বছরে বিদ্যুতে লোকসান ৫৫ হাজার কোটি টাকা
শাহেদ সিদ্দিকী
প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে বিক্রির কারণে গত অর্থবছরে সরকার লোকসান দিয়েছে ৫৫ হাজার কোটি টাকা। এ সময় অন্তর্বর্তী সরকার বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দিয়েছে ৩৮ হাজার কোটি টাকা। বাকি ১৭ হাজার কোটি টাকার লোকসানের বোঝা এখন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ঘাড়ে। এর আগের বছরও বিদ্যুৎ খাতে লোকসান হয়েছিল প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা।
গত বুধবার পিডিবির বোর্ড সভায় বিদ্যুৎ খাতের আয়-ব্যয়ের হিসাব অনুমোদন করা হয়। সেখানে বড় লোকসানের চিত্র উঠে আসে। তবে এ ব্যাপারে আপাতত কিছু বলতে নারাজ পিডিবির সদস্য (অর্থ) অঞ্জনা খান মজলিস। তিনি বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘বোর্ডে অনুমোদন হলেও প্রকাশ করার পরিস্থিতি হয়নি। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে এটি প্রকাশ করা হবে।’
মূলত বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর (আইপিপি) ক্যাপাসিটি চার্জ দিতেই কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ হয় সরকারের। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সব চুক্তি পর্যালোচনা করতে গঠিত জাতীয় কমিটি গত মাসে একটি প্রাথমিক রিপোর্টে বলেছে, বিগত সরকার আমলে ১৫ বছরে এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে বিদ্যুৎ খাতে। পিডিবি জানিয়েছে, গত অর্থবছরে বিদ্যুতের দাম বাড়েনি। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সরবরাহ ব্যয় বেড়েছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। বিশেষ করে গ্যাসের সরবরাহ দিন দিন কমছে। এতে ফার্নেস অয়েল ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ বেশি কিনতে হচ্ছে পিডিবিকে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গত বছর সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র মিলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ হয়েছে প্রায় ১০ টাকা ৮০ পয়সা। বিতরণ কোম্পানির কাছে সেই বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যয় ছিল প্রতি ইউনিট ১২ টাকা ৫০ পয়সা। অন্যদিকে প্রতি ইউনিটের বিক্রিমূল্য ৬ টাকা ৯৯ পয়সা। বিতরণ খরচ ও বিক্রিমূল্যের মধ্যে এ বিশাল ফারাকের কারণে পিডিবির লোকসান হয়েছে ৫৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ভর্তুকি হচ্ছে ৩৮ হাজার কোটি টাকা।
বলা বাহুল্য, পিডিবি সরকারের একক সংস্থা হিসাবে সরকারি-বেসরকারি এবং আমদানি করা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির কাছে বিক্রি করে। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের নীতি অনুযায়ী এ খাতে সব দিক দিয়ে লাভবান হচ্ছে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র বা আইপিপিগুলো। কারণ সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী আইপিপি বা রেন্টালে উৎপাদিত বেশি দামের বিদ্যুতের লোকসানের সব টাকা ভর্তুকি হিসাবে দেয় সরকারের পক্ষে অর্থ মন্ত্রণালয়। এবার সে হিসাবে দেওয়া হয়েছে ৩৮ হাজার কোটি টাকা। তবে পিডিবির নিজস্ব বা সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের ক্রয়মূল্য বেশি হলেও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে কোনো ভর্তুকি দেওয়া হয় না।
পিডিবির হিসাব অনুযায়ী, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি ইউনিট ৭ টাকা, কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রে ১৩ টাকা, ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্রে ২২ টাকা এবং ভারত থেকে (আদানি নয়) আমদানি করা বিদ্যুতের দাম পড়ে ৮ টাকার মতো। আর ডিজেলের কেন্দ্রে খরচ পড়ে ৪০ টাকার বেশি। যদিও বেসরকারি কোনো ডিজেল কেন্দ্র আর চালু নেই। শুধু আপৎকালীন সময়ের জন্য পিডিবির কয়েকটি ডিজেল জেনারেটর আছে।
দেশে ১৩৫ কেন্দ্রে প্রায় ২৮ হাজার মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা আছে। এর মধ্যে আইপিপি হচ্ছে ৭০টি। এগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা ১১ হাজার মেগাওয়াট। বাকিগুলো সরকারি কেন্দ্র। তবে পুরো বিতরণ ব্যবস্থায় এখন নির্ভরযোগ্য হচ্ছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ৮টি কেন্দ্রে উৎপাদন ক্ষমতা ৬ হাজার ২০০ মেগাওয়াট।
পিডিবি জানিয়েছে, আগের বছরের চেয়ে বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের ব্যবহার বেড়েছে। গত অর্থবছরে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪৮ দশমিক ৫২ শতাংশ গ্যাসের কেন্দ্র থেকে, ফার্নেস অয়েলে ১১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ডিজেলে দশমিক ৪৬ শতাংশ, বায়ু বিদ্যুৎ দশমিক ০৭ শতাংশ, সোলারে ৯ শতাংশ, জলবিদ্যুৎ দশমিক ৮৬ শতাংশ। এছাড়া ভারত থেকেও আমদানি করে সরবরাহ করা হয়েছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ খাতে এখনো অরাজক অবস্থা চলছে। এ সরকার এ খাতকে এখনো শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে পারেনি।
এদিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সব চুক্তি পর্যালোচনা করতে গঠিত জাতীয় কমিটির সদস্যরা গত মাসে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিক, আমলা এবং রাজনীতিবিদদের যোগসাজশে বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। এ কারণে বিদ্যুতের ২৫ শতাংশ বাড়তি দাম দিতে হচ্ছে গ্রাহককে।
