নানকের রেফারেন্সে হন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা
আ.লীগ নেতা ও মন্ত্রীদের ‘কাছের লোক’ ফয়সাল
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ঢাকা-৮ আসনে স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্য প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদিকে গুলির ঘটনায় নাম আসা ফয়সাল করিম মাসুদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের। দলটির বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা-মন্ত্রীর ‘কাছের লোক’ হিসাবে পরিচিত ছিলেন ফয়সাল। তার পুরো নাম ফয়সাল করিম দাউদ খান। নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের এই সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আসাদুজ্জামান খান কামালের ঘনিষ্ঠ অনুসারী। আওয়ামী লীগ আমলে দুবারের সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গেও তার একাধিকবার দেখা করার ছবি রয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তার প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও অংশ নিতেন তৎকালীন প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। সেসময় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরেও তার নিয়মিত যাওয়া-আসা ছিল। এসব পরিচিতি ও পরিচয়কে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে মোহাম্মদপুর-আদাবর এলাকায় চালাতেন নানা অপকর্ম। দলীয় সূত্র এবং দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
শুরু থেকেই নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিল ফয়সালের। ২০১৮ সালের ১১ ও ১২ মে ছাত্রলীগের ২৯তম জাতীয় সম্মেলনে রেজওয়ানুল হক চৌধুরী সভাপতি ও গোলাম রাব্বানী সাধারণ সম্পাদক হন। এর প্রায় এক বছর পর ২০১৯ সালের ১৩ মে ৩০১ সদস্যবিশিষ্ট বিভিন্ন পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হলে এতে ১২ সদস্যের মধ্যে ৩ নম্বরে ছিল ফয়সাল করিম দাউদ খানের নাম।
ছাত্রলীগের ওই কমিটির এক সহ-সম্পাদক নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে জানান, হাদিকে গুলি করা ফয়সাল করিম মাসুদ ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সদস্য ফয়সাল করিম দাউদ খান একই ব্যক্তি। তিনি জাহাঙ্গীর কবির নানকের রাজনীতি করতেন। মোহাম্মদপুর ও আদাবরে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের কাছেও ফয়সাল নানকের ঘনিষ্ঠ হিসাবে পরিচিত। নাককের রেফারেন্সেই ফয়সাল তখন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কমিটিতে জায়গা পান বলেও জানান তিনি।
এদিকে ওসমান হাদিকে গুলির ঘটনায় নাম আসার পর ফয়সাল করিমের সঙ্গে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এবং ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কিছু নেতার ছবি ফেসবুকে প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসনভিত্তিক নির্বাচন পরিচালনা ও সমন্বয়ক কমিটি করেছিল কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। ঢাকা-১২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। ওই আসনে ছাত্রলীগের সমন্বয়ক কমিটির সদস্য ছিলেন ফয়সাল করিম।
যোগাযোগমাধ্যম লিংকডইনে ফয়সাল করিমের নামে প্রোফাইল আছে। সেখানের তথ্য অনুযায়ী, ফয়সাল ২০১৩ সালে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করেন। পরে আরেকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করেন। এছাড়া তিনি নিজেকে অ্যাপল সফট আইটি, ওয়াইসিইউ টেকনোলজি ও এনলিস্ট ওয়ার্ক নামে তিনটি প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসাবে উল্লেখ করেন। ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের একটি সূত্র জানায়, লিংকডইনেই ওই অ্যাকাউন্টটি ফয়সাল করিম মাসুদের।
অন্যদিকে ২০১৬ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে ‘ব্যাটল অব ৭১’ নামে একটি কম্পিউটার গেম তৈরি করেছিল ফয়সাল করিমের মালিকানাধীন ওয়াইসিইউ টেকনোলজি লিমিটেড। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সহযোগিতা এবং সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের পৃষ্ঠপোষকতায় ওই গেম তৈরি করা হয়। ওই বছরের নভেম্বরে ওই গেমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বেসিসের তৎকালীন সভাপতি এবং পরে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সদস্য ছিল ফয়সাল করিম। হাদিকে গুলির ঘটনার পর তার সদস্যপদ স্থগিত করা হয়েছে বলে যুগান্তরকে জানান বেসিসের প্রশাসক যুগ্মসচিব মো. হাফিজউল্লাহ খান।
জানা যায়, ফয়সাল করিম মাসুদ ঢাকার আদাবর থানাধীন পিসিকালচার হাউজিং সোসাইটিতে (বাসা নং-৪১, রোড নং-০৯) বসবাস করতেন। ফয়সাল ও তার সহযোগী নবোদয় হাউজিংয়ের একটি ক্লাবে আড্ডা দিতেন।
অপর একটি সূত্র জানায়, চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের সময়ও আন্দোলনকারীদের দমনে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের সঙ্গে মাঠে ছিলেন। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর তাদের মধ্যে কেউ কেউ গা-ঢাকা দেন। কেউ আবার নতুন বেশ ধরে চলাফেরা করতেন। ফয়সালও নিজের ভোল পালটে ফেলেন। তবে তার অপকর্ম বন্ধ ছিল না। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকার আদাবরে বাইতুল আমান হাউজিং সোসাইটি এলাকায় ব্রিটিশ কলাম্বিয়া স্কুলের চতুর্থ তলায় অফিসে অস্ত্রের মুখে ১৭ লাখ টাকা লুটের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় আদাবর থানায় একটি মামলা হয়েছিল। ওই মামলার প্রধান আসামি ছিলেন ফয়সাল করিম। মামলা হওয়ার কিছুদিন পর ৭ নভেম্বর আদাবর এলাকা থেকে ফয়সাল করিমকে গ্রেফতার করেছিল র্যাব। তখন তার কাছ থেকে দুটি বিদেশি পিস্তল, দুটি ম্যাগাজিন, পাঁচটি গুলি, তিনটি মোবাইল ফোন ও পাঁচ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়েছিল। ওই মামলায় ১৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট থেকে জামিন পান ফয়সাল। জামিনের সময়সীমা বাড়াতে ১২ আগস্ট আবারও আবেদন করলে হাইকোর্ট নতুন করে তার এক বছরের জামিন মঞ্জুর করেন। জামিনে থাকা অবস্থায় এবার তার বিরুদ্ধে ওসমান হাদিকে গুলি করার অভিযোগ এলো।
এদিকে ফয়সালের গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনি উপজেলার কেশবপুর ইউনিয়নের কেশবপুর ডিগ্রি কলেজসংলগ্ন ২ নম্বর ওয়ার্ডের হুমায়ুন কবির ওরফে মালেক ও হাসি বেগম দম্পতির ছেলে। ফয়সালের বাবা ও চাচারা পাঁচ ভাই। এর মধ্যে হুমায়ন কবির চতুর্থ। গ্রামে ফয়সালের ছোট চাচা সেলিম হাওলাদার পৈতৃক ভিটায় বসবাস করেন। গ্রামবাসী জানান, ফয়সালের বাবা হুমায়ন কবির প্রায় ৪০ বছর আগে কাজের সন্ধানে ঢাকায় পাড়ি জমান। তার বৃদ্ধ বাবা-মা মারা যাওয়ার খবর পেয়েও গ্রামে আসেননি। কয়েক বছর আগে হুমায়ন কবির পৈতৃক সূত্রে পাওয়া জমি বিক্রি করার জন্য এসেছিলেন।
জমি বিক্রি করে আবার চলে যান। এখানে এখন তার ঘরবাড়ি কিছু নেই।
ফয়সালের চাচি ও সেলিম হাওলাদারের স্ত্রী মিনারা বেগম সাংবাদিকদের বলেন, ফয়সালকে জম্মের পর থেকে কখনো দেখিনি। তারা ঢাকায় বসবাস করে। কোনো মায়ের সন্তানকে ফয়সাল গুলি করবে, এটা মেনে নেব না। ওসমান হাদিকে যেভাবে ফয়সাল গুলি করেছে, ঠিক তাকেও সেভাবে গুলি করা হোক।
কেশবপুর ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের মেম্বার জাহিদ হোসেন বলেন, হুমায়ন কবির অনেক আগেই গ্রাম ছেড়ে চলে গেছেন। ঢাকায় গিয়ে তিনি বিয়ে করেছেন। গ্রামের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই।
বাউফল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ফয়সালের স্থায়ী ঠিকানা উপজেলার কেশবপুর এলাকায় খোঁজ নিয়ে তেমন কিছু জানা যায়নি। অনেক বছর আগে ওরা এলাকা ছেড়ে যায়। এখানে ওদের থাকার কোনো ঘরও নেই। প্রায় ১ যুগ আগে পৈতৃক বসতঘরটিও ফয়সালের বাবা বিক্রি করে নিয়ে গেছেন। তবে ফয়সালের গ্রামের বাড়িতে পুলিশের নজরদারি রয়েছে। ১২ ডিসেম্বর রাজধানীর বিজয়নগরের বক্স কালভার্ট এলাকায় প্রকাশ্যে ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্য প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়।
