Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

বেশির ভাগ শর্ত বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী

বিদ্যুতের চুক্তি পর্যালোচনা করতে আদানিকে চিঠি

Icon

শাহেদ সিদ্দিকী

প্রকাশ: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিদ্যুতের চুক্তি পর্যালোচনা করতে আদানিকে চিঠি

বিদ্যুৎ বিক্রির চুক্তি পর্যালোচনা করতে ভারতের আদানি গ্রুপকে চিঠি দিয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। গত সপ্তাহে আদানিকে দেওয়া এক চিঠিতে পিডিবি জানিয়েছে, আদানির বিদ্যুতের দাম বেশি এবং চুক্তির বিভিন্ন শর্ত বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী। ভারতীয় ব্যবসায়ী গ্রুপ আদানির সব বিল বিরোধপূর্ণও বলে উল্লেখ করা হয় চিঠিতে। তাই এ মুহূর্তে আদানির সঙ্গে যত লেনদেন করা হচ্ছে তা পর্যালোচনা করা দরকার। এমনকি চুক্তিও। চিঠিতে আরও বলা হয়, আদানির বহুল আলোচিত চুক্তি, বিদ্যুৎ বিক্রির বিল ও ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং বিদ্যুৎ খাতের চুক্তি পর্যালোচনা কমিটি। সুতরাং আদানির পাওনা বা লেনদেন নিয়ে আপাতত কোনো দায়-দায়িত্ব নেবে না পিডিবি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পিডিবির এ চিঠির পর সরকারের সঙ্গে ভারতীয় বৃহৎ ব্যবসায়ী গ্রুপ আদানির সম্পর্ক কোথায় গিয়ে ঠেকে তা এখন দেখার বিষয়।

পিডিবির চেয়ারম্যান রেজাউল করিম যুগান্তরকে চিঠি দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করলেও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ফওজুল কবীর খান রোববার যুগান্তরকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার আমলের বিভিন্ন চুক্তি খতিয়ে দেখা হয়েছে। এরপর সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চুক্তি পর্যালোচনা করতে আদানিকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, জ্বালানি উপদেষ্টা, অ্যাটর্নি জেনারেল এবং বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে নানাভাবে পর্যালোচনা করে আদানিকে চিঠিটি দেওয়া হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত আদানি এ চিঠির কোনো জবাব দেয়নি বলে জানা গেছে। এ ব্যাপারে মন্তব্য জানতে আদানিকে ইমেইল দেওয়া হলেও তার কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

ভারতের আদানি গ্রুপের ১৬০০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বেশ আলোচিত। বিদ্যুৎ বিক্রি, ক্যাপাসিটি চার্জ এবং কয়লার দাম ও বিভিন্ন শর্তসহ আদানির সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি ব্যাপকভাবে সমালোচিত। বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী এ কোম্পানির পুরো বিদ্যুৎ নিতে হবে সরকারকে। না নিলেও মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ ছাড়া বিভিন্ন চার্জের বোঝা চাপবে সরকারের ঘাড়ে। ভারতের ঝাড়খণ্ডে বসানো এ প্ল্যান্ট বা কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহের চুক্তি বৈষম্যমূলক এবং বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিকর বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ কারণে আদানির চুক্তিটি দেশের স্বার্থবিরোধী বলে মনে করেন অনেকে। গত বছর ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তনের পর আদানির চুক্তিটি আবারও আলোচনায় আসে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও দায়িত্ব নেওয়ার পর জানিয়ে দেয়-তারা চুক্তিটি পর্যালোচনা করবে। তবে এ ব্যাপারে চিঠি দিয়ে এই প্রথম আদানির চুক্তি পর্যালোচনার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী এবং ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এম তামিম এ ব্যাপারে যুগান্তরকে বলেছেন, সরকারের এ ধরনের চিঠি দেওয়ার উদ্যোগটি ভালো। কারণ চুক্তি এবং বিদ্যুতের দাম নিয়ে আদানির সঙ্গে বসে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা উচিত। কেননা আদানির সঙ্গে করা চুক্তি মানতে গিয়ে বাংলাদেশ বেকায়দায় আছে। ওই চুক্তি বাংলাদেশের জন্য ভালো হয়নি। সুতরাং আলোচনাই সমাধান বলে মনে করি।

সরকারি কর্মকর্তারা জানান, ২০১৬ সালের জুলাইতে ১৬০০ মেগাওয়াটের একটি কয়লাভিত্তিক প্ল্যান্ট বসাতে আদানি আবেদন করে। এজন্য সমঝোতা সই হয় ওই বছরের ১১ আগস্ট। তবে আদানির প্ল্যান্টের দুটি ইউনিটের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় ২০২৩ সালের জুনে। আদানি এখন দৈনিক ১ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। সরকারি হিসাবে ২০২৩ সালের জুন থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আদানিকে বিদ্যুতের বিল দেওয়া হয়েছে ২ দশমিক ৩৩১ বিলিয়ন ডলার। তবে এর বাইরে এখনো ৩৫০ মিলিয়ন ডলারের বিল বিরোধপূর্ণ বিল হিসাবে জমা আছে পিডিবির কাছে।

সূত্র জানায়, প্রতি মাসে আদানির বিল হয় ১০০ মিলিয়ন ডলার বা ১ হাজার ২শ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে কাপাসিটি চার্জ হিসাবে দিতে হয় ৪৫০ কোটি টাকার বেশি।

জানা গেছে, আদানিকে চিঠি দেওয়ার আগে চুক্তির বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করা হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, পিডিবি ভারতের বেসরকারি কোম্পানির কাছ থকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কিনছে ৮ টাকা ৬০ পয়সায়। সেখানে আদানির বিদ্যুতের দাম পড়ছে প্রতি ইউনিট ১৪ টাকা ৮৬ পয়সা। শুধু তাই নয়, দেশের সব কয়লাভিত্তিক আইপিপির প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় দাম পড়ে ১১ দশমিক ৭৫ সেন্ট। সেখানে আদানির প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পিডিবিকে দিতে হয় ১২ সেন্টের বেশি।

কয়লার দামেও একইরকম খেসারত দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পায়রা ১২৪৪ মেগাওয়াট কেন্দ্রের কয়লার মূল্য পিডিবি দিয়েছে গড়ে প্রতিটন ৭৬ দশমিক ১৬ ডলার, বাংলাদেশ-ভারত ১২৩৪ মেগাওয়াট মৈত্রী কেন্দ্রের কয়লার দাম প্রতিটন ৭৩ দশমিক ৮৪ ডলার এবং এস আলম গ্রুপের ১২২৪ মেগাওয়াটের এসএস পাওয়ারের কেন্দ্রের কয়লার দাম ৭১ দশমিক ৪৯ ডলার, বরিশাল কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রের কয়লার দাম প্রতিটন ৭৫ দশমিক ৩৮ ডলার। সেখানে আদানির কয়লার দাম পিডিবিকে দিতে হয়েছে প্রতিটন ৭৬ দশমিক ৯১ ডলার।

এদিকে কয়লার দাম নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছে পিডিবির সঙ্গে। সরকারি এ সংস্থা বলছে, আদানি তার চুক্তির বাইরে কয়লার দাম বেশি নিচ্ছে। এতে করে আদানিকে বিল দিতে হচ্ছে বেশি। কয়লার দাম নিয়ে বিরোধে এ পর্যন্ত ২৫০ মিলিয়ন ডলারের বেশি দাবি করেছে আদানি। গত নভেম্বরে আদানি কয়লার দামের বিরোধ নিয়ে পিডিবির বিরুদ্ধে অভিযোগ করে সিঙ্গাপুরের আন্তর্জাতিক আদালতে। সেখানে কয়লার দামের বিরোধ মীমাংসা করতে বাংলাদেশ সরকারের একজন প্রতিনিধি নিয়োগ করতে চিঠি দেওয়া হয়েছে পিডিবিকে। কিন্তু এ ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি সরকার।

পিডিবি সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিভাগকে জানিয়েছে, গত দুই অর্থবছরে (২০২৩-২০২৪ এবং ২০২৪-২০২৫) আদানিকে বিল দেওয়া হয়েছে ২৪ হাজার ৮০ কোটি ৩৯ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। এতে করে আদানির বিদ্যুৎ বিক্রি করে লোকসান হয়েছে ১৪ হাজার কোটি টাকা। উল্লেখ্য, বেসরকারি সব বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম বিদ্যুৎ বিক্রির (সাধারণ গ্রাহকের কাছে) চেয়ে বেশি হলে তা ভর্তুকি হিসাবে পিডিবিকে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। কিন্তু আদানির বিদ্যুতের ক্ষেত্রে কোনো ভর্তুকি দেওয়া হয় না। ফলে এই লোকসানের বোঝা পিডিবির হিসাবের খাতায় যুক্ত হয়। তবে এটিও প্রকারান্তরে শেষ পর্যন্ত জনগণের ট্যাক্সের পয়সা দিয়ে সমন্বয় করতে হবে।

বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ দিতে গড্ডায় আদানি ২ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে ১৬০০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র বসানো হয়েছিল। এর আগে ২০১৬ সালের জুলাইতে ওই কেন্দ্র বসাতে আদানি আবেদন করে। এজন্য সমঝোতা সই হয় ২০১৬ সালের ১১ আগস্ট। এর মধ্যে বাংলাদেশের পরিবেশ ছাড়পত্র নেয় ৩১ আগস্ট ২০১৭ সালে। ২০২৩ সালের এপ্রিলে ৮০০ মেগাওয়াটের প্রথম ইউনিট এবং একই বছরের জুনে ৮০০ মেগাওয়াটের দ্বিতীয় ইউনিট বাণিজ্যিকভাবে চালু হয়। এ বিদ্যুৎ বাংলাদেশ পর্যন্ত আনতে বগুড়া-রওহানপুর ৪০০ কেভির ১০৪ কিলোমিটারের সঞ্চালন লাইন টানা হয়েছে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম