নিয়মিত গণসংযোগে থাকলেও তাদের আসনে বৃহস্পতিবার বিএনপি প্রার্থী দিয়েছে। নড়াইল-২ থেকে মনিরুল ইসলাম, কিশোরগঞ্জ-৫ থেকে শেখ মজিবুর রহমান ইকবাল, ঝালকাঠি-১ থেকে রফিকুল ইসলাম জামাল এবং যশোর-৫ থেকে অ্যাডভোকেট ইকবাল হোসেনকে প্রার্থী করেছে দলটি। এছাড়া গণফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সুব্রত চৌধুরী ঢাকা-৬ আসন থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। ২০১৮ সালে তাকে এই আসন ছাড় দিয়েছিল বিএনপি। এবার তাকে ঢাকা-৭ আসনে ছাড় দেওয়া হতে পারে বলে আলোচনা থাকলেও শেষ পর্যন্ত এই আসনে হামিদুর রহমানকে প্রার্থী করেছে বিএনপি।

এদিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতি নিয়ে শুক্রবার ১২ দলীয় জোটের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। পরে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, জোট প্রধান জাতীয় পার্টির (জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দারের খিলগাঁও কার্যালয়ে বৈঠকে শরিক দলের নেতাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করে প্রার্থী ঘোষণায় তারা বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন। বিএনপির ২৭২ আসনে মনোনয়ন ঘোষণার মাধ্যমে প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ করা হয়েছে। ভবিষ্যৎ রাজনীতি ও করণীয় সম্পর্কে সোমবার এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে জোটের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট বক্তব্য প্রদানের কথাও প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। তবে এই বৈঠকে জোটের মুখপাত্র বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম উপস্থিত ছিলেন না।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম