যেভাবে ‘ফণী’ নামকরণ
ঘূর্ণিঝড়ের ‘লাল পতাকা’ ও সংকেত
মাহমুদুল হাসান নয়ন
প্রকাশ: ০২ মে ২০১৯, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
‘ফণী’ (Fani) নাম দিয়েছে বাংলাদেশ। এর অর্থ সাপ বা ফণা তুলতে পারে এমন প্রাণী। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা আঞ্চলিক কমিটি প্রতিটি ঝড়ের একটি নাম দিয়ে থাকে।
ভারত মহাসাগরের ঝড়গুলোর নামকরণ করে এই সংস্থার আটটি দেশ। দেশগুলো হল- বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার, মালদ্বীপ, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড ও ওমান। এই দেশগুলোর প্যানেলকে বলা হয় ডব্লিউএমও/এসক্যাপ (WMO/ESCAP)।
অনেক আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্র বা অস্ট্রেলিয়া অঞ্চলে ঝড়ের নামকরণ করা হলেও ২০০৪ সাল থেকে বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরের উপকূলবর্তী দেশগুলোয় ঝড়ের নামকরণ শুরু হয়।
ভারত মহাসাগরে ঘূর্ণিঝড়কে সাইক্লোন বলা হলেও আটলান্টিক মহাসাগরীয় এলাকায় একে বলা হয় হারিকেন, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বলা হয় টাইফুন। ২০০৪ সালে আটটি দেশ মিলে মোট ৬৪টি নাম প্রস্তাব করে। সেই তালিকা থেকে ঝড়গুলোর নামকরণ করা হয়। ফণীর পর এ তালিকায় আরও সাতটি নাম রয়েছে। এরপরের ঝড়ের নাম হবে ভারতের প্রস্তাব অনুযায়ী ‘ভায়ু’।
আর ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস পাওয়া গেলেই এর তীব্রতা ও গতিপথ অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে দেয়া হয় বিভিন্ন স্তরের বিপদ সংকেত। সংকেত অনুযায়ী উপকূলীয় এলাকায় টানিয়ে দেয়া হয় লাল পতাকা।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আবহাওয়া অফিস থেকে সতর্কতা হিসেবে যেসব সংকেত জারি করা হয় সেগুলো মূলত দু’ধরনের। এই সংকেতগুলো তৈরি করা হয়েছে শুধু সমুদ্রবন্দর এবং নদীবন্দরকে লক্ষ্য করে। দেশে সমুদ্রবন্দরের জন্য ১১টি এবং নদীবন্দরের জন্য ৪টি সংকেত রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের বিপদ বা ভয়াবহতা বিশ্লেষণ করে ১১টি সংকেতকে আবার ৫ ভাগে ভাগ করা হয়। এ বিষয়ে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর।
সমুদ্রবন্দরগুলোর জন্য রয়েছে ১ নম্বর দূরবর্তী সতর্ক সংকেত। এর অর্থ হচ্ছে- ‘জাহাজ ছেড়ে যাওয়ার পর দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সম্মুখীন হতে পারে। দূরবর্তী এলাকায় একটি ঝড়ো হাওয়ার অঞ্চল রয়েছে। এ সময় বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৬১ কিলোমিটার (কিমি.)। ফলে সামুদ্রিক ঝড়ের সৃষ্টি হবে।’ আর ২ নম্বর দূরবর্তী হুশিয়ারি সংকেত বলতে বোঝায়, ‘দূরে গভীর সাগরে একটি ঝড় সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে বাতাসের একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২-৮৮ কিমি.। বন্দর এখনই ঝড়ে কবলিত হবে না, তবে বন্দর ত্যাগকারী জাহাজ পথে বিপদে পড়তে পারে।’
আর ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত বলতে বোঝায়- ‘বন্দর ও বন্দরে নোঙর করা জাহাজগুলোর দুর্যোগকবলিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বন্দরে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে এবং ঘূর্ণি বাতাসের একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৪০-৫০ কিমি. হতে পারে।’ ৪ নম্বর স্থানীয় হুশিয়ারি সংকেত বলতে বোঝায়, ‘বন্দর ঘূর্ণিঝড়কবলিত। বাতাসের সম্ভাব্য গতিবেগ ঘণ্টায় ৫১-৬১ কিমি.। তবে ঘূর্ণিঝড়ের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেয়ার মতো তেমন বিপজ্জনক সময় এখনও আসেনি।’
এদিকে প্রচলিত সতর্ক সংকেতে সাধারণ মানুষ অভ্যস্ত হলেও এসব নিয়ে বিভ্রান্তিও রয়েছে তাদের মধ্যে। অনেকের ধারণা, ‘সংকেত যত বেশি, বিপদ তত ভয়াবহ।’ কিন্তু বাস্তবে তা নয়। এতে প্রায়শই বিপাকে পড়তে হয় সংশ্লিষ্টদের। ফলে সংকেত ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য কয়েকবার উদ্যোগ নেয়া হলেও তা ভেস্তে যায়। এ বিষয়ে বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘ফণী’-কে সামনে রেখে আবহাওয়ার এই সংকেতগুলো ব্যাপক হারে প্রচার করতে হবে। ক্ষতি সম্পর্কে যাতে মানুষ বুঝতে পারে। পাশাপাশি তিনি আবহাওয়ার সংকেত যুগোপযোগী করারও পরামর্শ দেন।
আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, সমুদ্রবন্দরের জন্য সংকেতগুলোর মধ্যে ৫, ৬ ও ৭ নম্বর বিপদ সংকেতের মাত্রা একই। আবার ৮, ৯ ও ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেতেরও মাত্রা এক। ঝড় কোন দিক দিয়ে যাবে তার ভিত্তিতে নম্বর আলাদা করা হয়, যদিও বিপদ সব ক্ষেত্রেই সমান। ৫, ৬ ও ৭ নম্বর বিপদ সংকেত বলতে বোঝায়, বন্দর ছোট বা মাঝারি তীব্রতর এক সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে পড়বে। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২-৮৮ কিমি.। ৫ নম্বর বিপদ সংকেতে ঝড়টি বন্দরকে বাম দিকে রেখে উপকূল অতিক্রম করতে পারে। ৬ নম্বর বিপদ সংকেতে ঝড়টি বন্দরকে ডান দিকে রেখে উপকূল অতিক্রম করতে পারে। ৭ নম্বর বিপদ সংকেতে ঝড়টি বন্দরের ওপর বা এর কাছ দিয়ে উপকূল অতিক্রম করতে পারে।
৮, ৯ ও ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত বলতে বোঝায়- বন্দর প্রচণ্ড বা সর্বোচ্চ তীব্রতর ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়তে পারে। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ কিমি. বা এর বেশি হতে পারে। ৮ নম্বর মহাবিপদ সংকেতে প্রচণ্ড ঝড়টি বন্দরকে বাম দিকে রেখে, ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেতে প্রচণ্ড ঝড়টি বন্দরকে ডান দিকে রেখে এবং ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেতে প্রচণ্ড ঝড়টি বন্দরের ওপর বা এর কাছ দিয়ে উপকূল অতিক্রম করবে। ১১ নম্বর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন সংকেত বলতে বোঝায়, আবহাওয়ার বিপদ সংকেত প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এবং স্থানীয় আবহাওয়া কর্মকর্তা পরিস্থিতি অত্যন্ত দুর্যোগপূর্ণ বলে মনে করেন।
ঘূর্ণিঝড়ে ‘লাল পতাকা’ : সমুদ্রবন্দরে বিপদ সংকেত দেয়া হলে সেখানে একেক সময় একেক সংখ্যার লাল পতাকা টানিয়ে দেয়া হয়। ১ নম্বর দূরবর্তী সতর্ক সংকেত, ২ নম্বর দূরবর্তী হুশিয়ারি সংকেত ও ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেতের ক্ষেত্রে সমুদ্রবন্দর এলাকায় একটি করে লাল পতাকা ওড়ানো হয়ে থাকে। ৪ নম্বর হুশিয়ারি সংকেত, ৫, ৬ ও ৭ নম্বর বিপদ সংকেতের ক্ষেত্রে দুটি লাল পতাকা উড়িয়ে সতর্কতা জানানো হয়। ৮ থেকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত ও ১১ নম্বর যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হওয়া সংকেতের ক্ষেত্রে তিনটি লাল পতাকা ওড়ানো হয়ে থাকে।
অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ নদীবন্দরের জন্য রয়েছে ১ নম্বর নৌ-সতর্ক সংকেত, ২ নম্বর নৌ-হুশিয়ারি সংকেত, ৩ নম্বর নৌ-বিপদ সংকেত ও ৪ নম্বর নৌ-মহাবিপদ সংকেত। নদীবন্দর ও সমুদ্রবন্দরের জন্য সতর্কতা সংকেত আলাদা হওয়ায় সংকেতগুলো ভালো করে বুঝে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর।
