রাজাকারের রহস্যঘেরা তালিকায় তোলপাড়
বাদ পড়েছে সরাইলের শীর্ষ রাজাকারের নাম * তালিকার ব্যাখ্যা চেয়ে ডিসিকে মন্ত্রীর চিঠি
নেসারুল হক খোকন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ফিরে
প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রতীকী ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
শীর্ষস্থানীয় রাজাকারদের নাম বাদ পড়েছে রহস্যজনক সরকারি তালিকা থেকে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ছাড়াই ২০১৫ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসকের (ডিসি) নির্দেশে তড়িঘড়ি করে গোপনে ইউএনওকে দিয়ে তালিকাটি করা হয়। কিন্তু মানবতাবিরোধী আদালতে বিচারাধীন অবস্থায় মৃত আসামি এমদাদুল হক টাক্কাব আলীর নামও তালিকায় না থাকায় ফুঁসে উঠেছেন এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা। অভিযোগের তীর খোদ সরাইলের বাসিন্দা সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফরহাদ রহমান মাক্কীর দিকে। এলাকার বিক্ষুব্ধ মুক্তিযোদ্ধারা এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ও ডিসির কাছে। এ ছাড়া গত সপ্তাহে গণভবনে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছে চাঞ্চল্যকর বিষয়টি তুলে ধরেন।
সূত্র জানায়, এ বিষয়ে দ্রুত তদন্ত করে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে একটি গোয়েন্দা সংস্থাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
কোনোরকম নির্দেশনা ছাড়া এমন তালিকা করতে পারেন কি না, জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ডিসি হায়াত-উদ-দৌলা যুগান্তরকে বলেন, আমার জানামতে সারা দেশের কোথাও যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা করা হয়নি। সরাইলে কেন হল, তা আমি জানি না। আমার যোগদানের আগের ঘটনা এটি। তিনি জানান, এ বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযোগ তদন্তের জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। তদন্ত সম্পন্ন করে কয়েকদিনের মধ্যেই প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে ডিসি বলেন, আজ (শনিবার) আগরতলা থেকে ফেরার পথে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছি। তিনিও বলেছেন, ২০১৫ সালে আমরা এমন কোনো তালিকার কথা বলিনি। এখন রাজাকারদের নাম সংরক্ষণে রাখার কথা বলেছি। তিনি বলেন, ওই সময়ে রাজাকারদের নিয়ে এ তালিকার বিষয়টি পুরোটাই রহস্যেঘেরা। সরাইলের কালিকচ্ছ বধ্যভূমি ভরাট করে সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফরহাদ রহমান মাক্কী পেট্রল পাম্প করার উদ্যোগের অভিযোগ পেয়েছি। তবে আমি ওই স্থানটি পুনরুদ্ধার করে বধ্যভূমির সাইনবোর্ড প্রতিস্থাপন করেছি।
প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালে বিতর্কিত ওই তালিকাটি যখন করা হয় তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ডিসি ছিলেন ড. মোশারফ হোসেন। বর্তমানে তিনি বেসামরিক বিমান মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব। জানতে চাইলে যুগান্তরকে তিনি বলেন, এত আগের বিষয় সঠিক মনে পড়ছে না। তবে মন্ত্রণালয় থেকে কোনো কিছু না পাঠানো হলে এ তালিকা হওয়ার কথা নয়।
তথ্যানুসন্ধানে পাওয়া নথিপত্রে দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ডিসিকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে এ বিষয়ে লেখেন, ‘কীভাবে তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে এবং কার নির্দেশে করা হয়েছে, তা অবগত করার জন্য বলা হউক।’ সরাইলের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও আবুল কালাম আজাদ ও যুদ্ধকালীন গ্রুপ কমান্ডার আবদুল্লাহ ভূঁইয়ার যৌথ স্বাক্ষরে রাজাকারের প্রশ্নবিদ্ধ তালিকা নিয়ে প্রথমে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। গত ১ জুলাই এ আবেদনটিই তদন্তের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ডিসির কাছে অফিশিয়ালি পাঠানো হয়। অভিযোগে বলা হয়, সরকার দালাল ও রাজাকারদের তালিকা প্রণয়নের বিষয়ে কোনো রকম সিদ্ধান্ত ছাড়াই সরাইলে ৩৭২ জন রাজাকারের একটি তালিকা করা হয়। এর পেছনে আছেন সরকারের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফরহাদ রহমান মাক্কী। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তার পিতা, সম্পর্কিত ভাই, মামা ও মামাতো ভাইয়েরা এলাকার শীর্ষস্থানীয় রাজাকার ছিল। আরও বলা হয়, সরাইল থানা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আবদুল মন্নাফ ঠাকুর ১৯৭১ সালের অক্টোবরে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হন। এরপর শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন এই মাক্কীর পিতা ফয়েজ আহমেদ খন্দকার ওরফে ফরহাদ রহমান বা ছেলুর বাপ। ওই সময় ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন শান্তি কমিটির ডেপুটি কমান্ডার মানবতাবিরোধী আদালতে বিচারাধীন অবস্থায় মৃত আসামি এমদাদুল হক টাক্কাব আলি। অভিযোগে বলা হয়, আত্মস্বীকৃত রাজাকার মাক্কীর নিকটাত্মীয় জিয়া উদ্দিন আহম্মেদ বাঘু, মরহুম আবদুল হান্নান ঠাকুর, আবদুল মতিন ঠাকুর, মরহুম ফরিদ উল্লাহ ঠাকুরের নামও বিতর্কিত ওই তালিকায় নেই। শুধু তাই নয়, ’৭১ সালে অসংখ্য নিরীহ মানুষকে হত্যা করে গণকবর দেয়া হয়। গ্রামবাসীর বাড়িঘরে আগুন দিয়ে লুটপাট চালিয়ে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। ’৭১ সালে রমজান মাসে পাক হানাদার বাহিনী স্থানীয় এই রাজাকারদের সহযোগিতায় নিরীহ গ্রামবাসীর ৭৬ জনকে ব্রাশফায়ারের মাধ্যমে হত্যা করে। তাদেরকে বিটঘরে গণকবর দেয়া হয়। অথচ স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক শান্তি কমিটির নেতৃস্থানীয় রাজাকারদের বাদ দিয়ে করা এ তালিকা অত্যন্ত আপত্তিজনক।
সাবেক এই অতিরিক্ত সচিব কেন রাজাকারের তালিকা করতে যাবেন এর জবাব মেলে একই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠানো আরেকটি অভিযোগে। গত ৭ জুলাই অভিযোগটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ডাক গ্রহণ ও অভিযোগ শাখায় গৃহীত হয়। অভিযোগটি করেন সরাইল উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের ডেপুটি কমান্ডার আনোয়ার হোসেনসহ তিন জন। অপর দু’জন হলেন মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের অভিযোগকারী। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, সরাইলের সাবেক ইউএনও নাহিদা হাবিবের স্বাক্ষরে রাজাকারের যে তালিকা করা হয় তাতে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের ডেপুটি কমান্ডার আনোয়ার হোসেনেরও স্বাক্ষর দেখা যায়। আবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে অভিযোগও করেছেন তিনি। একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে কীভাবে রাজাকারের বিতর্কিত তালিকা করলেন আবার অভিযোগও করলেন, এর কারণ কী- জানতে চাইলে আনোয়ার হোসেন বলেন, ২০১৫ সালে স্বাক্ষরের নিচে যে তারিখ দেয়া আছে (২৬-১১-২০১৫) ওই তারিখে ইউএনও নাহিদা হাবিব আমাকে অফিসে দেখা করতে বলেন। আমি উপস্থিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ইউএনও আমার সামনে তালিকা দিয়ে বলেন, এখানে স্বাক্ষর করেন। এটা রাজাকারের তালিকা। এ সময় তিনি খুব তড়িঘড়ি করেন। আমি ইউএনওকে বিশ্বাস করে ওই তালিকায় স্বাক্ষর করি।
অভিযোগে অতিরিক্ত সচিব ফরহাদ রহমানের পারিবারিক পরিচিতিসহ তিনি যে রাজাকারের সন্তান সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, ফরহাদ রহমান মাক্কীর বাবা ফয়েজ আহমেদ ছুতুর পৈতৃক বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়ায়। তিনি সরাইল থানা মুসলিম লীগের তৎকালীন সভাপতি আবদুল মন্নাফ ঠাকুরের ছোট বোনকে বিয়ে করে এখানে স্থায়ী হন। ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন এই মন্নাফ ঠাকুর সরাইল থানা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। এ পদে থাকাবস্থায় ’৭১ সালের অক্টোবরে সরাইলের কালিকচ্ছ নামক স্থানে পাক হানাদার বাহিনীর মেজর রহমানসহ মুক্তিযোদ্ধাদের পেতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে মন্নাফ ঠাকুর নিহত হন। এরপরই দায়িত্বে আসেন ফরহাদ রহমানের পিতা ফয়েজ আহমেদ খন্দকার। পিতার রাজাকারের তকমা আড়াল করতে অতিরিক্ত সচিব ফরহাদ রহমান পিতার আসল নাম ফয়েজ আহমেদ খন্দকার পাল্টে ফয়েজুর রহমান রাখেন।
হঠাৎ করে কেন বিতর্কিত এমন একটি রাজাকারের তালিকা করলেন, জানতে চাইলে সরাইলের সাবেক ইউএনও ও বর্তমানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সৈয়দা নাহিদা হাবিব যুগান্তরকে বলেন, তৎকালীন জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে এটি সম্ভবত পাঠানো হয়েছিল। চিঠিতে জেলা প্রশাসকের স্মারক দেয়া আছে। তালিকার সঙ্গে যে চিঠি দেয়া হয় সেটিতে আমার স্বাক্ষর স্বীকার করে নিচ্ছি। কিন্তু রাজাকারদের তালিকায় যে স্বাক্ষর রয়েছে সেটি আমার নয়। কৌশলে এই তালিকা ম্যানিপুলেট করা হয়ে থাকতে পারে। ডেপুটি কমান্ডারকে ডেকে নিয়ে তালিকায় স্বাক্ষর নেয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সরাইলের সাবেক ইউএনও বলেন, মুক্তিযোদ্ধা ডেপুটি কমান্ডারকে ডেকে নিয়ে কখন স্বাক্ষর করতে বলেছি আমার মনে পড়ছে না।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সরাইলের বাসিন্দা সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফরহাদ রহমান মাক্কী শনিবার যুগান্তরকে বলেন, রাজাকারের এ তালিকা আমি করাব কেন? সেটা তো প্রশাসনিক কর্মকর্তা বা সরকারের গোয়েন্দাদের কাজ। তিনি বলেন, আমরা মুসলিম লীগ পরিবারের সদস্য। কিন্তু আমার মামা মন্নাফ ঠাকুর মুক্তিযুদ্ধকালে এলাকায় নির্যাতন করেছেন এমন সাক্ষ্য-প্রমাণ কেউ দেখাতে পারবে না। তিনি স্বাধীনতার আগে থেকেই মুসলীম লীগের সভাপতি থাকায় পদাধিকার বলেই পিস কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন এটা ঠিক। কিন্তু তিনি কাউকে নির্যাতন করেননি। আমার বাবা কখনও পিস কমিটিতে ছিলেন না। একটি বইয়ে বাবা পিস কমিটিতে ছিলেন বলা হলেও স্থানীয় একটি পত্রিকায় সংশোধনী ছাপা হয়েছে।
কালিকচ্ছ বধ্যভূমি দখল করার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, বিষয়টি সেটেল হয়ে হয়ে গেছে। সেখানে প্রশাসনের কর্মকর্তারা বধ্যভূমির সাইনবোর্ড লাগিয়ে গেছেন। আমি জানতাম না সেখানে বধ্যভূমি রয়েছে।
তিনি বলেন, আমি ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ করেছি। চাকরিজীবনে জনতার মঞ্চের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলাম। চাকরি থেকে অবসরে গিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে রাজনীতি করছি। আগামী কাউন্সিলে আমি সরাইল থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এ কারণেই নানা ষড়যন্ত্র হচ্ছে।
মুঠোফোনে কথা বলার সময় ফরহাদ রহমান মাক্কী মন্নাফ ঠাকুরের নাতি পরিচয়ে নিজাম উদ্দিন ঠাকুর নামে একজনের সঙ্গে কথা বলতে অনুরোধ করেন। নিজেকে সংবাদকর্মী পরিচয় দিয়ে যুগান্তরকে নিজাম ঠাকুর বলেন, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ছাত্রলীগ করার কারণে মাক্কী পারিবারিকভাবে অনেক কোণঠাসা ছিলেন। এটাকে পরিবার ভালোভাবে মেনে নিতে পারেনি। এখনও এলাকার অনেকে মানতে পারছেন না। নানাভাবে ষড়যন্ত্র করছেন।
