দগ্ধ ছাত্রীর বক্তব্য: নেকাব বোরকা হাতমোজা পরা ৪ জন আগুন দেয়
সিঙ্গাপুরে পাঠানোর নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর * দেয়া হয়েছে লাইফ সাপোর্ট, এখনও সংকটাপন্ন -বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক * হামলাকারীদের একজনের নাম শম্পা * ওড়না দিয়ে হাত বাঁধার পর আগুনে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা * অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেফতার ১০ * ফেনী জেলা প্রশাসনের তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি
যুগান্তর রিপোর্ট, ফেনী ও সোনাগাজী প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৮ এপ্রিল ২০১৯, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
স্বজনদের আহাজারি। ছবি: যুগান্তর
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ফেনীর সোনাগাজীতে পরীক্ষা কেন্দ্রে অগ্নিদগ্ধ মাদ্রাসা ছাত্রী একজন চিকিৎসককে বলেছেন, ‘নেকাব, বোরকা ও হাতমোজা পরা চারজন ওড়না দিয়ে হাত বেঁধে শরীরে কিছু একটা ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়।
তারা অধ্যক্ষের (সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলা) বিরুদ্ধে করা যৌন হয়রানির মামলা তুলে নিতে চাপ দেয়। এতে অস্বীকৃতি জানালে তারা আগুন দেয়। ওড়নাটি ছাই হওয়ার পর হাতের বাঁধন খুলে যায়।
চার দুর্র্বৃত্তের মধ্য থেকে একজন তার সঙ্গে কথা বলেছে। তারা নিজেদের নাম উচ্চারণ করছিল না। তবে একজন একবার শম্পা বলে অন্যজনকে ডেকেছিল। তবে তাদের কাউকে চিনতে পারিনি।’ লাইফ সাপোর্টে নেয়ার আগে দু’জন সাক্ষীর উপস্থিতিতে ওই ছাত্রী একজন চিকিৎসকের কাছে সোমবার এ জবানবন্দি দিয়েছেন বলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট সূত্রে জানা গেছে।
কোনো ঘটনায় মামলা হলে সংশ্লিষ্ট মুমূর্ষু রোগীর কাছ থেকে সাধারণত এ ধরনের বক্তব্য নেয়া হয়ে থাকে। পরে এ বক্তব্য আদালতে সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে অগ্নিদগ্ধ শিক্ষার্থীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় সোমবার দুপুর পৌনে ১২টার দিকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়েছে। অগ্নিদগ্ধ শিক্ষার্থীকে সিঙ্গাপুর পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বিকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়া ওই ছাত্রীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে দেখতে এসে এ কথা জানান। অপর দিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপন সন্ধ্যায় ওই শিক্ষার্থীকে দেখতে এসে সাংবাদিকদের বলেন, ‘তার শারীরিক অবস্থা সিঙ্গাপুর নেয়ার উপযোগী নয়। তবে আমরা বিষয়টি সিঙ্গাপুর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।’
মাদ্রাসাছাত্রী অগ্নিদগ্ধের ঘটনায় তার ভাই সোমবার দুপুরের পর সোনাগাজী থানায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। পুলিশ এ ঘটনায় ১০ জনকে গ্রেফতার করেছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। এ ছাড়া ঘটনা তদন্তে সোমবার ফেনী জেলা প্রশাসন তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। আগামী তিন দিনের মধ্যে এ কমিটি জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন দেবে।
বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা পাওয়ার পর অগ্নিদগ্ধ ছাত্রীর যাবতীয় কাগজপত্র সিঙ্গাপুর পাঠানো হয়েছে। তারা ‘রেসপন্স’ করলে ওই ছাত্রীকে সিঙ্গাপুর পাঠানো হবে।” তিনি আরও বলেন, ‘ওই ছাত্রী চিকিৎসকদের কাছে বারবার বাঁচার আকুতি জানাচ্ছে। আমি যতবার তাকে দেখতে গিয়েছি, ততবার বলেছে, স্যার আমি বাঁচতে চাই, আমাকে বাঁচান। তার অবস্থা এখনও সংকটাপন্ন। তার খুব শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। কথা বলতে পারছে না। তার বাঁচার সম্ভাবনা ক্ষীণ, তবে আমরা চেষ্টা করছি।’
ফেনী জেলা পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম সরকার যুগান্তরকে বলেন, ‘এ ঘটনায় সোমবার একটি মামলা হয়েছে। ঘটনার তদন্তে পুলিশের একাধিক টিম মাঠে নেমেছে। এরই মধ্যে ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।’ ওই শিক্ষার্থী এবং তার পরিবারের অভিযোগ, ওই ছাত্রী শনিবার সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় আলিম পরীক্ষা দিতে যায়।
দুর্বৃত্তরা কৌশলে তাকে ছাদে ডেকে নিয়ে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। ২৭ মার্চ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে মামলা করেন মেয়েটির মা। মামলা প্রত্যাহারে রাজি না হওয়ায় তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। ওই দিনই গুরুতর আহতাবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়।
মেয়েটি যা বললেন : ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অগ্নিদগ্ধ ওই শিক্ষার্থী এক চিকিৎসকের কাছে বলেছেন, অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলা কয়েক বছর ধরে নারী শিক্ষার্থীদের উত্ত্যক্ত করছিল। অধ্যক্ষ মেয়েদের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র দিয়ে দেয়ার প্রলোভন দেখাত।
এতে রাজি না হলে যৌন নিপীড়ন করার চেষ্টা করত। নানাভাবে হেনস্তা করত। ২৭ মার্চের আগেও বিভিন্ন সময় তার সঙ্গে অশোভন আচরণ করেছে। তবে ২৭ মার্চ আগের সব অশোভন আচরণকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এ কারণেই বিষয়টি সে পরিবারকে জানিয়েছে। অন্য শিক্ষার্থীরাও বিষয়টি জেনেছে।
অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার পর তার পরিবার এবং সে খুব চাপে ছিল। এ কারণে সে ভাইয়ের সঙ্গে মাদ্রাসায় পরীক্ষা দিতে যেত। ঘটনার দিন তার ভাইকে ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়নি।
অগ্নিদগ্ধ শিক্ষার্থী আরও বলেন, পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রবেশের পর তাকে ছাদে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নেকাব, বোরকা, হাতমোজা পরিহিত চারজনকে সে দেখতে পায়। তাদের মধ্য থেকে তার (অগ্নিদগ্ধ শিক্ষার্থী) সঙ্গে একজন কথা বলছিল। সে বারবার মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বলে।
অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ অসত্য এ কথা বলতে চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। এতে রাজি না হওয়ায় ওই চারজন ওড়না দিয়ে তার হাত বেঁধে ফেলে। তারপর গায়ে কিছু একটা ছুড়ে মারে। তারপর বলে, ‘যা এবার পালা।’ গায়ে আগুন লাগা অবস্থাতেই সে দৌড়ে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে।
তারা কেউ কারও নাম উচ্চারণ না করলেও কোনো একপর্যায়ে একজন শম্পা বলে একজনকে ডাকে। সে যে কণ্ঠ শুনেছে সেটি নারী কণ্ঠ। তবে মুখ ঢাকা থাকায় কাউকে সে চিনতে পারেনি। ওড়না ছাই হয়ে যাওয়ার পর তার হাতের বাঁধন খুলে যায়।
এদিকে ওই শিক্ষার্থীর ভাই, বাবা ও মা সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন। মেয়েটির ভাই যুগান্তরকে বলেন, সবার কাছে আমার বোনের জন্য দোয়া চাই। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
এদিকে সোমবার বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়া অগ্নিদগ্ধ ওই শিক্ষার্থীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে দেখতে যান। সেখান থেকে বেরিয়ে তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই শিক্ষার্থীকে সিঙ্গাপুর পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। তার চিকিৎসার সব খরচ সরকার বহন করবে। যারা এ অপরাধ করেছে তাদের বিচার অবশ্যই হবে। আমরা এখন তার স্বাস্থ্যের বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছি। তাকে যে কোনো মূল্যে সুস্থ করার চেষ্টা করছি।
এ সময় সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘একটু আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে ফোন দিয়ে বলেছেন, ওই শিক্ষার্থীকে সিঙ্গাপুর পাঠানোর মতো হলে যেন সেখানে পাঠানো হয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পাওয়ার পর সিঙ্গাপুরে তার চিকিৎসার কাগজপত্র পাঠিয়েছি। তারা রেসপন্স করলে দ্রুত পাঠিয়ে দেব।’ তিনি আরও বলেন, ‘ওই শিক্ষার্থীর শরীরের ৮০ শতাংশ পুড়ে গেছে। এত বেশি দগ্ধ রোগী সিঙ্গাপুরের কোনো হাসপাতাল নিতে চায় না। তার পরও আমরা চেষ্টা করছি।’
এদিকে গ্রেফতার ১০ জনের মধ্যে ৭ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হল- মাদ্রাসার দারোয়ান মো. মোস্তফা, অধ্যক্ষের ফুফা শ্বশুর ও ব্যক্তিগত সহকারী নুরুল আমিন, ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক আবছার উদ্দিন, সহপাঠী আরিফুল ইসলাম, সাইফুল ইসলাম, আলাউদ্দিন ও জসিম উদ্দিন।
এদিকে পরীক্ষা কেন্দ্রে মাদ্রাসাছাত্রী অগ্নিদগ্ধ হওয়ার ঘটনায় ফেনী জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (ভারপ্রাপ্ত) পিকেএম এনামুল করিমকে আহ্বায়ক করে এ কমিটি গঠন করা হয়। অন্য দুই সদস্য হলেন- ফেনী জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার কাজী সলিম উল্যাহ ও সোনাগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সোহেল পারভেজ। তিন দিনের মধ্যে বিষয়টি তদন্ত করে জেলা প্রশাসকের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন জেলা প্রশাসক।
পাঞ্জাবি খুলে আগুন নেভাল আবু বকর : অগ্নিদগ্ধ মাদ্রাসাছাত্রী যখন আগুন আগুন বলে চিৎকার করছিলেন তখন নিজের পাঞ্জাবি খুলে আগুন নেভান তার সহপাঠী আবু বকর। তিনি যুগান্তরকে বলেন, আগুন লাগার পর ওই ছাত্রী বারবার চিৎকার করছিলেন। তখন তিনি পরীক্ষার হলে ছিলেন। বেরিয়ে এসে দেখেন দু’জন পাটের চট দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন। তখন তিনি নিজের শরীরের পাঞ্জাবি ওই ছাত্রীর শরীরে জড়িয়ে দেন। পরে ওই মাদ্রাসার আবাসিক ছাত্রদের লুঙ্গি এনে ছাত্রীর শরীরে মোড়ানো হয়। তারপর তাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়।
