Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

মামলা না করে লাশ নেবে না পরিবার

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ২১ আগস্ট ২০২২, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মামলা না করে লাশ নেবে না পরিবার

হাতিরঝিল থানা হেফাজতে স্বামী সুমন শেখ ওরফে রুমন (২৬) আত্মহত্যা করেছেন। দুদিন ধরে লাশ পড়ে আছে মর্গে। সাত বছর বয়সি একমাত্র পুত্রসন্তানকে নিয়ে থানা, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গ ও আদালতের বারান্দায় ঘুরছেন রুমনের স্ত্রী জান্নাত আরা। স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ তুলে তিনি এর বিচার চান।

লাশ নিতে পুলিশ শর্ত জুড়ে দিয়েছে এমন অভিযোগ করে জান্নাত আরা ও তার স্বজনরা জানিয়েছেন, পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা না করে তারা লাশ নেবেন না।

এদিকে রোববার সন্ধ্যা ৭টার পর থেকে রামপুরায় হাতিরঝিল অংশে সড়ক অবরোধ করেন সুমন শেখের স্বজন ও এলাকাবাসী। এতে সড়কের দুই পাশে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। রাত সাড়ে ৯টার পর পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়।

দুদিন ধরে কাঁদতে কাঁদতে চোখের জল শুকিয়ে গেছে জান্নাত আরার। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না অন্য স্বজনরাও।

এদিকে থানা হাজতে মৃত্যু নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। এ ব্যাপারে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নুর খান লিটন যুগান্তরকে বলেন, তিনি পুলিশি হেফাজতে ছিলেন। সুতরাং তাকে হত্যা করা হোক বা আত্মহত্যা করুক-এটা তদন্ত করে দেখা উচিত। যদি কারও গাফিলতি প্রমাণিত হয় বা কারও দ্বারা যদি সে নির্যাতনে মৃত্যুবরণ করে থাকে তাহলে এ ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়াটা জরুরি। তিনি বলেন, ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের একটি নির্দেশনা খুব জরুরি, সেটা হচ্ছে হাজতখানায় এমন কোনো অবস্থা রাখা উচিত নয় যে অবস্থায় একজন বন্দি আত্মহত্যা করতে পারে।

তবে এ ব্যাপারে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার যুগান্তরকে বলেন, ঢাকা শহরের অধিকাংশ থানাই ভাড়া বাসায় চলে। পাবলিক জায়গায় থানা হওয়ায় এগুলোর হাজতখানা একভাবে তৈরি করা হয়েছে। থানা হাজতের যে নির্দেশিত ফরম্যাট রয়েছে, এতে ঝোলার কোনো সিস্টেম নেই। এটি অনেক উঁচু থাকে। পাশাপাশি ঝোলার মতো কোনো উপাদান থাকে না। আমরা তো আসলে জায়গার অভাবে সেইভাবে থানা কমপ্লেক্স তৈরি করতেই পারছি না।

লাশ নিতে শর্ত দেয়ার অভিযোগটি নাকচ করে লাশ হস্তান্তরের ব্যাপারে তিনি বলেন, আমি তেজগাঁওর ডিসির সঙ্গে কথা বলেছি ওদেরকে ডেকে মরদেহ বুঝিয়ে দিতে। সকাল থেকে ওরা পুলিশের ফোন ধরছে না। ওরা আদালতে গিয়ে বসে আছে।

স্বামীকে হারিয়ে শোকবিহ্বল জান্নাত আরা বলেন, এখন আমি আমার শিশুসন্তানকে নিয়ে কোথায় যাব। কোথায় দাঁড়াব। টাকা লাগলে টাকা দেব। আমি আমার স্বামীকে ফেরত চাই। এ হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার চাই। তিনি আরও বলেন, থানায় মামলা করতে গিয়েছিলাম। থানা মামলা নেয় না। মরদেহ আনতে গিয়েছিলাম। কিন্তু পুলিশ মরদেহ দেয়নি। তারা বলছে, মরদেহ যদি ঢাকার নবাবগঞ্জের দড়িকান্দি গ্রামের বাড়ি নেওয়া হয়, তাহলে দেওয়া হবে। কিন্তু পশ্চিম রামপুরার বাসায় নেওয়া হলে দেওয়া হবে না। মূলত রামপুরার বাসায় লাশ নেওয়া হলে স্থানীয় ও স্বজনদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হবে এমন আশঙ্কা পুলিশের। সেই আশঙ্কা থেকেই পুলিশ লাশ দিতে চাচ্ছে না এমন অভিযোগ নিহতের স্বজনদের।

মরদেহ না পেয়ে রোববার আদালতে মামলা করতে যান সুমনের স্ত্রী ও স্বজনরা। সন্ধ্যা ৬টায় সুমন শেখের সম্বন্ধী (স্ত্রীর বড় ভাই) মোশাররফ যুগান্তরকে বলেন, আমরা সারাটা দিন আদালতের বারান্দায় ঘুরেছি। কোনো আইনজীবী পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করতে চান না। অন্তত ১৫ জন উকিলের কাছে গিয়েছি। আজ সময় শেষ হওয়ায় আমরা চলে এসেছি। কাল (সোমবার) আবারও আদালতে যাব।

এ ব্যাপারে তেজগাঁও বিভাগের ডিসি আজিমুল হক যুগান্তরকে বলেন, আমরা লাশ নিতে বারবার সুমন শেখের স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছি। তারা ফোনও ধরছে না। লাশ নিতেও আসছে না। লাশ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে রাখা আছে।

সুমনের স্বজনরা জানান, সুমনের বাসা পশ্চিম রামপুরার ওয়াপদা রোডে। তিনি মেসার্স মাসুদ অ্যান্ড ব্রাদার্স নামে ইউনিলিভারের পিওরইট ওয়াটার পিউরিফায়ার ডিস্টিবিউটর প্রতিষ্ঠানে ৬ বছর ধরে কর্মরত ছিলেন। বেতন পেতেন ১২ হাজার টাকা। ভাড়া বাসায় থাকতেন। গত বছর তার মা মারা যান। বাবা পিয়ার আলী পেশায় রিকশাচালক। শুক্রবার বিকালে মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ওয়াপদা রোডের বাসায় মিলাদ মাহফিলের অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিলেন সুমন। বিকাল ৪টার দিকে হাতিরঝিল থানা পুলিশ চুরির মামলায় তাকে বাসা থেকে গ্রেফতার করে। পরে থানা হাজতখানায় রেখে দেওয়া হয়। শনিবার সেখান থেকে তার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় ওইদিন তার স্বজন ও এলাকাবাসী হাতিরঝিল থানার সামনে বিক্ষোভ করেন।

পুলিশ বলছে, সুমন হাজতখানার লোহার গ্রিলের সঙ্গে গলায় পরনের প্যান্ট প্যাঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। সিসি ক্যামেরা ফুটেজে আত্মহননের দৃশ্য স্পষ্ট। স্বজনদের অভিযোগ, পুলিশের দায়িত্বে অবহেলার কারণে সুমনের মৃত্যু হয়েছে। যথাযথ দায়িত্ব পালন করলে তিনি গলায় ফাঁস দেওয়ার সুযোগ পেতেন না কোনোভাবেই।

পুলিশের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ডিউটি অফিসার এবং সেন্ট্রির ডিউটিরত পুলিশ সদস্যের অবহেলা ছিল। মূলত এ কারণেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তাদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হলে তারা যুগান্তরকে জানান, থানায় যেসব পুলিশ সদস্য ডিউটি করেন, তাদের হাজতখানায় আসামি দেখভাল করার কথা। আসামি ভেতরে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটাচ্ছে কিনা, সেটিও দেখার দায়িত্ব তাদের।

হাতিরঝিল থানার ওসি আব্দুর রশিদ বলেন, রামপুরার মেসার্স মাসুদ অ্যান্ড ব্রাদার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে নগদ ৫৩ লাখ ৫২ হাজার ৭২০ টাকা এবং একটি ডিভিআর চুরি হয় মর্মে ১৫ আগস্ট থানায় মামলা করেন প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার মোসলেম উদ্দিন মাসুম। এ প্রেক্ষিতে তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের দেয়া স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হয় প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী সুমন শেখকে।

সুমন শেখের আসল নাম রুমন : হাতিরঝিল থানা হাজতে মারা যাওয়া যুবকের প্রকৃত নাম সুমন শেখ নয়। তার নাম রুমন। তার বড় ভাইয়ের নাম সুমন শেখ। তার জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ছিল না। তাই বড় ভাই সুমন শেখের এনআইডি ব্যবহার করে চাকরি নিয়েছিলেন তিনি। স্বজনরা জানান, তখন থেকেই রুমন হয়ে যান সুমন শেখ। অফিস এবং থানায়ও এখন সুমন শেখই লেখা হচ্ছে।

বিচারের দাবিতে সড়ক অবরোধ : হাতিরঝিল থানাহাজতে সুমন শেখের মৃত্যুর ঘটনায় বিচারের দাবিতে রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৮টার দিকে রামপুরা ডিআইটি রোড এলাকায় সড়কের পশ্চিম পাশে অবরোধ ও মানববন্ধন করেন এলাকাবাসী ও নিহতের স্বজনরা। তারা সুমন শেখকে হত্যা করা হয়েছে-এমন দাবি তুলে হাতিরঝিল থানা পুলিশের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। এ ব্যাপারে রামপুরা থানার ওসি রফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, হাতিরঝিল অংশে সড়ক অবরোধ করেছে এলাকাবাসী। আমরা তাদের বুঝিয়ে সরিয়ে রাত পৌনে ১০টায় যান চলাচর স্বাভাবিক করেছি। ঘটনাস্থল থেকে হারুন নামের এক যুবক যুগান্তরকে বলেন, ‘একটা জ্বলজ্যান্ত মানুষকে থানায় নিয়ে পুলিশ মেরে ফেলল, আমরা এর বিচার না পাওয়া পর্যন্ত আন্দোলন করব।’

মামলা লাশ পরিবার

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম