Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

সরকারি ব্যয়ে অনিয়ম (শেষ পর্ব)

দুর্নীতির ২৭ হাজার কোটি টাকা উদ্ধার

৫ বছরে লুটপাটের ৬৮ শতাংশই থাকছে আদায়ের বাইরে

Icon

মিজান চৌধুরী

প্রকাশ: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দুর্নীতির ২৭ হাজার কোটি টাকা উদ্ধার

ফাইল ছবি

দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে বের করে নেওয়া সরকারি অর্থ থেকে গত ৫ বছরে আদায় হয়েছে প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা। এ অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হয়েছে। ব্যাংক, জ্বালানি, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী, বিদ্যুৎ, টেলিকমসহ বিভিন্ন উৎস থেকে এ অর্থ ফেরত আনা হয়েছে।

নিরীক্ষা বিভাগের হিসাবে একই সময়ে প্রায় পৌনে এক লাখ কোটি টাকার অনিময় শনাক্ত হয়েছে। ফলে তছরুপের প্রায় ৬৪ শতাংশই থাকছে আদায়ের বাইরে। বছরের পর বছর পার হলেও এ টাকা আদায় হচ্ছে না।

কবে নাগাদ উদ্ধার হবে, আদৌ হবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে আছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) কার্যালয় সূত্রে অর্থ আদায়ের হিসাবটি পাওয়া গেছে।

এদিকে অডিটে চিহ্নিত অনিয়মের অর্থ কম আদায় নিয়ে সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সর্বশেষ সভায় ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। এতে অডিট আপত্তির মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির পর অর্থ আদায় ও তা কোষাগারে জমা দেওয়ার ওপর তাগিদ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সুপারিশ করা হয়েছে।

বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থা থেকে অনিয়ম ও দুর্নীতির অর্থ উদ্ধারের ২০২১ সালের হিসাবটি এখন চূড়ান্ত হয়নি। তবে ২০১৫-২০২০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন খাত থেকে উল্লিখিত অঙ্কের অর্থ উদ্ধার করেছে সিএজি। এর মধ্যে ২০১৯-২০২০ সালে অর্থ উদ্ধারের অঙ্ক ৬ হাজার ৪২১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা এবং ২০১৮-২০১৯ সালে উদ্ধারকৃত টাকার অঙ্ক ৯ হাজার ৭৭৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।

এছাড়া ২০১৭-১৮ সালে সিএজি অফিস অনিয়মের অর্থ উদ্ধার করে ৮ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা, ২০১৬-২০১৭ সালে এ অঙ্ক হলো ৭৩১ কোটি ৯৪ লাখ এবং ২০১৫-২০১৬ সালে ছিল ১ হাজার ৬৮৬ কোটি ৬২ লাখ টাকা। অনিয়মের অর্থ উদ্ধার প্রসঙ্গে সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি রুস্তুম আলী ফরাজী যুগান্তরকে বলেন, অডিট অনিয়মের অর্থ আদায় কিছুটা কমেছে করোনার কারণে।

দীর্ঘদিন কমিটির বৈঠক হচ্ছে না। বৈঠক হলে অডিট আপত্তির সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবদের ডাকা হয়। এতে অনেক অনিয়মের অর্থ উদ্ধার সম্ভব হয়। তিনি বলেন, আদায়ের আরও একটি বড় সমস্যা হচ্ছে অনেকে অবসর জীবনে চলে যান। যদিও আর্থিক অনিয়মের সঙ্গে তারা জড়িত। তবে আমি যদি দেখি আপত্তি সঠিক, তবে সেখানে যে কেউ হোক টাকা আদায় করে থাকি।

তিনি আরও বলেন, গত জানুয়ারিতে নতুন বছরের অডিট রিপোর্ট কমিটিতে আসার কথা। কিন্তু এখনো আসেনি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশ (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, দুর্নীতি ও অনিয়মের অর্থ আদায় আমি মনে করি সিএজি অফিসের একটি ভালো উদ্যোগ। আমরা লক্ষ করছি অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে সিএজি অফিস আগের তুলনায় এখন অনেক তৎপর।

এটি একধরনের সাফল্যের প্রতীক। তবে শুধু সিএজি অফিসের দায়িত্বই শেষ নয়। মন্ত্রণালয়গুলোর উচিত এসবের বিরুদ্ধে আইনগত যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া। অনিয়মের ক্ষতিগ্রস্ত অর্থ আরও উদ্ধার করা। এর সঙ্গে জড়িতদের জবাবদিহিতা ও শাস্তি নিশ্চিত করা।

সূত্রমতে, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া অর্থ থেকে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরা হলো। এর মধ্যে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের একটি আর্থিক অনিয়মের ঘটনা থেকে প্রায় ৪৭ কোটি টাকা উদ্ধার করা হয়।

এছাড়া ব্যাংকিং খাত থেকে ২৮ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। আরও অন্যান্য খাত থেকেও উদ্ধার করা হয় অর্থ। একইভাবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে প্রায় ১১ কোটি, জ্বালানি মন্ত্রণালয় থেকে ৪৮ কোটি, স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে ৩৩ কোটি এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে আদায় হয় ১৩ কোটি টাকা।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে জ্বালানি খাত থেকে ৬৩৯ কোটি টাকা আদায় করা হয়। একই বছরে ব্যাংকিং খাত থেকে ৩৯ কোটি, টেলিকম খাত থেকে ১৫ কোটি এবং বিদ্যুৎ খাত থেকে ১৬ কোটি টাকা আদায় হয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে শুধু টেলিকম খাত থেকে আদায় করা হয় ১ হাজার ৬২৯ কোটি টাকা, স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে ৩৮ কোটি টাকা আদায় করা হয়।

আদায়ের হার কম থাকলেও সিএজি অফিসের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, ২০২০ সালে সিএজি কার্যালয়ের বাজেট ছিল ২৩৭ কোটি ১৩ লাখ টাকা। ওই বছর আদায় করা হয়েছে ৬ হাজার ৪২১ কোটি টাকা। এতে সিএজি অফিস এক টাকা ব্যয়ে করে ২৭ টাকা অর্জন করে।

অডিট আপত্তির পর টাকা আদায় এবং সংশ্লিষ্ট দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনা হয় কি না জানতে চাইলে ডেপুটি কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (হিসাব ও রিপোর্ট) খান মো. ফেরদৌসুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, সিএজির নিরীক্ষা প্রতিবেদন সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেওয়া হয়। রাষ্ট্রপতি জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেন। এরপর এটি সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির কাছে পর্যালোচনার জন্য যায়। ওই কমিটি অর্থ আদায়সহ নানা ধরনের সুপারিশ করে থাকে। সেসময় ওই কমিটির কাছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব জবাবদিহি করেন ।

প্রসঙ্গত, প্রতিবছর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে বাজেটের অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। এই অর্থব্যয়কে ঘিরে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনা ঘটে, যা উঠে আসছে সিএজির নিরীক্ষা প্রতিবেদনে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পর্যালোচনা রিপোর্টে বলা হয়েছে, দুর্নীতির কারণে প্রতিবছর কমপক্ষে ১৮ হাজার কোটি টাকা মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) যোগ হতে পারছে না।

এই হিসাব অবশ্য রক্ষণশীলভাবে করা। তবে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণা তথ্যমতে, সরকারি বিভিন্ন খাতে সেবা পেতে যে অর্থের দুর্নীতি হয়, এর পরিমাণ জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশের মতো হবে।

আর সরকারি বড় বড় কেনাকাটায় যোগসাজশের মাধ্যমে যে দুর্নীতি হয়, তার পরিমাণ হবে জিডিপির ৩ শতাংশের মতো। অর্থাৎ সব মিলিয়ে দুর্নীতির আকার দাঁড়াবে জিডিপির ৫ শতাংশ। তবে সে হারে জড়িতদের শাস্তি ও অর্থ ফেরত বা আদায়ের হার খুবই কম।

দুর্নীতি কোটি টাকা উদ্ধার

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম