সাধারণ পরিবারের জহুর এখন শতকোটি টাকার মালিক
চট্টগ্রাম শহরেই বিলাসবহুল ৬ বাড়ি, নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড় * ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক পদই ‘জাদুর কাঠি’
চট্টগ্রাম ব্যুরো
প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
একেবারে সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসে অনেকটা রাতারাতি শতকোটি টাকার মালিক বনে গেছেন চট্টগ্রামের আলোচিত পরিবহন নেতা জহুর আহমদ।
নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়ার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে সরকারি দলের পদ ব্যবহারের সুযোগ পাওয়া। সর্বোপরি চট্টগ্রাম ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক ও কন্ট্রাক্টর অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদকের পদটি হয়েছে সাপেবর। বলা যায়, এটিই তার সম্পদ আহরণের জাদুর কাঠি।
৩০ বছর তিনি এ সংগঠনে নেতাগিরি করে চাঁদার টাকায় চট্টগ্রামে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। তার সংগঠনের ক্ষুব্ধ নেতারা যুগান্তরকে জানিয়েছেন, তিনি তো সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করেননি। তাহলে এত সম্পদের মালিক কীভাবে হলেন?
এটি অবশ্যই খতিয়ে দেখতে হবে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযানকে সত্যিকারার্থে সফল করতে হলে দুর্নীতির এসব আগাছা ছেঁটে ফেলতে হবে।
এ ছাড়া দুদক নিশ্চয় সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিশ দেবে। তারা বলেন, শুধু ‘নেতাগিরি’ করেই চাঁদার টাকায় আজ এখানে এসেছেন জহুর আহমদ। চট্টগ্রাম শহরেই রয়েছে তার ৬টি বিলাসবহুল বাড়িসহ নামে-বেনামে বিপুল সম্পদ। কর্ণফুলীর দক্ষিণ তীরেও রয়েছে তার ২০ একরেরও বেশি জমি।
দখল-বেদখল এবং ভূমিদস্যুতায়ও কম যান না তিনি। এতিম মেয়েদের কয়েক কোটি টাকার জমিও দখলে নিয়েছেন। ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান অ্যাসোসিয়েশনে কেউ তার বিরোধিতা করলে প্রয়োজনে তাকে জেল খাটাতেও ছাড়েন না তিনি। সুবিধাবাদী নেতা হিসেবে পরিচিত জহুর আহমদ বিএনপি আমলেও সমানে দাপট খাটাতেন।
সে সময়ে বিএনপি নেতার এক আত্মীয়কে ব্যবহার করেই তিনি বন্দরকেন্দ্রিক পণ্য পরিবহনে নিজের রাজত্ব টিকিয়ে রাখেন।
সূত্র জানায়, জহুর আহমদ ছিলেন পটিয়ার এক সাধারণ পরিবারের সন্তান। পটিয়া থেকে চট্টগ্রাম শহরে ব্যবসা শুরু করেন। একপর্যায়ে ১টি ট্রাক দিয়ে গ্যাস সিলিন্ডার পরিবহন ও পরে সিটি কর্পোরেশনের ময়লা-আবর্জনা টানার কাজও করেন তিনি। অথচ বর্তমানে তিনি ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান-লরিসহ অনেকগুলো গাড়ির মালিক।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানে পণ্য পরিবহন ব্যবসা করে অনেক ব্যবসায়ী দেউলিয়া হলেও জহুর আহমদ দিনে দিনে আঙুল ফুলে কলাগাছ নয়, মহিরুহ ধারণ করেছেন। আর এ সবই সম্ভব হয়েছে নেতাগিরি এবং চট্টগ্রাম বন্দরের পণ্য পরিবহনে সিন্ডিকেট বাণিজ্য করে।
৩৬ নম্বর গোসাইলডাঙ্গা ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং চট্টগ্রাম বন্দর ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও কন্ট্রাকটর অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী যুগান্তরকে স্পষ্ট করেই বলেন, জহুর আহমদ সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নেননি। আলাদিনের চেরাগও তার হাতে ছিল না।
মূলত ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান অ্যাসোসিয়েশনের নেতাগিরিকে পুঁজি করে পণ্য পরিবহনে সিন্ডিকেট বাণিজ্য ও জুলমবাজি করেই বাড়ি-গাড়িসহ বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক বনেছেন।
এদিকে মঙ্গলবার দৈনিক যুগান্তরে ‘দুর্নীতিবিরোধী অভিযানেও বহাল জহুরের রামরাজত্ব’ শীর্ষক সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর সাধারণ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিকদের অনেকে যুগান্তর প্রতিবেদককে ফোন করে তাদের সন্তুষ্টির কথা জানান।
বন্দর এলাকায় এক নিমেষে শেষ হয়ে যায় যুগান্তরের সব কপি। অনেকে ফটোকপি করে তা ঘরে ঘরে সরবরাহ করেন। তারা বলছেন, জহুর আহমদের মুখোশ উন্মোচন করা এখন সময়ের দাবি।
যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম শহরের বন্দর থানাধীন গোসাইলডাঙ্গা এলাকাতেই রয়েছে জহুর আহমদের অন্তত ৬টি বাড়ি। এর মধ্যে গোসাইলডাঙ্গা ঠান্ডা মিয়া মসজিদের পাশে ২০ শতক জমির ওপর রয়েছে ৬ তলা বাড়ি। এ বাড়িতে তিনি নিজেই থাকেন।
একই এলাকায় বড়বাড়ির ভেতরে রয়েছে ১০ শতক জমির ওপর ৫ তলা বাড়ি। নিমতলা দিয়া পাড়ায় ছোট গলিতে ১০ শতক জমির ওপর রয়েছে ৫ তলা একটি বাড়ি। বড়পুল মইন্যার পাড়ায় রয়েছে ২০ শতক জমির ওপর তিন তলা বাড়ি। হালিশহর কুড়িপুকুর পাড়েও রয়েছে তার বাড়ি। এ ছাড়া রয়েছে তিনটি প্রাইভেট কার ও জিপ।
ভুক্তভোগীদের কয়েকজন জানান, গোসাইলডাঙ্গা ঠান্ডা মিয়ার বাড়ি এলাকায় জনৈক রফিকের বোনদের অন্তত ৫ শতক জমি অবৈধভাবে দখল করে রেখেছেন জহুর আহমদ।
রফিকের পিতা থেকে ৫ শতক জমি কিনলেও রফিকের ৯ বোনের এই জমি বছরের পর বছর দখল করে রেখেছেন তিনি। মামলা হলেও এই জমি ফেরত পাচ্ছেন না তারা। এখানে প্রতি শতক জমির দাম অন্তত ৩০ লাখ টাকা। সে হিসাবে ৫ শতক জমির দাম প্রায় দেড় কোটি টাকা। এ ছাড়া কর্ণফুলীর দক্ষিণ তীরে ডাঙ্গারচরে ২০ একরেরও বেশি জমি রয়েছে। যেসব জমির বাজারমূল্য শতকোটি টাকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রাম বন্দর ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক ও কন্ট্রাক্টর অ্যাসোসিয়েশনের একাধিক সাবেক ও বর্তমান নেতা যুগান্তরকে জানান, জহুরের বিরোধিতা করলেই তাকে মামলা দিয়ে জেল খাটানো হয়। মানিক লাল নামে সাবেক এক সাধারণ সম্পাদককে জহুর আহমদই মিথ্যা মামলা দিয়ে ১৭ দিন জেল খাটান। ওই নেতা এখন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী।
অ্যাসোসিয়েশনে বর্তমানে তার সদস্যপদও নেই। অথচ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান না থাকলেও নিজের ভোটের জন্য অনেকের সদস্যপদ তিনি পকেট থেকে চাঁদা দিয়ে টিকিয়ে রেখেছেন।
জহুর আহমদ তার ছেলে মোরশেদ আলমকে দিয়ে বন্দরের সব ধরনের বড় বড় পণ্য চালান পরিবহন বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করেন। নেতার ছেলে হওয়ায় ওভার লোডেড পণ্য নিয়ে হাজার হাজার ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান বের হলেও ওই সব ট্রাক কেউ ধরে না। শুধু সাধারণ মালিকদের ট্রাকে ওভার লোড হলেই যত সমস্যা।
তারা বলেন, যে লোক একটি ট্রাক দিয়ে গ্যাস সিলিন্ডার কিংবা সিটি কর্পোরেশনের ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করতেন তার আজ এত বিত্ত-বৈভবের মালিক হওয়ার ঘটনা যে কোনো বিচারে অবিশ্বাস্য।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানার জন্য জহুর আহমদের মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন দেয়া হলেও রিসিভ না করায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
