Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

তফসিল ঘোষণার প্রথম দিনই অঘটন

দিনদুপুরে ওসমান হাদিকে গুলি

Icon

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দিনদুপুরে ওসমান হাদিকে গুলি

জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় যোদ্ধা, ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান বিন হাদি (ওসমান হাদি) দিনদুপুরে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। শুক্রবার পবিত্র জুমার নামাজের পর রাজধানীর বিজয়নগর বক্স কালভার্ট রোডে মোটরসাইকেলে এসে দুই যুবক খুব কাছ থেকে হাদির মাথায় গুলি করে। মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হয়। তাকে বাঁচানোর জন্য রক্ত দিতে হয়। অবস্থার অবনতি হলে রাতে তাকে ঢামেক থেকে এভারকেয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, হাদির অবস্থা সংকটাপন্ন। হাসপাতালে তার মাথার খুলি খুলে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস দিয়ে রাখা হয়েছে। তিনি এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আছেন। তাকে দেখতে হাসপাতালে ছুটে যান অনেকেই। হাদির ওপর নির্মম হামলার ঘটনায় সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় বইছে। এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এছাড়া বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, ইনকিলাব মঞ্চ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা হাদির ওপর হামলার ঘটনায় নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে হামলাকারীদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবি করেছেন। গুলির ঘটনায় প্রতিবেশী একটি দেশের গোয়েন্দা সংস্থা ও আওয়ামী লীগের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন হাদির বোন মাহফুজা। 

ঘটনার প্রতিবাদ ও জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে চলছে বিক্ষোভ। পরিস্থিতি বিবেচনায় ঢাকা মেডিকেলসহ বিভিন্ন স্থানে সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন করা হয়। হামলাকারীদের গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান চলছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার। 

শুক্রবার দুপুর ২টা ২২ মিনিটের ঘটনা। এ সময় হাদি নির্বাচনি প্রচারণায় ছিলেন। বিজয়নগর বক্স কালভার্ট রোড থেকে তার যাওয়ার কথা ছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে। সেখানে তিনি ইনকিলাব মঞ্চের কয়েকজন সহযোদ্ধার সঙ্গে দুপুরের খাবার খাবেন-এমনটিই ছিল সিদ্ধান্ত। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাদির ওপর গুলি চালিয়ে দুই যুবক মোটরসাইকেলে পালিয়ে যায়। গুলিবর্ষণকারীদের মাথায় ছিল হেলমেট। হঠাৎ গুলির শব্দে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন সাধারণ মানুষ।

সন্ত্রাসীদের ছোড়া গুলি হাদির কানের নিচ দিয়ে মাথায় ঢুকে যায়। গুলিবিদ্ধ হাদিকে দ্রুত উদ্ধার করে দুপুর ২টা ৩৫ মিনিটের দিকে ঢামেকে ভর্তি করা হয়। সেখানে সিটিস্ক্যান এবং অস্ত্রোপচারের পর উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে এভারকেয়ার হাসপাতালে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হয়। ওসমান বিন হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়লে ঢামেকে জড়ো হন জুলাই অভ্যুত্থানের আন্দোলনকারীরা। হামলাকারীদের গ্রেফতার ও সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ করেন। এ সময় হাসপাতাল চত্বরে অনেককে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা যায়। শরিফ ওসমান হাদি কোমায় আছেন উল্লেখ করে ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের আবাসিক সার্জন (আরএস) ডা. মোশতাক আহমেদ বলেন, তার অবস্থা খুবই গুরুতর। তার মাথায় গুলি লেগেছে। শুক্রবার রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের জানান, হাদির অবস্থা ক্রিটিক্যাল (আশঙ্কাজনক)। তাকে ‘লাইফ সাপোর্ট’ দেওয়া হয়েছে। গুলি হাদির বাম কানের নিচ দিয়ে মাথায় ঢুকে যায়। তার পরিবার প্রথম দিকে তাকে সিএমএইচ হাসপাতালে নেওয়ার কথা বলেছিল। কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে এভারকেয়ারে নেওয়ার কথা বলেন। আমরা তাদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক এভারকেয়ার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে সেখানে নেওয়ার ব্যবস্থা করেছি।

হাদির অবস্থা সংকটাপন্ন জানিয়ে ঢামেক হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলেন, তার মাথায় প্রবেশ করা গুলি বাম কানের ওপর দিয়ে ঢুকে ডানদিকে বের হয়ে গেছে, যার ফলে গুরুতর মস্তিষ্ক আঘাত (ম্যাসিভ ব্রেন ইনজুরি) হয়েছে। বর্তমানে তার মাথার খুলি খোলা রয়েছে এবং তাকে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসে রাখা হয়েছে। হাদির শরীরে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়েছে। তার রক্তের গ্রুপ ‘বি নেগেটিভ’। জরুরি ভিত্তিতে প্রচুর রক্তের প্রয়োজন হওয়ায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ইতোমধ্যেই তার জন্য রক্ত সংগ্রহ করেছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, হাদির অবস্থার দ্রুত অবনতি হচ্ছিল। তার শরীর থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। মাথা ছাড়া কানের পাশেও গুলির আঘাত পাওয়া গেছে। ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের আবাসিক সার্জন ডা. মোশতাক আহমেদ বলেন, ওসমান হাদিকে যখন জরুরি বিভাগে আনা হয়, তখন তার অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক ছিল। একই সঙ্গে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হওয়ায় তাকে সিপিআর দেওয়া হয়। হাদিকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সটি সন্ধ্যা ৭টা ৩৫ মিনিটে এভারকেয়ার হাসপাতালের উদ্দেশে ঢামেক ত্যাগ করে। পরিচালক আরও জানান, তার (হাদি) মাথায় বুলেটের আঘাত আছে। বুকে ও পায়েও আঘাত আছে। ধারণা করা হচ্ছে পায়ের আঘাতটা রিকশা থেকে পড়ে গিয়ে হতে পারে। আমরা ঢাকা মেডিকেলে একটা প্রাথমিক সার্জারি (অস্ত্রোপচার) করেছি। 

এদিকে হাদির ওপর গুলির ঘটনার পরপরই ঘটনাস্থলে ছুটে যায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিভিন্ন ইউনিট ও ক্রাইমসিন। তারা রশি দিয়ে ঘিরে রাখে ঘটনাস্থল। র‌্যাব, পুলিশ ও ডিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আশপাশের এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেন। ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করেন সিআইডি ক্রাইমসিনের সদস্যরা। 

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী যুগান্তরকে বলেন, হাদির ওপর হামলার ঘটনায় জড়িত সন্ত্রাসীদের আটক করতে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়েছে। সন্ত্রাসীরা যেখানেই লুকিয়ে থাকুক, তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে। এজন্য পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাব এবং গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা কাজ করছে।

ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য মোহাম্মদ ওসামা জানান, একটি মোটরসাইকেলে করে আসা দুজনের মধ্য থেকে একজন ওসমান হাদির ওপর গুলি চালায়। তার দাবি, এই দুজন কিছুদিন আগে ওসমান হাদির প্রচারণার টিমে যোগ দিয়েছিল। মাঝখানে কিছুদিন তাদের দেখা যায়নি। কয়েকদিন আগে তারা আবার এসে প্রচারণার কাজে যোগ দেয়। আমরা তাদের বিষয়ে তখন কিছুই ধারণা করতে পারিনি। 

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গুলির ঘটনা ঘটে পল্টন ডিআর টাওয়ার ও বাইতুস সালাম জামে মসজিদের মাঝামাঝি সড়কে। ডিআর টাওয়ারের নিরাপত্তাকর্মী সাকিব হোসেন বলেন, ‘যখন গুলি চলে তখন আমি ভবনের ভেতরে ছিলাম। শব্দ শুনে দ্রুত রাস্তায় গিয়ে দেখি একটি রিকশায় তাকে (হাদিকে) নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ সময় রাস্তায় রক্ত ঝরছিল।’

সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় যাচ্ছিলেন হাদি। এ সময় পিছু নেয় একটি মোটরসাইকেল। রিকশাটির ডান পাশ ঘেঁষে যাওয়ার সময় মোটরসাইকেলের পেছনে বসা দুই যুবকের একজন হাদিকে লক্ষ্য করে গুলি করে। সঙ্গে সঙ্গে মোটরসাইকেলটি দ্রুত ওই স্থান ত্যাগ করে।

পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ ইনচার্জ ডা. মেহেদী হাসান বলেন, ‘সিটি স্ক্যান দেখলাম-আর্টিফ্যাক্ট আছে। অন অ্যারাইভাল, কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট সারভাইভ করছে। এখন, ব্রেন ডেথের সব ফিচার আছে। তবু ডাক্তাররা একটা ডেসপারেট অ্যাটেমপ্ট হিসাবে ক্রেনিয়েকটমি (ব্রেনের খুলি খুলে রাখা) করছেন। তবে, চান্স নেই বললেই চলে। জুলাইতে এ ধরনের কিছু পেসেন্ট পেয়েছিলাম। আফসোস! জুলাই শেষ হলেও জুলাই যোদ্ধাদের ব্রেনে বুলেট ঢোকা বন্ধ হয়নি।’ 

জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে হাদির জীবন রক্ষার জন্য দেশবাসীর দোয়া চাইলেন চিকিৎসকও : আমাদের হাজারীবাগ প্রতিনিধি জানান, শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে ঢামেক হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. জাহিদ রায়হান সাংবাদিকদের বলেছেন, গুলিটি মাথার ভেতর দিয়ে ক্রস করে গেছে। এতে ম্যাসিভ ব্রেন ইনজুরি হয়েছে এবং ব্রেইন স্টেমেও আঘাত লেগেছে। বর্তমানে তাকে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসে রাখা হয়েছে। জীবনের ন্যূনতম চিহ্ন এখনো আছে, তিনি পুরোপুরি নিস্তেজ হননি। তবে অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন। আমরা নিশ্চয়তা দিয়ে কিছু বলতে পারছি না। ডা. জাহিদ আরও জানান, বামদিকে যেখানে গুলিটি বের হয়েছে, সেই অংশের খুলির হাড় অপসারণ করে মস্তিষ্কের চাপ কমানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। মাথার ভেতরের রক্ত ও জমে থাকা ফ্লুইড অপসারণ করা হয়েছে। ক্রমাগত চাপ এবং ব্লিডিংয়ের কারণে অবস্থার ওঠানামা হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাদির বাম কান দিয়ে গুলি ঢুকেছে এবং ডান দিকে বের হয়েছে। খুলি খোলা রয়েছে এবং মগজের ক্ষতিগ্রস্ত অংশ থেকে চাপ কমানো হয়েছে। ভেতরের রক্তপাতও নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। কিছু সময় হেমোডাইনামিকালি স্টেবল থাকলেও চাপ ওঠানামা করছে। নাক ও গলা দিয়ে ব্লিডিং শুরু হলে ইএনটি সার্জনরা তা ম্যানেজ করেছেন। ডা. জাহিদ আরও বলেন, হাদির নিজস্ব শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্ষমতা এখনো আছে। কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসে তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। তবে অবস্থা খুবই ক্রিটিক্যাল। জীবন রক্ষার জন্য দেশবাসীর দোয়া প্রয়োজন।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী মো. সায়েদুর রহমান জানান, হাদিকে ঢামেকে আনার সময় তার জিসি স্কোর ছিল মাত্র ৩। পরে তিনি একবার কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে গিয়েছিলেন। মস্তিষ্কে চাপ বেড়ে যাওয়ায় ডিকম্প্রেশন ও ক্রেনিওটমি করা হয়েছে। তবে অবস্থার দ্রুত ওঠানামার কারণে তাকে স্টেবল রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। তিনি আরও বলেন, আগামী ৭২ ঘণ্টা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এই অবস্থায় কোনো সুস্পষ্ট চিকিৎসা সিদ্ধান্ত দেওয়া বা আশার কথা বলা সম্ভব নয়। সন্ধ্যার পর হাদির নাক ও গলা দিয়ে রক্তপাত শুরু হয়। তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে চিকিৎসকরা তৎপর হন। বর্তমানে তিনি ওষুধের সহায়তায় হিমোডাইনামিকালি স্টেবল আছেন, তবে অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী নয়।

চিকিৎসক দল আরও জানিয়েছে, হাদির বাম দিকের খুলি খুলে রাখা হয়েছে কারণ সেখানে মগজ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মগজ থেকে পানি বের করে চাপ কমানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। নাক ও গলা দিয়ে ব্লিডিং শুরু হলে তা চিকিৎসকরা ম্যানেজ করেছেন। কিছুক্ষণ হেমোডাইনামিকালি স্টেবল থাকলেও পরে আবার অবস্থার ওঠানামা হচ্ছে। জীবনের ন্যূনতম চিহ্ন এখনো আছে, তিনি পুরোপুরি নিস্তেজ হননি। চিকিৎসক দল সংবাদ সম্মেলন করার ১০৫ মিনিটের মধ্যে শরিফ ওসমান হাদিকে আইসিইউ সাপোর্টেড অ্যাম্বুলেন্সে এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়।

ডিএমপির মতিঝিল বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ বলেন, কারা কী কারণে হাদিকে গুলি করেছে তা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। আমরা অপরাধীদের শনাক্তে কাজ করছি।

শুক্রবার জুমার নামাজের আগে বেলা ১১টা ৫২ মিনিটে হাদি ফেসবুকে লেখেন, ‘যেহেতু ঢাকা-৮-এ আমার পোস্টার-ফেস্টুন কিছুই নেই, তাই আমার এখন ছেঁড়াছিঁড়িরও চাপ নেই। দুদকের সামনে থেইকা জুমা মোবারক।’

হাদির একজন সহযোদ্ধা বলেন, জুমার নামাজের পর মসজিদে তাদের লিফলেট বিলির কর্মসূচি ছিল। কথা ছিল লিফলেট বিলি শেষে সবাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জড়ো হয়ে দুপুরের খাবার খাবেন, আলোচনা করবেন। এর মধ্যেই হাদির ওপর হামলার খবর আসে।

এভারকেয়ার হাসপাতালে ভেন্টিলেটরে হাদি : ঢাকা মেডিকেল থেকে এভারকেয়ার হাসপাতালে আনার পর রাত ১১টা পর্যন্ত হাদির সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নেতা ডা. এসএম খালিদুজ্জামান। রাত সাড়ে ১১টার দিকে হাদির সর্বশেষ শারীরিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি যুগান্তরকে বলেন, হাদির সবচেয়ে বড় ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশন ছিল-ব্লাড প্রেসার ও পালস ছিল না, রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। তাকে ভেন্টিলেটরে রাখা হয়েছে। এখন একটা পর্যায় পর্যন্ত আছে। তাছাড়া ব্রেনের ইনজুরি হওয়ায় ইনফেকশনও হতে পারে। মাথার খুলি খুলে রাখা হয়েছে। অন্তত দু’চার দিন না গেলে পরিস্থিতি নিরাপদ বলা যাচ্ছে না।

এছাড়া জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির নেত্রী ডা. তাসনিম জারা যুগান্তরকে বলেন, ‘উনার অবস্থা খুবই ক্রিটিক্যাল। চিকিৎসকরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, আঘাত গুরুতর হওয়ায় ঢাকা মেডিকেলেই আশঙ্কাজনক অবস্থা ছিল। এখানে আনার পরও শঙ্কা কাটছিল না। চিকিৎসকরা দ্রুত আইসিইউতে নিয়ে কিছুটা স্ট্যাবেলাইজ করতে পেরেছেন। আপাতত আইসিইউতেই থাকবেন। তবে আর অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হবে না। ওষুধ, ইনজেকশন ও রক্ত দেওয়ার মাধ্যমে চিকিৎসা চলবে।

তাসনিম জারা বলেন, তার মাথা, বুক ও পায়েও আঘাত লেগেছে। মাথার চেয়ে ব্রেনের আঘাত বেশি ক্রিটিক্যাল। ব্রেনের আঘাতের ফলে চোখেও কিছুটা সমস্যা দেখা দেওয়ার কথা বলছেন চিকিৎসকরা। চিকিৎসায় হেড অব আইসিইউ, নাক কান গলা ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা রয়েছেন। কমবাইন্ড চিকিৎসা চলছে। ভেন্টিলেশন সাপোর্টসহ আইসিইউতে রাখা হলেও পরিস্থিতি এখনো সংকটাপন্ন। 

জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ওসমান হাদি। ২০২৪ সালে ফ্যাসিস্ট আওয়ামীবিরোধী আন্দোলনে গণমানুষের কণ্ঠস্বর ছিলেন তিনি। বিক্ষোভের সময় তার জ্বালাময়ী বক্তৃতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বহু শিক্ষার্থী হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে নামেন। গণ-অভ্যুত্থানের পরও তিনি রাজপথে সক্রিয় রয়েছেন। নভেম্বর মাসে দেশি-বিদেশি ৩০টি নম্বর থেকে বিভিন্ন ধরনের হুমকি পেয়েছেন বলে এর আগে জানিয়েছিলেন হাদি। ১৪ নভেম্বর ফেসবুকে এক পোস্টে তিনি জানিয়েছিলেন, তাকে হত্যা, তার বাড়িতে আগুনসহ তার মা, বোন ও স্ত্রীকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়েছে। ওসমান হাদি ওইদিন আরও লিখেছিলেন, গত তিন ঘণ্টায় আমার নম্বরে আওয়ামী লীগের খুনিরা অন্তত ৩০টা বিদেশি নম্বর থেকে কল ও টেক্সট করেছে। যার সামারি হলো-আমাকে সর্বক্ষণ নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। 

রাজধানীর মতিঝিল, শাহজাহানপুর, পল্টন, রমনা ও শাহবাগ থানা এলাকা নিয়ে গঠিত ঢাকা-৮ আসন। ওসমান হাদি ছাড়া এই আসনে বিভিন্ন দল থেকে যারা প্রার্থী হয়েছেন তাদের মধ্যে আছেন-বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। তিনি বিকাল ৪টার দিকে হাদিকে দেখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে তোপের মুখে পড়েন। জামায়াত থেকে এ আসনে ভোটের প্রস্তুতি নিচ্ছেন দলের নায়েবে আমির হেলাল উদ্দিন। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে সেখানে মনোনয়ন পেয়েছেন দলের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর ওসমান হাদির হাত ধরে গড়ে ওঠে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম ‘ইনকিলাব মঞ্চ’। ‘সব ধরনের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণ’ সংগঠনটির ঘোষিত লক্ষ্য। 

রাত সাড়ে ৮টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা, রাত ৯টায় বিএনপি মনোনীত ঢাকা-১৪ আসনের সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী সানজিদা ইসলাম তুলি ওসমান হাদিকে দেখতে আসেন। রাত ৯টা ৫৭ মিনিটে অন্তর্বর্তী সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা ফওজুল কবির খান, পরিবেশ ও তথ্য সম্প্রচার উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান, সংস্কৃত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান দেখতে আসেন। রাত ৮টা ৫ মিনিটে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে আইসিইউ সংবলিত বিশেষ অ্যাম্বুলেন্সে করে ওসমান শরিফ হাদিকে বসুন্ধরার এভারকেয়ার হাসপাতালে আনা হয়।


Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম