বাস ট্রেন লঞ্চে উপচে পড়া ভিড়: কঠিন লড়াইয়ে ঢাকায় ফেরা
১১ ঘণ্টা পর্যন্ত দেরিতে ফিরছে ট্রেন * সড়কপথে বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ * আজ খুলছে বেসরকারি অফিস ও শিল্পকারখানা
যুগান্তর রিপোর্ট
প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০১৯, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ঈদের পর সাপ্তাহিক ছুটিও শেষ। ৯ দিন পর এবার কাজে যোগ দেয়ার পালা। আজ খুলছে সরকারি-বেসরকারি অফিস ও শিল্পকারখানা।
জীবিকার টানে কর্মস্থলে যোগ দিতে কয়েক দিন ধরেই চলছে ঢাকায় ফেরার লড়াই। শনিবারও ছিল ঢাকামুখী বাস, লঞ্চ ও ট্রেনে মানুষের উপচে পড়া ভিড়। বরাবরের মতো শনিবারও ট্রেনে ভোগান্তি ছিল। ফিরতি পথেও ছিল ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয়। সর্বোচ্চ ১১ ঘণ্টা দেরিতেও ঢাকায় ফিরছে ট্রেন। বগির ভেতর ও ছাদে ছিল যাত্রীতে ঠাসা।
আগাম টিকিট নেয়া যাত্রীদের অনেকেই ভিড়ের কারণে নিজের সিটে গিয়ে বসতে পারেননি। ফেরার সময় সড়কপথেও ছিল ভোগান্তির সঙ্গে বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ। ছিল গাড়ির সংকট। যাত্রীচাপের সুযোগে বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। বাস না পেয়ে অনেকেই বিকল্প বাহন ট্রাকে কম ভাড়ায় ঢাকায় ফিরেছেন। দেশের কিছু কিছু স্থানে ভ্রাম্যমাণ মোবাইল কোর্টের অভিযানেও বাড়তি ভাড়া আদায়ের প্রমাণ মিলেছে। কয়েকটি পরিবহনকে জরিমানা ও বাড়তি ভাড়া যাত্রীদের ফিরিয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া দক্ষিণাঞ্চল থেকে ছেড়ে আসা লঞ্চগুলোয়ও যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে।
ঈদুল আজহা উপলক্ষে ১১, ১২ ও ১৩ আগস্ট ছিল সরকারি ছুটি। মাঝে ১৪ আগস্ট সরকারি অফিস খোলা ছিল। পরদিন ১৫ আগস্ট ছিল বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস। আজ থেকে সরকারি-বেসরকারি সব অফিস শুরু। ফলে শনিবার ঢাকামুখী মানুষের চাপ বেশি দেখা গেছে। এদিন ভোর থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন বাসটার্মিনাল, সদরঘাট লঞ্চটার্মিনাল ও কমলাপুর রেলস্টেশনে মানুষের প্রচণ্ড ভিড় লক্ষ করা গেছে।
নওগাঁ থেকে শনিবার ঢাকায় এসেছে শরীফ ও সাবিনা দম্পতি। ভোগান্তির যাত্রার বিষয়ে তারা জানান, নওগাঁর মান্দা উপজেলার বাসিন্দা তারা। নওগাঁ থেকে বাসের টিকিট না পেয়ে শনিবার বগুড়া আসেন। বগুড়া থেকে গাবতলী পর্যন্ত বাসে জনপ্রতি ৬০০ টাকা দাবি করায় কম ভাড়ার আশায় ট্রাকে চড়ে চলে আসেন। শরীফ বলেন, মিরপুর-১১ এ একটি গার্মেন্টে চাকরি করি। চাকরিটা আয়ের একমাত্র অবলম্বন। রোববার সকালে কারখানায় ঢুকতে হবে, তাই ট্রাকে চড়েই চলে এসেছি। রোদ ও হালকা বৃষ্টিতে একটু সমস্যা হয়েছে। তিনি বলেন, ঈদে বাড়ি ফেরার আগে বেতন-বোনাস যা পেয়েছিলাম তাতে গাড়ি ভাড়া বাদে পুরোটাই শেষ। মাসের বাকিটা চলতে হবে। তাই ঝুঁকি জেনেও ট্রাকে চড়ে এসেছি। অনেকেই এভাবে ঢাকায় আসছে।
রংপুর থেকে সামি-জ্যোতি নামের বাসের ছাদে চড়ে ২০ জন যাত্রী ফিরেছেন ঢাকায়। তাদেরই একজন আইজুল ইসলাম বলেন, যেভাবেই হোক নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কর্মস্থলে যোগ দিতে হবে। নইলে চাকরিটা চলে যাবে। কর্তৃপক্ষ এমনটা বলেই ছুটি দিয়েছে। তাই কর্মস্থলে ফিরতে একটু ঝুঁকি তো নিতে হবেই। তিনি বলেন, বাসের ভেতরেও অনেকে দাঁড়িয়ে এসেছে। আমরা কম ভাড়ায় ছাদে এসেছি। বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ করেন ফরিদপুর থেকে আসা যাত্রী গোলাম রহমান। তিনি বলেন, পলাশ পরিবহনে পাটুরিয়া থেকে গাবতলী পর্যন্ত ভাড়া ৩০০ টাকা চেয়েছে। অথচ স্বাধারণ সময়ে ৯০ টাকা ভাড়া নেয়া হতো। রাজবাড়ী থেকে আসা এনজিও কর্মী শাহাদাত হোসেন বলেন, আশুলিয়া গ্যালাক্সি গাড়িতে পাটুরিয়া থেকে নবীনগর ২০০ টাকা ভাড়া দিতে হয়েছে।
তবে আগাম টিকিট সংগ্রহকারী নামিদামি বাস কোম্পানির যাত্রীরা এসেছেন অনেকটা স্বাচ্ছন্দ্যে। শনিবার সড়ক-মহাসড়কের উল্লেখযোগ্য যানজট না থাকায় দ্রুতই তারা ঢাকায় ফিরতে পেরেছেন। ঝিনাইদহ থেকে রয়েল পরিবহনে আসা সিরাজুল ইসলাম বলেন, মাত্র সাড়ে ১১ ঘণ্টায় ঢাকায় এসেছি। রাস্তা ফাঁকা ছিল।
টাঙ্গাইলের নাগরপুর থেকে একমাত্র ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় ফিরেছেন কানিজ ফাতেমা (রুমা)। তিনি বলেন, টাঙ্গাইলের শেষ সীমান্তে বাসা হওয়ায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বরাঙ্গাইল বাসস্ট্যান্ড থেকে বিআরটিসির বাসে উঠেছি ১০টার দিকে। বেলা আড়াইটায় গুলিস্তান পৌঁছেছি। রাস্তায় যানজট ছিল না। কিন্তু বাসে বাড়তি ভাড়া আদায় করায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মুখে পড়েছিল। ৭০ টাকার ভাড়া ১০০ টাকা আদায় করায় ম্যাজিস্ট্রেট ওই বাসটিকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন। এ কারণে আধা ঘণ্টা এবং গাড়িতে সিএনজি নেয়ায় আরও কিছু সময় নষ্ট হয়। সবমিলিয়ে ভালো ভালোই ফিরেছি।
পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানান, শনিবার সড়ক-মহাসড়কে উল্লেখযোগ্য যানজট না থাকলেও গাড়ির চাপ ছিল। রাজধানীতে চলাচল করে রাইদা, আয়াত, অনাবিলসহ কয়েকটি কোম্পানির গাড়ি দূরপাল্লার রুটে যাত্রী বহন করেছে। এসব গাড়ির চালকরা ওইসব পথ ভালো চিনতে না পারায় তারা সঠিকভাবে গাড়ি চালাতে পারে না। এতেও রাস্তায় থেমে থেমে গাড়ি চলেছে। তারা জানান, বেলা গড়াতে দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে গাড়ির দীর্ঘ সারি তৈরি হয়। ফেরি পার হতে কয়েক ঘণ্টা লেগে যায়।
ট্রেন এসেছে ১১ ঘণ্টা পর্যন্ত দেরিতে : ঈদ শেষেও ফিরতি ট্রেনও বিলম্বে চলাচল করছে। পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল থেকে ছেড়ে আসা রাজধানীমুখী অধিকাংশ ট্রেনই সিডিউল বিপর্যয়ে পড়েছে। বিলম্বে আসা এবং ছেড়ে যাওয়া ট্রেনযাত্রীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। ঈদের আগে কোনো কোনো ট্রেন দেড় ঘণ্টা থেকে ১৩ ঘণ্টা বিলম্বে চলাচল করেছে। ঈদের পর ফিরতি ট্রেনগুলো বিলম্বে চলাচল করছে। শনিবারও ফিরতি ট্রেন ১১ ঘণ্টা পর্যন্ত বিলম্বে চলাচল করেছে। শনিবার কমলাপুর স্টেশনে আসা প্রতিটি ট্রেনেই উপচে পড়া ভিড় ছিল, অধিকাংশ ট্রেনের ছাদ, ইঞ্জিন, দুই বগির সংযোগস্থলে ছিল রাজধানীমুখী মানুষ।
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন ম্যানেজার আমিনুল হক জুয়েল যুগান্তরকে বলেন, অনেক ট্রেন বিলম্বে কমলাপুর স্টেশনে আসছে। বিলম্বে আসা ট্রেনগুলো বিলম্বেই ছাড়তে হচ্ছে। এতে যাত্রীদের দূর্ভোগ বাড়ছে। তবে ঈদের আগে ও পরে ট্রেন বিলম্বে চলাচল করাটা স্বাভাবিক। প্রতিটি ট্রেনই অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে চলাচল করছে। ঈদ শেষে প্রতিটি ট্রেনেই উপচে পড়া ভিড় রয়েছে। বিশেষ করে পশ্চিমাঞ্চলে চলা প্রতিটি ট্রেনই বিলম্বে চলাচল করছে। ৪০ মিনিট থেকে ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত বিলম্বে চলছে। তিনি বলেন, যাত্রী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে ট্রেন ধীরগতিতে চালাতে হচ্ছে। তাছাড়া ২-৩ মিনিট বিরতির স্থলে ১০-১২ মিনিট পর্যন্ত বিরতি দিতে হচ্ছে একেকটি স্টেশনে।
শনিবার কমলাপুর স্টেশন ঘুরে দেখা গেছে, পশ্চিমাঞ্চল থেকে ছেড়ে আসা প্রতিটি ট্রেনই বিলম্বে চলাচল করে। এছাড়া পূর্বাঞ্চল থেকে ছেড়ে আসা ৫টি ট্রেন ৪০ মিনিট থেকে আড়াই ঘণ্টা বিলম্বে চলেছে। সুন্দরবন এক্সপ্রেস কমলাপুর থেকে সকাল ৬টা ২০ মিনিটে ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও তা নির্ধারিত সময়ের চেয়ে সাড়ে ৪ ঘণ্টা বিলম্বে ঢাকায় আসে।
সকাল ৬টায় ছেড়ে যাওয়ার কথা ধূমকেতু এক্সপ্রেস, ট্রেনটি এসেছে ৫ ঘণ্টা বিলম্বে। এছাড়া একতা, অগ্নিবীণা, সিল্কসিটি, এগারসিন্ধুর, রংপুর এক্সপ্রেস, বনলতা এক্সপ্রেস, দ্রুতযান এক্সপ্রেস দেড় ঘণ্টা থেকে ১১ ঘণ্টা বিলম্বে কমলাপুর পৌঁছেছে। রংপুর এক্সপ্রেস প্রায় সোয়া ১১ ঘণ্টা বিলম্বে কমলাপুর এসে পৌঁছে।
রেলপথে ঈদে ঘরমুখো মানুষের বাড়ি ফেরা নিয়ে নানা ভোগান্তি ছিল। ঈদের আগে সিডিউল বিপর্যয়ের কারণে ট্রেন পরের দিনও ছেড়ে গেছে। ১২-১৫ ঘণ্টা বিলম্বে ট্রেন চলায় অনেক যাত্রী টিকিট ফেরত দিয়ে সমপরিমাণ টাকাও নিয়ে গেছেন। কেউ আবার ১৭-১৮ ঘণ্টা অপেক্ষা করে নাড়ির টানে বাড়িতে গেছেন। এদিকে যারা ঈদে বাড়ি যেতে পারেননি, তাদের অনেকেই ঈদের পর বাড়ি গেছেন। ঈদের পঞ্চম দিনও কমলাপুর থেকে গ্রামে যেতে দেখা গেছে শত শত লোককে। ভোগান্তি থেকে বাঁচতে যারা ঈদের পর বাড়ি যেতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তাদেরও দুর্ভোগ ছাড়েনি। শনিবার বিভিন্ন ট্রেনের জন্য শত শত যাত্রীকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কমলাপুর ও বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে অপেক্ষায় থাকতে দেখা যায়।
লঞ্চের ডেকেও যাত্রী দাঁড়ানোর উপায় নেই : বরিশাল থেকে আসা সুন্দরবন লঞ্চের যাত্রী সুমন ইসলাম বলেন, লঞ্চের কেবিন তো পাইনি, ডেকেও দাঁড়ানোর উপায় ছিল না। অনেক স্টাফ ২-৩শ’ টাকায় ডেকের সিট বিক্রি করেছে। ওই একটি সিট ম্যানেজ করে সারা রাত বসে বসেই ঢাকায় ফিরেছি। শুধু সুমন নন, এমন তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন দক্ষিণাঞ্চলের অনেক যাত্রী।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের যুগ্ম পরিচালক ও ঢাকা নদীবন্দরের নৌনিরাপত্তা কর্মকর্তা মো. আলমগীর কবির জানান, শনিবার বিকাল ৪টা পর্যন্ত দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো থেকে ১১৪টি লঞ্চ ঢাকায় এসে পৌঁছেছে। ওই সময় পর্যন্ত ৫০টি লঞ্চ ছেড়ে গেছে। এর মধ্যে ২৫টি গেছে খালি। রাত পর্যন্ত একশ’র বেশি লঞ্চ ছেড়ে যাবে ঢাকামুখী যাত্রী নিয়ে আসতে। তিনি বলেন, শনিবার যাত্রীচাপ বেশি ছিল। রোববারও এ অবস্থা অব্যাহত থাকবে।
