Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

আমার মায়ের কথা

Icon

রশীদ হায়দার

প্রকাশ: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

‘একুশ’ সম্পর্কে কথা উঠলে, তা যে কোনো আলোচনা অনুষ্ঠান কিংবা সাধারণ আলাপচারিতা অথবা টেলিভিশনে একুশের চেতনা প্রসঙ্গ এলেই আমি আমার মায়ের প্রসঙ্গটি প্রাসঙ্গিকভাবেই বলি। সে কারণেই ২৯ জানুয়ারি সকাল ৮টায় আমাদের পাবনার ‘ছাওয়াল’ শুচি সৈয়দ যখন ফোন করে জানাল- রশীদ ভাই, ‘একুশের চেতনা’ নিয়ে আপনাকে একটা লেখা লিখতে হবে।’

জিজ্ঞেস করি, ‘চেতনা’ বলতে কী বোঝাতে চাস?

শুচি আমার চেতনা জাগানোর জন্য একটা ছোটখাটো ‘ভাষণ’ দিয়ে দিল। আমার চোখে তখনও কিছুটা ঘুম চেপে আছে। ওর কথা কিছু বুঝলাম, কিছু না বুঝেই হ্যাঁ হুঁ করে কাটিয়ে দেয়ার পর সহসাই মনে পড়ে, আমার মা-ই তো স্বয়ং একুশের চেতনার মূর্তপ্রতীক। মা যখন প্রতিক্রিয়াটি প্রকাশ করেছিলেন তখন একুশের চেতনার বিষয় মাথায় নিয়ে যে বলেছিলেন তা নয়, ’৫২-এর ওই ঘটনার পর যিনি আরও ২৩ বছর বেঁচে ছিলেন, কিন্তু কেন যে অমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন, তা তিনি আমৃত্যু স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। আমি যখন ঘটনাটা দেখি, তখন আমার বয়স ১১, পড়ি ক্লাস ফাইভে। ঠিক আগের দিনই ঢাকায় ‘একুশে’র হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে; সারা দেশ, তৎকালীন পূর্ব বাংলায় দিনমানেই মর্মান্তিক ঘটনাটি রাষ্ট্র হয়ে গেলেও ভয়াবহতম ঘটনাটির কথা মা শুনলেন পরদিন, অর্থাৎ ২২ ফেব্রুয়ারি। স্পষ্ট মনে আছে, আমি বাড়ির ভেতরে টিউবওয়েলের কাছেই দাঁড়িয়ে, মা-ও যেন কী করছিলেন, এই সময়ে এক পরিচিতজন আমাদের বাসায় এসে ‘ভয়াবহ’ সংবাদটি জানালেন। বললেন, নূরুল আমীনের পুলিশের গুলিতে এক ছাত্রের মাথার খুলি উড়ে গিয়ে ঘিলু রাস্তায় ছিটকে পড়ে। এ সংবাদ শুনেই মা লাফিয়ে উঠে উঠোনে দমাদম লাথি মেরে বলতে লাগলেন, ‘হারামি নূরুল আমীন, জাহান্নামী নূরুল আমীন, খুনি নূরুল আমীন’ ইত্যাদি। দেখলাম, রাগে ক্ষোভে কাঁপতে কাঁপতে ও চোখের পানি মুছতে মুছতে মা অজু করে ঘরে গিয়ে সেই অচেনা অজানা ছেলেটার জন্য দোয়া করার উদ্দেশ্যে জায়নামাজে বসে গেলেন।

বলেছি, তখন পড়ি ক্লাস ফাইভে। জনতা ছাত্র হত্যার পেছনে আমাদের মাতৃভাষা হত্যার চক্রান্তও যে চলছে তা উপলব্ধি করার মতো বয়স আমার হয়নি। কিন্তু আমার মায়ের প্রতিক্রিয়া ওরকম হল কেন? কোথাকার কোন ছাত্র অমন মর্মান্তিক মৃত্যুবরণ করেছে, তার জন্য আমার ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়া মা কেন এত ক্রুদ্ধ হলেন? কতজনই তো অকালে মর্মান্তিক মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে? ধীরে ধীরে জানতে পারি, ‘একুশ’ কেন ঘটেছিল। এর পেছনে পাকিস্তান সরকার কী পরিকল্পনায় লিপ্ত ছিল এবং এমন একজন বাঙালিকে মন্ত্রিত্ব দিয়ে ব্যবহার করছিল, তা সেই অন্ধ পাকিস্তানি বাঙালি মনে হয় বুঝতেই পারেনি। হয়তো পেরেছে। মন্ত্রিত্বের লোভে মাতৃভাষাকে অপমান করতে তার বিবেক বিন্দুমাত্র কাজ করেনি। সেই বাঙালি রত্নের নাম ফজলুর রহমান। তখন তিনি পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী।

চক্রান্ত কত প্রকার ও কী কী? বাংলা ভাষার বৈশিষ্ট্য, ঐতিহ্য, সম্পদ, স্বকীয়তা ইত্যাদি নষ্ট করা, মূল কথা বাঙালির মুখের ভাষা কেড়ে নেয়া, রবীন্দ্রনাথ নজরুলের বাংলাকে পঙ্গু করার লক্ষ্যে চেষ্টা করা হয় আরবি ভাষায় শিক্ষা চালু করতে, বর্ণমালা ব্যবহার করতে, রোমান হরফে বাংলা চালু করতে যেন মূল বাংলা ভাষাই পাকিস্তানি ভাষার সবচেয়ে বড় শত্রু। কথা আরও আছে, বাংলা ভাষাকে মুসলমানি চরিত্র দেবার জন্য দেশের মানুষের সামনে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে ‘খতনা’ করার মতো ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছিল। অর্থাৎ বাংলাসাহিত্যে হিন্দুঘেঁষা যেসব শব্দ রয়েছে, তাকে মুসলমানিত্ব দেয়ার চেষ্টা যে হয়েছিল তার প্রমাণ তো ‘অগত্যা’ পত্রিকাই দিয়ে দেয়। যেমন- মদন মোহন তর্কালঙ্কারের সেই বিখ্যাত কবিতা ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি’কে ‘অগত্যা’ লিখল তাহলে কী এখন বলতে হবে- ‘ফজরে উঠিয়া আমি দেলে দেলে বলি, সারাদিন আমি যেন ছহি হয়ে চলি।’

লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, ভারত ভাগের আগে বাংলাকে নিয়ে যতটা কাটাছেঁড়া করার চেষ্টা চলেছে, পাকিস্তানি আমলে সে চেষ্টা হয়েছে আরও বেশি। বাংলাকে যেন ধর্ষণ করে কে কত আরবি-ফার্সি-উর্দু শব্দ ব্যবহার করতে পারে, তার সরকারি চেষ্টা ও পৃষ্ঠপোষকতা তো আমরা স্বচক্ষেই দেখলাম। বাংলা ভাষার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, পৃথিবীর নানান দেশের ভাষা বাংলা এমনভাবে আত্মস্থ করে নিয়েছে, বাংলা ভাষার সুগভীর পণ্ডিত ছাড়া সাধারণ ব্যক্তির পক্ষে সেটা আলাদাভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। এতে বাংলার শব্দ সম্ভার সমৃদ্ধ হয়েছে, আমাদের ভাষা আরও জীবন লাভ করেছে।

বললে খারাপ শোনালেও বলতে হবেই- বাঙালিরাই বাংলার বড় শত্রু। ইংরেজ আমলে জাতে ওঠার জন্য একদল ভারতবাসী অ্যাংলো ইন্ডিয়ান হয়ে ইংল্যান্ডকে ‘হোম’ ভাবতে শুরু করে, তেমনি পাকিস্তানি আমলে উর্দুর আধিপত্য হাতেগোনা কিছু বাঙালি আনন্দের সঙ্গে মেনে নিতেও দ্বিধা করেনি। কিন্তু পাকিস্তানিরা কি বাংলা ভাষা শিখতে বা ব্যবহার করতে আন্তরিক আগ্রহ দেখিয়েছে? কখনই নয়। তারা বাংলা শেখেনি, জানেনি। আমরা শিখেছি, জেনেছি। বাড়তি লাভ আমাদের পূর্ববঙ্গবাসীর শব্দ ভাণ্ডারে আরেকটি ভাষা ঢুকল। সেই ভাষাটি উর্দু। রবিশংকর মৈত্রী সঙ্কলিত ‘বাংলা ভাষায় বিদেশি শব্দের ব্যবহার’ বইটি দেখলেই বোঝা যায় আমরা কত শব্দই না আমাদের করে নিয়েছি। গ্রহণ করে ব্যবহার করার সুফল হচ্ছে আমাদের ভাষার শব্দ ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হওয়া। তা হচ্ছে। তবে, পাশাপাশি আরেকটি প্রবণতা প্রবল হয়ে উঠছে। কথাটি আমাকে বলেছিলেন স্বয়ং অন্নদাশঙ্কর রায়। তিনি আটের দশকের মাঝামাঝি কলকাতায় তার বাসায় বলেছিলেন, ‘তোমাদের দেশে যেভাবে কিন্ডারগার্টেন ও ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল গড়ে উঠছে তা কিন্তু বাংলা ভাষার জন্য আশঙ্কাজনক!’ ভবিষ্যৎ ভালো দেখতে পেতেন অন্নদাশঙ্কর রায়। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের মতো দুটো বিশাল ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর অন্নদাশঙ্কর রায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ব্যাপারে যতখানি আশাবাদী-উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন, তা কিন্তু বেশি দিন ধরে রাখতে পারেননি। কারণ, আমাদের ‘জাতে ওঠা’ ও ‘দাসসুলভ’ আচরণ। প্রিয় পাঠক, আপনার কাছেই একটা আবেদন রাখি। যারা ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করে, তারা কতজন বাংলা শিল্পসাহিত্য সংস্কৃতি সম্পর্কে জানে? তারা রবীন্দ্রনাথকে জানে ‘টেগর’ হিসেবে, নজরুলকে চেনে ‘রেবেল পোয়েট’ বলে। বঙ্কিম, মাইকেলের নাম? জানলেও আমি অনেকটা হলফ করে বলতে পারি তাদের লেখা এরা পড়েনি।

আমার অতি সামান্য যেটুকু বিদেশি সাহিত্য পড়া আছে, তাতে বেশ গর্ব করেই বলতে পারি, আমাদের বাংলা সাহিত্যের বেশ কিছু লেখক বিশ্বমানের লেখক হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য। তারা সে স্বীকৃতি পান না, কারণ তাদের সৃষ্টি যথাযথ অনূদিত হয়ে বিদেশিদের কাছে পৌঁছায় না। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে জাগে, আমাদের যারা খুবই ভালো ইংরেজি কিংবা ফরাসি অথবা স্প্যানিশ বা জার্মান জানেন তারা যথাযথ ও আন্তরিকভাবে আমাদের সমৃদ্ধ লেখাগুলো অনুবাদ করবেন, বিশ্ববাসীকে উপহার দেবেন। নইলে একবার যদি পুরোপুরি কূপমণ্ডুকতা পেয়ে বসে, তাহলে কূপের বাইরেও যে বিশাল বিশাল জলাধার আছে, তা আমরা ভুলেই যাব। বাংলাকে শুধু ব্যবহারিক জীবনে নয়, সর্বত্র কার্যকর করলে বিশ্ববাসী আরও আগ্রহী হবে এই ভেবে- দেখি, বাঙালি বিশ্বকে আর কী কী উপহার দিল।

অনুলিখন : শুচি সৈয়দ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম