আবাদি জমিতে পুকুর খননে বাধা
রাজশাহীতে ভেকুর চাকায় পিষে তরুণকে হত্যা
রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশ: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আহমেদ জুবায়ের
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলায় আবাদি জমিতে অবৈধভাবে পুকুর খননে বাধা দেওয়ায় ভেকুর (এক্সকেভেটর) চাকায় পিষে এক তরুণকে হত্যা করা হয়েছে। বুধবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে উপজেলার ধুরইল ইউনিয়নের বড় পালশা বিলে গ্রামের শতাধিক মানুষের সামনে বর্বর ও মর্মান্তিক এই ঘটনা ঘটে। এ সময় ভেকু ও স্থানীয় এক বিএনপি নেতার মোটরসাইকেলে আগুন দেন ক্ষুব্ধ জনতা। পুলিশ ভেকু চালককে আটক করেছে। নিহত তরুণ আহমেদ জুবায়ের (২৩) ওই গ্রামের রফিকুল ইসলামের ছেলে। আটক ভেকুচালক আব্দুল হামিদের (২৮) বাড়ি টাঙ্গাইল জেলায়। ভেকুর মালিকের বাড়িও টাঙ্গাইলে বলে জানা গেছে।
স্থানীয়রা জানান, গ্রামবাসীর আপত্তি সত্ত্বেও মোহনপুরের ধুরইল ইউনিয়ন বিএনপির সহ-সাধারণ সম্পাদক আনিসুজ্জামান বকুলসহ কয়েকজন শতাধিক বিঘা জমি ঘিরে জোর করে পুকুর খনন শুরু করেছিলেন। উপজেলা বিএনপির আরেক প্রভাবশালী নেতার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এ কার্যক্রম চলছিল।
বৃহস্পতিবার সকালে নিহত আহমেদ জুবায়েরের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির সামনে কবর খননের প্রস্তুতি চলছে। এ সময় তার স্ত্রী নুসরাত জাহান মোহনা আক্তার জুঁই কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, তার স্বামীর ওপর ভেকুর চাকা তুলে দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা আল-আমিন হোসেন। তিনি জানান, কয়েক দিন ধরেই গ্রামবাসী শুনছিলেন, বকুলসহ কয়েকজন তাদের জমিতে জোর করে পুকুর কাটবেন। গ্রামবাসী এর বিরোধিতা করলে তাদের চোখ এড়াতে উলটো পথে রাতে ভেকু নামানো হয়। বিষয়টি টের পেয়ে গ্রামের লোকজন মসজিদে গিয়ে মুয়াজ্জিনের মাধ্যমে মাইকে ঘোষণা দেন-যারা নিজেদের জমি রক্ষা করতে চান, তারা যেন দ্রুত বিলে নেমে যান। ঘোষণার পর গ্রামবাসী দলে দলে জমির দিকে ছুটে যান। প্রথম দিকের দলে আহমেদ জুবায়েরও ছিলেন।
আল-আমিন হোসেন বলেন, তারা গিয়ে দেখেন খগেন নামের এক ব্যক্তির জমিতে খনন শুরু হয়েছে। তখন গ্রামবাসী ভেকু চালককে কাজ বন্ধ করতে বলেন। কিন্তু চালক থামেননি। লোকজন এগিয়ে যেতে চাইলে ভেকুর বাকেট চারপাশে ঘোরাতে থাকেন, যাতে কেউ কাছে আসতে না পারে। এ সময় বাকেট জুবায়েরের মাথায় আঘাত করে। তিনি মাটিতে পড়ে গিয়ে পালাতে চাইলে ভেকু তার শরীরের ওপর তুলে দেওয়া হয়। পরে স্থানীয়রা গুরুতর আহত অবস্থায় জুবায়েরকে উদ্ধার করে মোহনপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনার পর গ্রামবাসী ভেকু চালককে আটক করে রাখেন। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে তাকে হেফাজতে নেয়।
রাতে ঘটনাস্থলে যান বিএনপি নেতা আনিসুজ্জামান বকুল। গ্রামবাসীর তোপের মুখে পড়ে তিনি মোটরসাইকেল ফেলে পালিয়ে যান। এ সময় ক্ষুব্ধ জনতা তার মোটরসাইকেল ও ভেকুতে আগুন ধরিয়ে দেন।
স্থানীয় কৃষক আব্দুল মোমিন বলেন, তারা কেউ পুকুর কাটতে বলেননি। তারা ধান চাষ করতে চান, মাছ চাষ নয়। বিনা অনুমতিতে কেন তাদের জমিতে পুকুর কাটা হচ্ছে, সেই প্রশ্ন তোলেন তিনি। তার মতে, ১০০ বিঘা জমিতে পুকুর খনন করতে হলে কোটি টাকা খরচ হয়। এই বিপুল অর্থ কে দিচ্ছে, তা তদন্ত হওয়া জরুরি।
এ বিষয়ে বিএনপি নেতা আনিসুজ্জামান বকুলের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে একজন ফোন রিসিভ করে রং নাম্বার বলে কেটে দেন। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পুকুর খননের সঙ্গে রাকিবুল মাস্টার নামের একজনও যুক্ত। আর ভেকু সরবরাহ করেছেন রাজশাহীর খড়খড়ি এলাকার ব্যবসায়ী উজ্জ্বল হোসেন। জানতে চাইলে উজ্জ্বল বলেন, এ বিষয়ে রাকিবুল মাস্টারই ভালো বলতে পারবেন। রাকিবুল মাস্টারের সঙ্গেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
বৃহস্পতিবার সকালে ঘটনাস্থলে যান ধুরইল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক কাজিম উদ্দিন এবং ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ইলিয়াস হোসেন। কাজিম উদ্দিন বলেন, দলের নাম ভাঙিয়ে এ ধরনের অপকর্ম কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। বকুল একা নন, তার উপরেও কেউ রয়েছে। সবাইকে খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নিতে হবে। ইলিয়াস হোসেন বলেন, যারা এর সঙ্গে যুক্ত, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এমনকি তিনি নিজে জড়িত থাকলেও যেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়, সেই দাবি জানান।
মোহনপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এসএম মঈনুদ্দীন বলেন, স্থানীয়রা যাদের নাম বলছে, তাদের বিষয়ে তিনি এখনো বিস্তারিত জানেন না। ঘটনাস্থল থেকে শুধু ভেকুচালককে আটক করা হয়েছে। মামলা হলে আসামিদের বিষয়ে বিস্তারিত জানানো যাবে।
