Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

তিন দলের নতুন জোট

আশা-নিরাশা দুটোই আছে

নূরে আলম জিকু

নূরে আলম জিকু

প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আশা-নিরাশা দুটোই আছে

ছবি: সংগৃহীত

তিন দলের সমন্বয়ে গঠিত নতুন জোটের (গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট) বিষয়ে জনমনে আশা এবং নিরাশা দুটোই আছে। কারও মতে, এই জোট বাংলাদেশের প্রত্যাশিত সংস্কার এগিয়ে নিয়ে আগামী দিনে গণমানুষের সমর্থন পাবে। আবার কারও মতে, সাংগঠনিক দক্ষতা ও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা থাকলেও ব্যাপক গণমানুষকে এই জোটের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা বেশ চ্যালেঞ্জিং। তাদের মতে, বাংলাদেশে দ্বিদলীয় রাজনীতির বাইরে যাওয়া এমনিতেই অনেক কঠিন কাজ। তাছাড়া জনগণের বড় অংশ এখনো অনেক কিছুর ব্যাপারেই নিজেদের সুবিধা-অসুবিধা বা ভালো-মন্দপ্রসূত চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে সত্যিকার অর্থে দেশের মঙ্গল চাওয়া, রাষ্ট্রগঠনের আদর্শভিত্তিক চেতনা ধারণ করে কাজ করার চিন্তা বেশির ভাগ মানুষ কমই করে-এমন ধারণাই প্রতিষ্ঠিত। এ কারণে অনেকের ধারণা, নতুন জোট গঠনের উদ্দেশ্য ইতিবাচক হলেও শেষ পর্যন্ত কতটা সফল হতে পারবেন তা নিয়ে সংশয় থেকে যাচ্ছে।

জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগ মুহূর্তে ‘গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট’ নামে রোববার আত্মপ্রকাশ করেছে নতুন এই রাজনৈতিক জোট। যেখানে একত্র হয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি) ও বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন। আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে নেতারা জানিয়েছেন, রাষ্ট্র সংস্কারের পক্ষে জনমত গঠন এবং আসন্ন নির্বাচনে শক্তিশালী বিকল্প হিসাবে দাঁড়ানোর উদ্দেশ্যেই এ জোটের জন্ম। তারা আশা প্রকাশ করেন, শিগগিরই আরও সংস্কারপন্থি দল, সংগঠন, প্ল্যাটফর্ম ও অভিজ্ঞ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এই জোটে যুক্ত হবে।

জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক দিলারা চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, তিন দলের সমন্বয়ে যে জোট গঠিত হয়েছে, এটিকে আমি ইতিবাচক হিসাবে দেখছি। কারণ বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী তারা একটা ‘অনড়’ অবস্থান নিয়েছে। আমরা আগেই ধারণা করেছিলাম-জুলাই সংস্কার ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত নিয়ে কাজ করবে এমন একটা নতুন জোট হবে। জুলাইয়ের যে প্রত্যাশা; বিশেষ করে ভারতীয় আধিপত্য বিস্তার থেকে মুক্তি, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা, সংস্কার কার্যক্রম অব্যাহত রাখাই হবে তাদের রাজনীতি। এটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে ন্যারেটিভ আরও শক্তিশালী করতে হবে। যদি তা সম্ভব হয়, তাহলে আমি মনে করি এই জোট রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তি হিসাবে বলয় সৃষ্টি করতে পারবে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, সময়ই বলে দেবে গণতান্ত্রিক জোটের ভবিষ্যৎ কী? আমার মনে হয়েছে এরা পরিবর্তন ও সংস্কারের পক্ষে। তারা শুধু সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে নয়, গণতন্ত্রে উত্তরণের পক্ষে। এই উত্তরণের পক্ষে হলে অনেকগুলো মৌলিক সংস্কার দরকার, সেটা যদি তারা করে; তাহলে আমি মনে করি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। তৃণমূলের অবস্থান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভোটের মাঠে তাদের তেমন একটা অবস্থান নেই, এটা সত্যি। কিন্তু তারা যদি নৈতিক একটা অবস্থান নেয়, তাহলে ইতিবাচক একটা প্রভাব সৃৃষ্টি করতে পারবে।

সাধারণ ভোটাররা মনে করেন, দেশের রাজনীতিতে বিএনপি-আওয়ামী লীগ দীর্ঘ সময় ধরে প্রভাব বিস্তার করেছে। গণ-অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকায় সেখানে জামায়াতে ইসলামী শক্তি সঞ্চার করেছে। ফলে সংস্কারের অঙ্গীকার নিয়ে তৈরি নতুন এ জোটের আবির্ভাব বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের দ্বিমেরুকেন্দ্রিক রাজনীতিতে সম্ভাব্য তৃতীয় শক্তির উত্থান নির্দেশ করে। জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক সংস্কারের চাহিদা বাড়ছে। এই জোট সেই শূন্যস্থান কতটা পূরণ করতে পারবে এই আলোচনা এখন সামনে এসেছে। তবে টিকে থাকতে হলে তাদের সুস্পষ্ট নীতি, প্রস্তাব ও ঐক্যবদ্ধ সাংগঠনিক শক্তির পরীক্ষা দিতে হবে বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নতুন এই জোট আগামী কয়েক দিনের মধ্যে ঢাকায় বড় সমাবেশ করার পরিকল্পনা করেছে। সেখানে ব্যাপক জনসমাগম ঘটিয়ে দলটির কর্মপরিকল্পনা ও উদ্দেশ্য দেশবাসীকে জানাবেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে ছিল এমন কয়েকটি দলকে ভেড়ানোর নানা তৎপরতা চলছে এই জোটের তরফ থেকে। জোটের দু-একজন নেতা এমনও দাবি করছেন, আরও অন্তত ৬টি দল এই জোটে যাওয়ার বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। বিএনপির সঙ্গে আসন সমঝোতায় অপেক্ষায় রয়েছে ওই ৬টি দল। এজন্য তারা কিছুটা সময় নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।

এদিকে গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট গঠন নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। অন্তত ৭টি রাজনৈতিক দলের নেতা জানান, চেষ্টা থাকলেও বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর বাইরে অন্য কোনো দল এখনো জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে পারেনি। তাছাড়া সেভাবে সাংগঠনিক অবস্থান তৈরি করতেও তাদের সময় লাগবে।

ছোট ছোট দলগুলো সব সময়ই আসন ছাড়ের ব্যাপারে বড় দলগুলোর ওপর নির্ভর করে বলে রাজনীতিতে আলোচনা আছে। ফলে বিগত সময়ে জোট গঠন করেও ছোট দলগুলোর অনেকে তেমন এটা সুফল পায়নি। অবশ্য অনেকে এমনো বলছেন, গণ-অভ্যুত্থান প্রেক্ষাপট পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। তাছাড়া তরুণ প্রজন্মের মধ্যে রাজনীতির চর্চা বেড়েছে। ফলে তিন দলের নতুন এই জোটটি কতটা সফল হবে তা নির্ভর করবে রাজনীতির প্রতি তারা কতটা প্রতিশ্রুতিশীল তার ওপর। এছাড়া সততা, নিষ্ঠা এবং সমাজের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতাও জনগণের কাছে দৃশ্যমান করতে হবে। পাশাপাশি যদি তারা জনগণকে বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প দিতে পারে, তাহলে এ জোট রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় নতুন মাত্রা আনতে পারে বলে তারা মনে করেন।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু যুগান্তরকে বলেন, গণতান্ত্রিক ধারায় রাজনৈতিক জোট গঠন হতেই পারে। জনগণই বলতে পারবে তাদের অবস্থান কী হবে। আমরা তাদের মঙ্গল প্রত্যাশা করি।

জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, নির্বাচন এলে এক বা একাধিক জোট গঠন সব সময়ই হয়ে থাকে। তবে নতুন জোটের উদ্দেশ্য কিংবা কার্যক্রম কী হবে তা এখনো আমাদের জানা হয়নি। যে কোনো দল বা জোটের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তার ভিশন, প্রতিশ্রুতি ও কর্মকাণ্ডের ওপর। এগুলোই বলে দেবে তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে।

গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর যুগান্তরকে বলেন, এনসিপি গণ-অভ্যুত্থানে প্রথম সারিতে থাকা তরুণদের একটি দল। তাদের প্রতি দেশের মানুষের অনেক বেশি প্রত্যাশা ছিল যে, রাজনীতিতে ভিন্ন একটা মাত্রা যোগ করবে। কিন্তু গত এক বছরে সরকারের সুযোগ-সুবিধা পেয়েও তারা বড় দল হিসাবে দাঁড়াতে পারেনি। ৬৪ জেলা কিংবা উপজেলা পর্যায়ে কোনো কাঠামোই দাঁড় করাতে পারেনি তারা। বরং ক্ষমতার কাছাকাছি থাকায় তাদের ঘিরে একটা সুবিধাবাদী চক্র তৈরি হয়েছে, প্রতিকূল সময়ে তাদের খুঁজেও পাওয়া যাবে না। সেক্ষেত্রে এই জোটের নেতৃত্বে এনসিপি রয়েছে। এই জোটে যারা আছেন, ব্যক্তি হিসাবে তারা ভালো পড়াশোনা করা মানুষ; রাজনীতিতে তাদের ইতিবাচক চিন্তাধারা আছে। সাংগঠনিকভাবে কিংবা সাধারণ মানুষের কাছে তারা এখন পর্যন্ত সমর্থন পেয়েছে এমনটি বলা যাবে না। বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচন একেবারে সন্নিকটে। এমন পরিস্থিতিতে নতুন এই জোট কতটুকু কী করতে পারবে, তা নিয়ে সন্দেহ, সংশয় আছে। আবার এটিও সত্য, মানুষের মধ্যে রাজনীতি নিয়ে একটা হতাশা দীর্ঘদিন ধরেই আছে। সেক্ষেত্রে আরেকটু ভালো বা বৃহত্তর পরিসরে করলে জোট মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারত। যে দলগুলোর সমন্বয়ে জোট গঠিত হয়েছে, সেখানে আমার মনে হয় না মানুষ নতুন করে এটা নিয়ে স্বপ্ন দেখবে বা আস্থার মতো কিছু খুঁজে পাবে।

যদিও এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু যুগান্তরকে বলেন, আমরা এতদিন নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা বলছি, সেটা কাল্পনিকভাবে বলেছি। এখন আমরা চাচ্ছি, নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তটা কী? কীভাবে চাই, তার আলোকে একটা ধারণা সাধারণ মানুষের মধ্যে তুলে ধরা। পুরোনো যে রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা আছে, সেখান থেকে বেরিয়ে এসে একটা রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কাঠামো তৈরি করা। একটা বড় রাজনৈতিক বলয় সৃষ্টি করা, এটাই আমাদের লক্ষ্য।

ঢাকায় সমাবেশ করার সম্ভাবনার বিষয়ে তিনি বলেন, এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। আইডিয়া হয়েছে। শিগগিরই আমরা সমাবেশ করব। তফসিলের আগেই জাতীয় সংসদ ভবন এলাকা অথবা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে সমাবেশ করার পরিকল্পনা রয়েছে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম