Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

তিন ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ডিবি কর্মকর্তা

অন্তঃসারশূন্য মানুষ মুসা বিন শমসের

সুইস ব্যাংকের টাকা, জমিসহ সম্পদের গল্প সাজানো : ডিবি * কাদের আমার সঙ্গেও প্রতারণা করেছে : মুসা বিন শমসের

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২১, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অন্তঃসারশূন্য মানুষ মুসা বিন শমসের

ডিবি অফিস থেকে বেরিয়ে মঙ্গলবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন মুসা বিন শমসের -যুগান্তর

ডিবির যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেছেন, ‘সম্পদের দিক থেকে মুসা বিন শমসের একজন অন্তঃসারশূন্য মানুষ। তিনি নিজেকে বিপুল সম্পদের মালিক হিসাবে দাবি করলেও আদতে তার কোনো সম্পদ নেই, তার তেমন কিছুই নেই। গুলশানে একটা বাড়ি আছে, সেটিও স্ত্রীর নামে।’ তাকে ‘রহস্যময় মানব’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।

ধনকুবের খ্যাত প্রিন্স মুসা বিন শমসেরকে প্রায় তিন ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে ৩টায় স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে ঢাকার মিন্টো রোডে গোয়েন্দা কার্যালয়ে যান তিনি। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার পর সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন। সেখানে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের পর এসব বলেন ডিবির এ যুগ্ম কমিশনার। 

জিজ্ঞাসাবাদ শেষে পুলিশ আরও বলেছে, আলোচিত এই ব্যক্তির বিপুল সম্পদের কথা শোনা গেলেও বাস্তবে তা নেই। তার সম্পদের গল্পকে প্রতারণার কাজে লাগিয়েছেন ভুয়া অতিরিক্ত সচিব আবদুল কাদের।

সচিব পরিচয়ে প্রতারণার অভিযোগে তিন সহযোগীসহ গ্রেফতার আব্দুল কাদেরের সঙ্গে মুসা বিন শমসেরের যোগাযোগ ও লেনদেনের তথ্য পেয়েছিলেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। সেই সূত্র ধরে তাকে হাজির হতে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের মাধ্যমে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। এ পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ডিবি কার্যালয়ে আসেন।

কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেন, প্রতারক আবদুল কাদেরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল মুসা বিন শমসেসের। তিনি কাদেরকে বাবু সোনা বলে ডাকতেন। প্রিন্স মুসা মুখরোচক অনেক কিছু বলেন। মানুষের সামনে বসলে গল্প বলেন। সেসব গল্প আর মুসার নাম ব্যবহার করে আবদুল কাদের বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে শত শত কোটি টাকা নিয়ে পকেটে ভরেছেন। এর দায় তিনি (মুসা বিন শমসের) এড়াতে পারেন না। কাদেরের সঙ্গে তার একটা যোগসূত্র আছে।

জিজ্ঞাসাবাদ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশিদ বলেন, প্রতারক আব্দুল কাদেরের সঙ্গে মুসা বিন শমসেরের বিভিন্ন ব্যবসায়িক সম্পর্কের চুক্তিপত্রসহ নানা তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, টাঙ্গাইলে মুসার ১৭ হাজার একর জমি, গাজীপুরে এক হাজার একর জমি, সুইস ব্যাংকে ৮২ মিলিয়ন ডলার থাকার বিষয়টি ভুয়া, সাজানো এবং অন্তঃসারশূন্য বলে মনে হয়েছে। এসএসসি পাশ না করলেও মুসা, আবদুল কাদেরকে আইন উপদেষ্টা করেছিলেন। তার কাছে এর ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছিলেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। ডিবির যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেন, ‘আমরা তাকে জিজ্ঞাসা করেছি, নবম শ্রেণি পাশ মানুষকে আপনি আইন উপদেষ্টা বানালেন কেন? উনি আপনাকে ১০ কোটি টাকার চেক দিলেন, আপনি তাকে ২০ কোটি টাকার চেক ফেরত দিলেন। উনি বলেছেন, লাভ দিয়েছেন। কেউ কি এক মাসে ১০ কোটি টাকা বিনিয়োগে ১০ কোটি টাকা লাভ দেয়? এখানে মুসার উদ্দেশ্য কী ছিল, সেটা জানা যায়নি।’

আবদুল কাদেরকে গ্রেফতারের সময় তার প্রতিষ্ঠান সততা প্রপার্টিজের অফিস থেকে মুসা বিন শমসের সংশ্লিষ্ট একটি কাগজ পান গোয়েন্দারা। সেখানে উল্লেখ করা হয়, সুইস ব্যাংকে মুসার ৮২ মিলিয়ন ডলার রয়েছে। ডিবির যুগ্ম-কমিশনার বলেন, এ বিষয়ে মুসাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘ঘটনা সত্য। আমার সুইস ব্যাংকে ৮২ মিলিয়ন ডলার আছে।’ আপনি টাকার মালিক, সেই টাকার কাগজ কেন কাদেরের কাছে-এ প্রশ্ন করলে নানা গল্প ফাঁদেন মুসা বিন শমসের। তিনি বলেন, ‘আমার একটা কলমের দাম ১০ কোটি টাকা, একটা ঘড়ির দাম ৮ কোটি। জুতার দাম ১০ কোটি টাকা। টাঙ্গাইলে ৩ লাখ একর জমির মালিক। গাজীপুরে ১ হাজার একর জমি রয়েছে।’ এসব গল্প মুসা বিন শমসের শিশুসুলভভাবেই হয়তো বলেন।

হারুন অর রশীদ জনান, মুসা বলেছেন, সুইস ব্যাংকের ৮২ মিলিয়ন ডলার পেলে পুলিশকে ৫০০ কোটি টাকা দেবেন। দুদকের ভবন করে দেবেন ২০০ কোটি টাকা খরচ করে। মুসা বিশাল গাড়িবহর এবং অস্ত্রধারী দেহরক্ষী নিয়ে চলাচল করেন। তবে ডিবি কার্যালয়ে তিনি সাধারণভাবেই এসেছিলেন। এ প্রসঙ্গে হারুন অর রশীদ বলেন, ‘তাকে আগেই বলে দেওয়া হয়েছে ডিবি কার্যালয়ে দেহরক্ষী নিয়ে আসা যাবে না। দেহরক্ষী পালতে যে টাকা লাগে, সেই টাকাও এখন তার নেই।’

ডিবি কার্যালয় থেকে বেরিয়ে মুসা বিন শমসের গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, যেসব বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, সেসবের উত্তর তিনি দিয়েছেন। ভালোভাবেই কথাবার্তা হয়েছে। তিনি জানান, প্রতারক কাদের তার সঙ্গেও প্রতারণা করেছেন। প্রতিমাসে লভ্যাংশ দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে কাদের তার কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। তিনি নিজেও কাদেরের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবেন বলে জানিয়েছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রতারক কাদের নিজেকে আমার আইন উপদেষ্টা হিসাবে দাবি করলেও তিনি আমার আইন উপদেষ্টা না।’

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, অতিরিক্ত সচিবের ভিজিটিং কার্ড ছাপিয়ে কাদের আমার অফিসে গিয়েছেন। বিভিন্ন সময় ছবি তুলেছেন। মাঝে মাঝে বড় বড় লোকের সঙ্গে কথা বলতেন তিনি। এতে করে আমি বিশ্বাস করি, তিনি একজন অতিরিক্ত সচিব। পরে যখন প্রমাণিত হলো তিনি প্রতারক, তাকে বের করে দিই। গত ৭ অক্টোবর রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে চার প্রতারককে গ্রেফতার করে গুলশান বিভাগের গোয়েন্দা দল। তারা হলেন আব্দুল কাদের চৌধুরী, শারমিন চৌধুরী ছোঁয়া, শহিদুল আলম ও আনিসুর রহমান। তাদের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন, এক রাউন্ড গুলিসহ একটি ওয়াকিটকি, একটি প্রাডো গাড়ি, অতিরিক্ত সচিবের অফিশিয়াল আইডি কার্ড এবং ভিজিটিং কার্ডসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতার চার প্রতারকের বিরুদ্ধে রাজধানীর পল্লবী থানায় একটি অস্ত্র মামলা ও তেজগাঁও থানায় একটি প্রতারণা মামলা করা হয়েছে। দুটি মামলায় সাত দিনের রিমান্ডে নিয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে গোয়েন্দা পুলিশ। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, প্রতারক আব্দুল কাদের চৌধুরীর কাছ থেকে মুসা বিন শমসের ও তার স্ত্রীর সঙ্গে করা কিছু চুক্তিপত্র উদ্ধার হয়েছে। এছাড়া তার সঙ্গে ২০ কোটি টাকা লেনদেনের কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। কিসের ভিত্তিতে এসব লেনদেন হয়েছে, তা জানতেই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, রাজধানীর গুলশানে জব্বার টাওয়ারে কাদেরের একটি অফিস আছে। সেখানে বসেই তিনি বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণ পাইয়ে দেওয়ার নামে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিলেন। তার সঙ্গে দেখা করানোর জন্য সহযোগীরা ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা নিতেন।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ঢাকা ট্রেড করপোরেশন, জমিদার ট্রেডিং, সামীন এন্টারপ্রাইজ, চৌধুরী গ্রুপ, হিউম্যান ইম্প্রুভমেন্ট ফাউন্ডেশন, সততা প্রপার্টিজ, ডানা লজিস্টিকস, ডানা মোটর্স নামে আব্দুল কাদের চৌধুরীর নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলোর কথা বলেই তিনি মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। ২০০৪ থেকে ২০০৬ সালে তিনি সরকারি বাড়ি বরাদ্দ দেওয়ার নামে সারা দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা পকেটে ভরেন।
 

প্রিন্স মুসা

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম