ভারতের গম রপ্তানি বন্ধ
আটা-ময়দার দাম বাড়ছে হুহু করে
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৪ মে ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
যুদ্ধের ফলে ইউক্রেনে গম উৎপাদন মারাত্মক ব্যাহত হয়েছে। এ দেশটি থেকে রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিশ্ববাজারে গমের দাম বেড়েছে। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বাজারে গমের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভারত থেকেও গম রপ্তানি বন্ধ করা হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে সরাসরি দেশের বাজারে। হুহু করে বাড়ছে আটা-ময়দার দাম।
এক সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে পণ্যটির দাম ১০-১২ টাকা বেড়েছে। ফলে আটা-ময়দা দিয়ে তৈরি পাউরুটি, বিস্কুট, চানাচুর, নুডলসজাতীয় খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। আবার কোনো কোম্পানি দাম না বাড়ালেও পরিমাণে কমিয়েছে। এতে আগের চেয়ে মানুষের খরচ বেড়েছে।
এদিকে ২০২১ সালের নভম্বর থেকে গমের দাম বাড়তে থাকে। সেপ্টেম্বরে প্রতি টনের দাম ছিল ২৬৪ ডলার। নভেম্বরে তা বেড়ে হয় ৩৩৫ ডলার। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে তা বেড়ে হয় ৫৩৩ ডলার। এপ্রিলে তা আরও বেড়ে হয় ৬৭৩ ডলার। গত ১৩ মে তা বেড়ে ১ হাজার ১৭৮ ডলারে দাঁড়ায়।
শনিবার সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) দৈনিক বাজার পণ্যমূল্য তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে-খুচরা বাজারে সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতিকেজি আটা সর্বোচ্চ ১৩ দশমিক ৭০ শতাংশ ও ময়দার দাম ২ দশমিক ৬৫ শতাংশ বেড়েছে। আর মাসের ব্যবধানে প্রতিকেজি আটা সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ৬৭ শতাংশ ও ময়দার দাম ১৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়া বছরের ব্যবধানে খোলা আটার দাম ৫০ শতাংশ ও খোলা ময়দা ৬৭ শতাংশ বেড়েছে।
সূত্রমতে, অভ্যন্তরীণ বাজারে গমের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাময়িকভাবে পণ্যটি রপ্তানি বন্ধের কথা জানিয়েছে ভারত। তবে শুক্রবার বা তার আগে গম রপ্তানিতে যেসব দেশের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে সেগুলো বহাল থাকবে। শুক্রবার রাতে ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য অধিদপ্তর এক ঘোষণায় এ তথ্য জানায়। এছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনে গম উৎপাদন মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দামও বাড়ছে। আর রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার কারণে মিত্রদেশগুলো রাশিয়া থেকে গম আমদানি করতে পারছে না। এতে ভারত থেকে গম আমদানিতে ঝুঁকেছিল বিশ্বের বহু দেশ। কিন্তু দেশটির স্থানীয় বাজারে গমের দাম ক্রমাগত বৃদ্ধিতে শেষ পর্যন্ত গম রপ্তানি বন্ধের পথে হাঁটল ভারত সরকার।
এদিকে চীন ১৩ কোটি ৪৩ লাখ টন, ভারত ১০ কোটি ৭৬ লাখ টন, রাশিয়া ৮ কোটি ৫৯ লাখ টন, যুক্তরাষ্ট্র ৪ কোটি ৯৭ লাখ টন, কানাডা ৩ কোটি ৮২ লাখ টন ও ইউক্রেন ২ কোটি ৫০ লাখ টন গম উৎপাদন করে। বিশ্বে মোট গমের ৩৪ শতাংশ রপ্তানি করে ইউক্রেন ও রাশিয়া। বর্তমানে দুই দেশের মধ্যকার যুদ্ধের কারণে রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। ইউক্রেনের সামুদ্রিক যোগাযোগ বন্ধ হওয়ায় রপ্তানি করতে পারছে না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করায় তারা গম রপ্তানি করতে পারছে না।
শনিবার রাজধানীর নয়াবাজার ও জিনজিরা কাঁচাবাজারের খুচরা মুদি বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিকেজি খোলা আটা বিক্রি হয়েছে ৪৫ টাকা। যা এক সপ্তাহ আগে ৩৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। খোলা ময়দা বিক্রি হয়েছে ৬০ টাকা কেজি। যা সাত দিন আগে ৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পাশাপাশি দোকানে প্রতিকেজি প্যাকেট আটা বিক্রি হয়েছে ৪৫ টাকা। যা এক সপ্তাহ আগে ৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এছাড়া প্যাকেট ময়দা বিক্রি হয়েছে ৬৫ টাকা কেজি। যা সাত দিন আগে ৫০ টাকা বিক্রি হয়েছে।
রাজধানীর নয়াবাজারে নিত্যপণ্য কিনতে আসা মো. সালমা বেগমের সঙ্গে কথা হলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, কয়েক মাস ধরে আটা ময়দার দাম বাড়ছে। বাজারে এসে দেখি সপ্তাহের ব্যবধানে দাম আরেক দফা বাড়ানো হয়েছে। ব্যয় সামলাতে না পেরে ভোগের পরিমাণও কমিয়ে দিয়েছি।
জিনজিরা কাঁচাবাজারের মুদি বিক্রেতা মো. সাক্কুল আলম যুগান্তরকে বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দুমাস ধরে হক আটা-ময়দার বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এর মধ্যে ভারত থেকে রপ্তানি বন্ধের কারণে আরেক দফা বেড়েছে দাম। সপ্তাহের ব্যবধানে ১০-১২ টাকা বেড়েছে। তিনি জানান, পাইকারি বাজারে যে খোলা আটা ৩২ টাকা কিনেছি তা এখন ৩৭-৩৮ টাকায় কিনতে হচ্ছে। পাশাপাশি খোলা ময়দা ৪৭ টাকা কিনলেও এখন ৫৭ টাকায় কিনতে হচ্ছে। যে কারণে আমাদেরও খুচরা বাজারে বেশি দরে বিক্রি করতে হচ্ছে।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, এমনিতেই মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। এরপর নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে নিুআয়ের মানুষের ওপর বাড়তি চাপ পড়ছে। বাজারে নজরদারির জন্য আমরা সব সময় বলে আসছি। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। তিনি বলেন, ভারত বন্ধ করলেই একদিনে দাম বাড়ার কথা নয়। কিন্তু কী কারণে দাম বাড়ছে তা খতিয়ে দেখা উচিত। এ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা কারসাজির মাধ্যমে বাড়ালে, তাদের খুঁজে বের করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
এদিকে আটা-ময়দার দাম বাড়ার কারণে কোনো কোনো প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের দাম বেড়েছে। অনেক কোম্পানি দাম না বাড়ালেও পরিমাণে কমানো হয়েছে। এছাড়া রাস্তার পাশের হোটেলগুলোতে প্রতি পিস পরোটা ৫ টাকা বিক্রি হলেও এখন ১০ টাকা বিক্রি করছেন। পাশাপাশি যেসব হোটেল দাম বৃদ্ধি করেনি তারা পরোটার আকার সংকুচিত করেছেন। এছাড়া কোম্পানিভেদে প্যাকেট বিস্কুটের দাম ১০ থেকে ২০ টাকা বেড়েছে। পাশাপাশি চানাচুর, নুডলসসহ সব খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে। খুচরা বিক্রেতারা জানান, দোকানে ১৫০ গ্রাম ওজনের বোম্বে সুইটসের চানাচুর ১০ টাকা বেড়ে ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ৪৯৬ গ্রাম ওজনের ১৩০ টাকা দামের নুডলস বিক্রি হচ্ছে ১৪৫ টাকায়।
জানতে চাইলে কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতির কারণে সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। যে কারণে সরকারকে এখন থেকেই সজাগ ভূমিকা পালন করতে হবে। এখন থেকেই প্ল্যান করে পণ্য আমদানি ও রপ্তানি করতে হবে। কোন পণ্যের মজুত বাড়াতে হবে তা এখন থেকেই কার্যকর করতে হবে। কোন পণ্যে কী পরিমাণে ভ্যাট-ট্যাক্স মওকুফ করতে হবে তা সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
