মামলার ভয়ে কেমিক্যাল সরাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা
২০ ধরনের দাহ্য কেমিক্যাল মজুদে সরকারি নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়নি * সব পক্ষকে ম্যানেজ করে চুটিয়ে ব্যবসা চলছে
তোহুর আহমদ
প্রকাশ: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যাওয়া চুড়িহাট্টার হাজী ওয়াহেদ মঞ্জিলের জীর্ণ পিলারে কে বা কারা সাঁটিয়েছেন এক টুকরো সাদা কাগজ। তাতে লেখা, ‘দৃষ্টি আকর্ষণ, গ্যাস সিলিন্ডার এবং কেমিক্যাল গোডাউন অতি শিগগিরই অপসারণ করা হোক। প্রত্যেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র রাখা বাধ্যতামূলক করা হোক।’
স্থানীয়রা বলছেন, ‘এই দাবি এখন এলাকার মানুষের প্রাণের দাবি। নিমতলী থেকে চুড়িহাট্টার পর আর কোনো এলাকায় এভাবে মানুষ পুড়ে কয়লা হোক তা আমরা চাই না।’
প্রসঙ্গত, চার দিন আগে চুড়িহাট্টায় ৬৭ জন মানুষ পুড়ে কয়লা হওয়ার পর ফের আলোচনায় কেমিক্যালের গোডাউন। যে আলোচনার সূত্রপাত হয়েছিল ৯ বছর আগে ২০১০ সালে নিমতলীর বিয়োগান্তক ঘটনার মধ্য দিয়ে। কিন্তু টনক নড়েনি কারোরই। প্রশাসনের নাকের ডগায় অবৈধ কেমিক্যালের গোডাউন, নকল সুগন্ধি, বৈদ্যুতিক তার ও চোরাই প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবসা চলছে প্রকাশ্যে। অথচ ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি দাহ্য কেমিক্যালের ব্যবসার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিল সরকার। কিন্তু সে নির্দেশনা ১০ বছরেও হালে পানি পায়নি।
সূত্র বলছে, বিস্ফোরক অধিদফতর থেকে জারি করা চিঠিতে বলা হয়, পরিদর্শকের কাছ থেকে ছাড়পত্র নেয়ার পর শুল্ক কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করা ছাড়া ২০ ধরনের কেমিক্যাল আমদানি বা বিপণন করা যাবে না। এগুলো হল- অ্যাসিটোন, বিউটাইল অ্যাসিটোন, আইসো-বিউটানল, ডিএল-২৫৭৫, ইথাইল অ্যাসিট্রেট, ইথানল, হেভি অ্যারোমেটিক, আইসো প্রোপাইল অ্যালকোহল, মিথানল, বিউটাফেন, মিথাইল আইসো, এ-প্রোপাইল অ্যাসিট্রেট, প্রোপেন-১ অল, প্রোপাইলিন গ্লাইকল, টলুইন, থিনার-বি, রিডিউসার/রিটার্ডার, থাইলিন/মিক্সড থাইলিন ও ডাই অ্যাসিটোন অ্যালকোহল।
কিন্তু এসব কেমিক্যাল আমদানি বা বিপণনের নজরদারি এখন সরকারি খাতায় থাকলে বাস্তবে নেই বললেই চলে। শুধু এই বিশ ধরনের কেমিক্যাল নয়। পুরান ঢাকার অলিগলিতে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য কেমিক্যাল গোডাউন। পাশাপাশি আছে প্লাস্টিক পণ্যের কাঁচামাল (দানা), নকল সুগন্ধি থেকে শুরু করে নানা ভেজাল প্রসাধীন তৈরির হরেক উপকরণ। অতি দাহ্য এসব উপকরণ আগুনের সংস্পর্শে এলে কি ভয়াবহ রূপ নেয় তা একবার দেখা দিয়েছিল নিমতলীতে। সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত। এবার ফের সেই ভয়াবহ দৃশ্য ফের দেখা গেল চুড়িহাট্টায়। সবাই বলছেন, যা আমাদের কর্মের ফল। প্রশাসনের দায়িত্বহীনতা। কারণ সরকারের চেয়ে কারও শক্তিশালী হওয়ার সুযোগ নেই।
কেমিক্যাল ব্যবসা ও গোডাউন নিয়ে হৈচৈর মধ্যে শনিবার কেমিক্যাল ব্যবসায়ীরা মিটফোর্ডের ভাণ্ডারি ভবনে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেন। সেখানে নানা আলোচনার এক ফাঁকে উঠে আসে অবৈধ কেমিক্যালের ব্যবসার কথাবার্তাও। ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল ব্যবসা সরিয়ে নেয়ার কথাবার্তাও বলেন। তবে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়, সব ব্যবসায়ীর কাছে বিশেষ সতর্ক বার্তা পাঠানো হবে। তারা যেন যে যার মতো দ্রুত কেমিক্যাল সরিয়ে নেয়। বৈঠকে অংশ নেয়া একজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, আমরা সব ব্যবসায়ীকে বলে দিয়েছি সরকারের তালিকাভুক্ত ২০ ধরনের দাহ্য রাসায়নিকের মজুদ যদি কারও কাছে থাকে তবে রাতারাতি তা সরিয়ে ফেলতে হবে। অন্যথায় পুলিশি ঝামেলা হলে অ্যাসোসিয়েশন থেকে কোনো দায়ভার নেয়া সম্ভব হবে না।
শনিবার দুপুর। ৬৭ প্রাণ বলি হওয়ার ঘটনাস্থল উর্দুরোড সংলগ্ন চুড়িহাট্টা গলি। সরু গলির দু’পাশে চারটি পোড়া ভবন দাঁড়িয়ে আছে কোনোমতে। সিটি কর্পোরেশনের ট্রাক ওয়াহেদ মঞ্জিলের বেজমেন্ট থেকে কেমিক্যালের বিশাল মজুদ সরিয়ে নিচ্ছে অন্যত্র। একের পর এক ট্রাকের সারি আসছে আর বেরিয়ে যাচ্ছে। পুলিশের নিয়ন্ত্রণ সত্ত্বেও শত শত উৎসুক মানুষের জটলা সেখানে।
ভবনগুলোতে দাহ্য কেমিক্যালের মজুদ থাকার কারণে আগুনের তাপমাত্রা ঠিক কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল তা নিরূপণ করতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস। তবে লেলিহান শিখা কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল তা কিছুটা টের পাওয়া যায় রাস্তার অপর পাশের বহুতল মসজিদের দেয়াল দেখলে। অনেকটা দূরে থাকলেও মসজিদের দেয়ালের পলেস্তারা ও টাইলস খুলে খুলে পড়তে থাকে আগুনের তাপে। আশপাশের অনেক ভবনের গ্রিলের জানালা দুমড়ে-মুচড়ে লোহার জঞ্জালে পরিণত হয়। রাস্তার ধারের অনেক দোকানের সার্টার, ভবনের দরজায় লাগানো তালা গলে মিশে যায় মাটির সঙ্গে।
স্থানীয়রা জানান, পুরান ঢাকার প্রায় সব এলাকায়ই এমন অনেক ভবনে অবৈধ কেমিক্যালের গোডাউন রয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় মজুদ মিটফোর্ড এলাকায়। তাই এ প্রতিবেদকের গন্তব্য মিটফোর্ড। রিকশায় চেপে ঘিঞ্জি রাস্তা পেরোনোই দায়। সংকীর্ণ গলির ওপর অবৈধভাবে ৫ তলা ৭ তলা ভবন উঠে গেছে। রাস্তার দু’ধারে নানা পণ্যের পাইকারি দোকান। নাইলনের দড়ি, রশি, বাচ্চাদের প্লাস্টিকের খেলনা, বদনা থেকে পানির জগ, বালতিসহ গৃহস্থালির পণ্য, ছাতা, ইলেক্ট্রিকের তার, আরও কত পণ্য। হাজারও পণ্য থরে থরে সাজানো দোকান।
দিন-রাত হাঁক ডাক চলছে। জীর্ণ অনেক ভবনে দিনের বেলাতেও আলো ঢোকে না অনেক দোকানে। বৈদ্যুতিক আলো জ্বালিয়ে কাজ চলছে। প্লাস্টিকের পণ্য তৈরির কাঁচামাল (দানা), কাপড়ে দেয়া রংয়ের বড় ড্রাম, কালি, সুগন্ধি তৈরির কেমিক্যাল। চকবাজার, লালবাগ, ইসলামপুর, চক সার্কুলার রোড, বেগম বাজার, রাইসা বাজার, বীরেন বোস স্ট্রিট, চক মোগলটুলি, ৩৩ আরমানিটোলা থেকে ৪১ নম্বর গলি পর্যন্ত অসংখ্য দোকানে শুধুই সুগন্ধির কেমিক্যালের ড্রাম থরে থরে সাজানো।
দেখা যায়, বিভিন্ন এলাকায় নানা ধরনের কেমিক্যালের পাইকারি আড়ত তৈরি হয়েছে। যেমন হাটখোলা রোড ও নবাবপুর এলাকায় বিক্রি হচ্ছে সুগন্ধি তৈরির কাজে ব্যবহৃত গ্যাস। ইমামগঞ্জ, আরমানিটোলা, মিটফোর্ড, চকবাজার ও মৌলভীবাজার এলাকায় সুগন্ধি তৈরির বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল। টিকাটুলিতে নানা ধরনের রি-এজেন্ট বিক্রির দোকান। ফরিদাবাদ মিলব্যারাক এলাকায় ফার্নিচার গ্রেডের কেমিক্যাল বিক্রির পাইকারি আড়ত রয়েছে অসংখ্য। নাজিরাবাজার এলাকায় জুতার আঠা, মালিটোলা, আগামসি লেনে প্লাস্টিক পণ্যের কাঁচামাল (দানা), উর্দুরোডের ঢালে, ইসলামবাগেও নানা ধরনের কেমিক্যালের গোডাউন এবং চকবাজারে ডাইস কেমিক্যালের দোকান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
জানা যায়, এ খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন’র সদস্য সংখ্যা এখন প্রায় ৭শ’। তবে এর বাইরে কেমিক্যাল আমদানি করেন এমন ব্যবসায়ীর সংখ্যা আরও প্রায় হাজারের কাছাকাছি। কে কোন ধরনের কেমিক্যাল আমদানি করছেন তার কোনো হিসাব কারও কাছেই নেই। যে যার মতো ব্যবসা করছেন। আবার চোরাইপথে অবৈধ কেমিক্যালের বড় বাণিজ্য হয়। গোপন কারখানায় এসব কেমিক্যালের নানামুখী ব্যবহার হয়।
বাড়ির মালিকদের লালসা : অগ্নিকাণ্ডের পর গণমাধ্যমে কেমিক্যালের গুদাম নিয়ে হৈচৈ হওয়ায় ক্ষুব্ধ স্থানীয় বাড়ির মালিকরা। তারা কিছুতেই চান না এ এলাকা থেকে কেমিক্যাল ও প্লাস্টিকের ব্যবসা অন্য এলাকায় চলে যাক। কারণ পুরান ঢাকার অনেক এলাকায় আবাসিক ভবনগুলো কেমিক্যালের গুদাম হিসেবে ব্যবহার হয়। এতে সাধারণ বাড়িভাড়ার চেয়ে তিন-চারগুণ বেশি টাকা ভাড়া আদায় করা যায়। এমনকি ৫ হাজার টাকা ভাড়ার একটিমাত্র ঘর গুদাম হিসেবে ভাড়া দিলে মাসে ৭০ হাজার টাকাও আয় করা যায়। মূলত বাড়ি মালিকদের বিরোধিতার কারণেই সিটি কর্পোরেশন কেমিক্যাল গুদাম সরানোর উদ্যোগ থেকে বারবার পিছু হটেছে। থানা পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে যেভাবে সুবিধা আদায়ে ব্যস্ত। সরকারের সংশ্লিষ্ট একাধিক সংস্থার কর্তাব্যক্তিরাও দর্শক সারিতে থাকাতেই লাভজনক মনে করে।
র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম যুগান্তরকে বলেন, পুরান ঢাকার চকবাজার, লালবাগ ও মিটফোর্ড এলাকার অন্তত ১২৫টি অবৈধ প্রসাধন কারখানা বন্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু তাদের বেশির ভাগই আবার অন্য এলাকায় গিয়ে ব্যবসা শুরু করেছে। তিনি বলেন, শুধু কেমিক্যালের মজুদ এ এলাকায় আগুনের ঝুঁকি তৈরি করছে তা নয়। এর সঙ্গে আছে অবৈধ প্লাস্টিক, প্রসাধনী ও বৈদ্যুতিক তারের অসংখ্য কারখানা এবং উৎপাদিত পণ্যের মজুদ। এগুলোর তালিকা তৈরির কাজ করছে র্যাব। অচিরেই এ বিষয়ে বড় ধরনের অভিযান চালানো হবে।
স্থানীয় কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের বক্তব্য ভিন্ন। তারা বলছেন, আগুনের ঘটনা প্রতিরোধ করতে গিয়ে গণমাধ্যমে এ খাতের ব্যবসায়ীদের অনেকটা ভিলেন হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এটা ঠিক নয়। তারা বলছেন, সব কেমিক্যাল দাহ্য নয়। নানা ধরনের কেমিক্যালের ব্যবসা রয়েছে পুরান ঢাকায়। প্রসাধনী গ্রেড, ওষুধ গ্রেড, বেকারি গ্রেড, শিল্পে ব্যবহৃত কেমিক্যাল, কাপড়ে ব্যবহৃত কেমিক্যালসহ আরও অনেক গ্রেড। পুরান ঢাকার কেমিক্যাল ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মঞ্জু যুগান্তরকে বলেন, এ এলাকায় আগুন লাগলেই কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের ওপর দোষ চাপানোর প্রবণতা দেখা যায়। এটা কেন। তিনি একটি এয়ার ফ্রেশনারের পোড়া বোতল দেখিয়ে বলেন, এই বোতলটি আমি চুড়িহাট্টায় পোড়া আবর্জনার মধ্য থেকে কুড়িয়ে এনেছি। চুড়িহাট্টায় আগুনের সময় এগুলো বোমার মতো ফুটেছে। কিন্তু এগুলো তো আমদানি করা বোতল। এগুলো এখানে থাকার কথা নয়। সরকারের উচিত বাজারে নয়, বন্দর থেকে আমদানি পণ্যের ওপর নজরদারি বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হাজী আবদুল জলিল যুগান্তরকে বলেন, অযথা আমাদের ওপর দায় না চাপিয়ে সরকার আমাদের নির্দিষ্ট একটা জায়গা করে দিক। আমরা এখান থেকে চলে যাব। তিনি বলেন, নিমতলীর ঘটনার পর কেরানিগঞ্জে আমাদের জন্য একটি জায়গা বরাদ্দ দেয়ার কথা শুনেছিলাম। কিন্তু এখনও সেখানে ব্যবসা স্থানান্তরের কোনো উদ্যোগ সরকারের পক্ষ থেকে দেখা যাচ্ছে না। অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আরিফ হোসেন বলেন, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ থেকে শুরু করে নানা ধরনের কেমিক্যাল নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্য তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়। তাই সরকার যদি আমাদের যথোপযুক্ত জায়গায় ব্যবসার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দেয় তাহলেই এ সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান হতে পারে।
