Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

ফজলে হাসান আবেদকে শ্রদ্ধা ভালোবাসায় শেষ বিদায়

বনানী কবরস্থানে স্ত্রীর কবরে শেষ শয্যা

Icon

সাংস্কৃতিক রিপোর্টার

প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ফজলে হাসান আবেদকে শ্রদ্ধা ভালোবাসায় শেষ বিদায়

ছবি: যুগান্তর

দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে স্যার ফজলে হাসান আবেদের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ছুটে এসেছিলেন হাজারও শোকার্ত মানুষ। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে তার মরদেহে শ্রদ্ধা জানানো ছাড়াও বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক নেতারা, কূটনীতিক, উচ্চপদস্থ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, লেখক, শিক্ষকসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ তার প্রতি শেষ শ্রদ্বা জানান। ফুলে ফুলে ভরে ওঠে তার কফিন। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহণে বনানী আর্মি স্টেডিয়ামে তার জানাজা হয়। পরে বনানী কবরস্থানে স্ত্রীর কবরে শায়িত করা হয় ফজলে হাসান আবেদকে।    

দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অন্যতম পথদ্রষ্টা ফজলে হাসান আবেদ ৮৩ বছর বয়সে শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টায় রাজধানীর একটি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। তিনি মস্তিষ্কে টিউমারে আক্রান্ত হয়ে ২৮ নভেম্বর থেকে ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। রোববার সকাল ১০টা ২০ মিনিটে তার মরদেহ আর্মি স্টেডিয়ামে আনা হয় শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য।

পরে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের পক্ষে মেজর আশিকুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে তার উপসামরিক সচিব কর্নেল সাইফুল্লাহ শেষ শ্রদ্ধা জানান। পরে শ্রদ্ধা জানান, জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া।

আওয়ামী লীগের পক্ষে শ্রদ্ধা জানান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সঙ্গে ছিলেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, যুগ্ম-সাধারণ মাহবুবউল আলম হানিফ, বাহাউদ্দিন নাছিম, দফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া প্রমুখ। বিএনপির পক্ষে শ্রদ্ধা জানান দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। 

এছাড়া গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস, জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, তোফায়েল আহমেদ, সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নূরুল হুদা, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম, ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি ড. ম তামিম, সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি ইমান আলী, সুজনের সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রমুখ।

শ্রদ্ধা জানায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, জাতিসংঘ ঢাকা কার্যালয়, এফবিসিসিআই, এমসিসিআই, প্রশিকা, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, নিজেরাই করি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের পক্ষে সারা যাকের, জিয়াউদ্দিন তারিক আলী, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, নারী প্রগতি সংঘ, মেট্রোপলিটন চেম্বার, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, এফএনবি, ওয়েভ ফাউন্ডেশন, বাংলা একাডেমি, ব্র্যাক ব্যাংক, গুলশান সোসাইটি, সিভিএফ, ব্যুরো বাংলাদেশ, বেঙ্গল ইন্সটিটিউট, হোটেল ঢাকা রিজেন্সি, রিসার্চ অ্যান্ড হেলথ সেন্টার, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, গ্রামীণফোন, প্রিপ বাংলাদেশ, গণসাক্ষরতা অভিযান, নারীপক্ষ, নিজেরা করি, বাংলাদেশ ব্রেস্ট ফিডিং ফাউন্ডেশন, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন, ভাসানী প্রজন্ম পরিষদ, জনস্বাস্থ্য আন্দোলন, নাগরিক উদ্যোগ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ, স্মার্ট, লাইট হাউস, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি, দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট, সিআরপি, মায়া, কনসার্ন, আশা, দৈনিক সংবাদ, আড়ং, আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন, সিসিডিবি, এইড কুমিল্লা, টিএমএসএস, মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি, বানিয়াচং আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন, জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশন, ইমপ্যাক্ট ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ প্রভৃতি সংগঠন।

দুপুর সাড়ে ১২টায় আর্মি স্টেডিয়ামে তার জানাজা হয়। জানাজায় মানুষের ঢল নামে। জানাজার আগে ফজলে হাসান আবেদের ছেলে সামেরান আবেদ বলেন, ‘সবাই অকৃত্রিম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা নিয়ে আমাদের ব্র্যাক পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। কষ্ট করে যারা এসেছেন পরিবারের পক্ষ থেকে তাদের ধন্যবাদ জানাই। আমার বাবা সারা জীবন মানুষের জন্য কাজ করেছেন। তিনি কাউকে দুঃখ দিয়ে থাকলে ক্ষমা করে দেবেন।’

গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে ফজলে হাসান আবেদের স্পর্শ পেয়েছে। তার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতা কিংবা যে কোনো উপায়ে প্রতিটি মানুষের জীবনে কিছু না কিছু কাজে এসেছে। এই বিষয়টি পৃথিবীর ইতিহাসেও এক অনন্য নজির। তিনি কোনো বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ছিলেন না অথচ তার প্রতিষ্ঠিত প্রতিটি প্রতিষ্ঠান সুশৃঙ্খল।

মানুষের জীবন পরিবর্তনে তা ভূমিকা রেখে চলেছে। এটাও অসাধারণ একটা দৃষ্টান্ত। একজন ব্যক্তি এত ভিন্ন মাত্রায় মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে বিশাল ভূমিকা রেখে চলেছে। যা বাংলাদেশ ও পৃথিবীর মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন এনে দিচ্ছে- এটাও এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

তোফায়েল আহমেদ বলেন, স্যার ফজলে হাসান আবেদ একজন মহান ব্যক্তি। বিশ্বেও সমধিক খ্যাতিমান। দরিদ্র মানুষের ভাগ্য ফেরাতে অবদান রেখেছেন। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, তার শূন্যতা পূরণ হবে না। তার তুলনা তিনি নিজেই। ফজলে হাসান আবেদ ছিলেন একেবারে প্রচারবিমুখ।

নীরবে, নিঃশর্তভাবে তিনি বাংলার তৃণমূল পর্যন্ত তার কার্যক্রম ছড়িয়ে দিয়েছেন। দেশের বাইরেও ব্র্যাকের কার্যক্রম বিস্তৃতি লাভ করেছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তিনি একজন ক্ষণজন্মা পুরুষ।

যারা পৃথিবীকে বদলে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। বিশেষ করে, গ্রামীণ মহিলাদের ক্ষমতায়ন, তাদের আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে তার অবদান অপরিসীম। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, গত বছর তার সঙ্গে কাজ করেছি।

গণসাক্ষরতা অভিযানের তিনি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তাকে দেখেছি মানুষের জন্য কি অসাধারণভাবে কাজ করেন। তার মতো নিঃস্বার্থ মানবদরদি মানুষ খুব কমই দেখেছি জীবনে। কথা কম বলে মানুষের জন্য নীরবে কাজ করে যাওয়া তিনি জাতির এক ব্যতিক্রমী বাতিঘর। ব্র্যাকের কার্যনির্বাহী কমিটির সাবেক সদস্য স্থপতি লুভা নাহিদ চৌধুরী বলেন, তিনি ছোট করে ভাবতেন না।

তার সব ভাবনাই ছিল মানুষকে কেন্দ্র করে। সেই মানুষ শুধু বাংলাদেশের মানুষ নয়, বিশ্বের মানুষের কথা ভাবতেন। মানুষকে ভালোবাসাই ছিল তার সব কাজের অনুপ্রেরণা। তার সঙ্গে কাজ করার পর এটাই আমার প্রথম উপলব্ধি। তার শিক্ষা নিয়েই আমাদের চলতে হবে।

ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক এবং ফজলে হাসান আবেদের জামাতা আসিফ সালেহ বলেন, ‘পরিবারের প্রত্যেকের সঙ্গে ফজলে হাসান আবেদের ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিল। জীবন পরিবর্তনের জন্য তিনি কাউকে নীতিবাক্য দিতেন না, বাস্তববাদী পরামর্শ দিতেন।

তার স্ত্রী মারা গেছেন ১৯৮১ সালে। এত বড় একটি প্রতিষ্ঠান চালানোর পাশাপাশি তিনি পরিবারকেও সময় দিতেন। শুধু ব্র্যাক নয়, বাংলাদেশের বেশির ভাগ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে যুক্ত ছিলেন। এটা অনেকেই জানেন না। 

মরদেহ নিজ গ্রামে না নেয়ার কষ্ট এলাকাবাসীর : সিলেট ব্যুরো ও বানিয়াচং সংবাদদাতা জানান, স্যার ফজলে হাসান আবেদের মরদেহ তার নিজ গ্রাম হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে না আনায় কষ্ট পেয়েছেন এলাকাবাসী। মৃত্যুর পর থেকে শেষবারের মতো তাকে একবার দেখার প্রতীক্ষায় ছিলেন এলাকাবাসী।

স্মৃতিচারণ করে তারই বাল্যবন্ধু ও ব্র্যাকের প্রথম কর্মী দুলাল মিয়া কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় বানিয়াচংয়ের অনেক হিন্দু গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া ছাড়াও গণহত্যা চালানো হয়। যারা প্রাণে বেঁচে যান তাদের পুনর্বাসনের জন্য আবেদ ভাই প্রথম আমাকে সঙ্গে নিয়ে কাজ শুরু করেন।

আমরা ২২ জন মিলে মার্কুলী বাজারে ‘পুনর্বাসন কেন্দ্র’ গড়ে তুলি। পরে এর নাম দেয়া হয় ব্র্যাক। আবেদ ভাইয়ের মরদেহ এনে একবার বানিয়াচংয়ে জানাজা পড়ার সুযোগ দেয়ার আকুতি জানিয়েছিলাম। যাক, আল্লাহ তাকে বেহেশত নসিব করুন।

এছাড়া এলাকায় তার অবদানের কথা উল্লেখ করে অনেকেই ফেসুবকে স্ট্যাটাস দিয়ে মহান এই ব্যক্তিকে স্মরণ করেছেন। ১৯৬৩ সালের ২৭ এপ্রিল বানিয়াচং সদরের কামালখানী গ্রামে জন্ম নেন এই গুণী মানুষটি।

 

আবেদ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম