কৃষি মার্কেট এখন ধ্বংসস্তূপ
আগুন নিভল ২৮ ঘণ্টায়
মাহমুদুল হাসান নয়ন
প্রকাশ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে কৃষি মার্কেটের আগুন ২৮ ঘণ্টা পর পুরোপুরি নিভেছে। শুক্রবার সকাল সাড়ে ৭টায় ফায়ার সার্ভিস আগুন নির্বাপণের ঘোষণা দেয়। এরমধ্যে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে পুরো মার্কেট। আগের জমজমাট বাজারে নেই ক্রেতা-বিক্রেতার কোলাহল। আছে শুধু পোড়া গন্ধ আর নিঃস্ব ব্যবসায়ীদের হাহাকার। একটি সুতাও রক্ষা করতে না পারা ব্যবসায়ীরা এখন দিশেহারা। জানেন না কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবেন। সরকারের পক্ষ থেকে সামান্য সহায়তার কথা বলা হলেও তা ক্ষতির তুলনায় অতি সামান্য। এ অবস্থায় অস্থায়ীভাবে ব্যবসা পরিচালনা করতে চান তারা। ঘটনা তদন্তে এবং পুড়ে যাওয়া মার্কেটটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)।
বুধবার রাত ৩টা থেকে সাড়ে ৩টার দিকে আগুনের সূত্রপাত। প্রায় ৬ ঘণ্টা পর বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা ২৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এরমধ্যে পুড়ে যায় সাড়ে তিনশ দোকান। তবে গভীর রাতে আগুন লাগায় এবং মার্কেটে কেউ না থাকায় কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। এরপর বৃহস্পতিবার সারা দিনই থেমে থেমে জ্বলছিল আগুন। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতার ঘাটতির কারণেই আগুন পুরোপুরি নেভাতে এত বেশি সময় লেগেছে। অনেক ব্যবসায়ী আবার মার্কেট কমিটির বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-অব্যবস্থাপনারও অভিযোগ তুলেছেন।
ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. শাহজাহান শিকদার যুগান্তরকে বলেন, আগুনে মার্কেটটির টিনশেডের কাঠামো ভেঙে পড়ে। ভঙ্গুর কাঠামোর মাঝ থেকেই বিভিন্ন স্থানে আগুন জ্বলে উঠছিল। পরে প্রতিটি জায়গা খুঁজে বের করে আগুন নেভানোর কাজ করেন ফায়ার সার্ভিসকর্মীরা। এজন্যই আগুন পুরোপুরি নেভাতে সময় লেগেছে। তবে নিয়ন্ত্রণে এসেছে অনেক আগেই। আমাদের প্রচেষ্টার কারণেই আগুন ছড়াতে পারেনি।
শুক্রবার সরেজমিন দেখা যায়, আগুনে পুড়ে যাওয়া ধ্বংসস্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন অনেক ব্যবসায়ী। অনেকে আবার তিল তিল করে গড়ে তোলা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ছাই নেড়েচেড়ে দেখছেন। পরিবার নিয়ে এসেছেন কেউ কেউ। চোখের সামনে দোকান পুড়ে যেতে দেখে এখনো স্বাভাবিক হতে পারছেন না অনেকে। হাউমাউ করে কাঁদছিলেন কেউ কেউ। এদিন কাঁচামালসহ বিভিন্ন দোকানের কিছু জিনিসপত্র নিয়ে যেতে দেখা গেছে স্থানীয় অনেককে। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা। চরম দুর্দিনেও এক শ্রেণির মানুষের এমন লুটপাটের মানসিকতায় হতাশ তারা।
মার্কেটের ১৭নং দোকান মিজানুর ট্রেডার্স। এর মালিক মিজানুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, কীভাবে সামনের দিনগুলো চলবে বুঝতে পারছি না। দোকানে ৭-৮ লাখ টাকার মালামাল ছিল। একটা সুতাও বের করতে পারিনি। প্রতিদিন ২০-৩০ হাজার টাকার বেচাবিক্রি হতো। এখন তো আমাদের কিছুই নেই। অনেকেই এসে অনেক ধরনের তালিকা করছেন। জানি না এ তালিকা দিয়ে সর্বশেষ কী হবে। এই মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে বেশি দরকার ব্যবসাটা চালু করতে পারা। এটি করতে পারলে আমরা ধীরে ধীরে কিছুটা হলেও ঘুরে দাঁড়াতে পারব। শুক্রবার কৃষি মার্কেটের সামনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তালিকা করছিল সরকারের বিভিন্ন সংস্থা।
ব্যবসায়ীরা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে তালিকায় নিজেদের নাম অন্তর্ভুক্ত করছিলেন। ঢাকার জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান বলেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের একটি তালিকা করব। তারপর সরকারের পক্ষ থেকে তাদের মানবিক সহায়তা করার চেষ্টা করব।
ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) মো. সেলিম রেজা শুক্রবার যুগান্তরকে বলেন, আমরা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। এ ঘটনায় অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. শরীফ উদ্দীনকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদন পেলে আমরা মার্কেটের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। ব্যবসায়ীদের দাবি অনুযায়ী অস্থায়ী ভিত্তিতে কোনো কিছু করার চিন্তা আছে কিনা-এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এখনো এমন কোনো চিন্তা নেই। প্রতিবেদন পেলে মার্কেটটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
মার্কেট কমিটির বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ : যুগান্তরের মোহাম্মদপুর (ঢাকা) প্রতিনিধি জানান, ব্যবসায়ীদের অনেকেই জানিয়েছেন, মাত্র চারজন সিকিউরিটি গার্ড দিয়ে চলত কৃষি মার্কেটের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। আগুন লাগার রাতে মার্কেটের কলাপসিবল গেট ভাঙতে ভাঙতেই সব পুড়ে ছাই হয়ে যায়। আগুনের খবর পেয়েই মার্কেটে ছুটে আসেন ব্যবসায়ীরা। এ সময় মার্কেটে প্রবেশের ৮টি কলাপসিবল গেট বন্ধ ছিল। আগুন লাগার প্রায় ঘণ্টাখানেক পার হয়ে গেলেও কোনো নিরাপত্তারক্ষীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এজন্য ফায়ার সার্ভিসের কোনো কর্মী মার্কেটের ভেতরে প্রবেশ করতে পারছিলেন না। ফলে পুরো মার্কেটে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। পরে ব্যবসায়ীরা কলাপসিবল গেটের তালা ভাঙেন। এছাড়া মার্কেটের বর্তমান কমিটির বিরুদ্ধে টাকা আত্মসাৎ করে মার্কেটের জন্য কাজ না করারও অভিযোগ তাদের।
দুটি দোকানের মালিক ব্যবসায়ী এমএ লতিফ বলেন, আগুন লাগার খবরে ছুটে এসে দেখি, মার্কেটের ৮টি কলাপসিবল গেটই তালাবদ্ধ। এতে কেউ ভেতরে প্রবেশ করতে না পারায় আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
আব্দুল বদি নামে আরেক ব্যবসায়ী বলেন, মার্কেটের বর্তমান কমিটি মার্কেট থেকে টাকা তুলে আত্মসাৎ করেছে। মার্কেটের জন্য কোনো কাজ করেনি। কাগজে-কলমে ২১ জন নিরাপত্তারক্ষী থাকলেও নামে মাত্র চারজন নিরাপত্তারক্ষী ডিউটি করেন। ঘটনার রাতেও আগুন লাগার পর মার্কেটে কোনো নিরাপত্তারক্ষী ছিলেন না।
এছাড়া নাজিম হোসেন শিপলু, লতিফ মাস্টার, আজিজ মিয়াসহ প্রায় অর্ধশত ব্যবসায়ী একই রকম অভিযোগ করেন। এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট কাঁচাবাজার ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি সলিমুল্লাহ সলুর মোবাইল ফোনে দফায় দফায় কল দেওয়া হয়। খুদে বার্তা পাঠানো হয়। কিন্তু তিনি কোনো সাড়া দেননি। সমিতির সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান মিয়া চাঁন মিয়া মোবাইলে যুগান্তরকে বলেন, আমি শারীরিকভাবে খুবই অসুস্থ। আমি কোনো কথা বলতে পারব না। আপনি এ বিষয়ে আমাদের সভাপতির সঙ্গে কথা বলেন।
পরিদর্শনে কৃষিমন্ত্রী : শুক্রবার দুপুর ১২টায় কৃষি মার্কেট পরিদর্শনে যান কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক। এ সময় বঙ্গবাজারের মতো অস্থায়ী ভিত্তিতে দ্রুত মার্কেট চালুর দাবি জানান ব্যবসায়ীরা। তারা বলেন, ত্রাণ দিয়ে এই ক্ষতি পোষানো যাবে না। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি দরকার বেচাবিক্রি চালুর একটা ব্যবস্থা করা।
কৃষিমন্ত্রী বলেন, এ মার্কেটের ব্যবসায়ীরা অধিকাংশই মধ্যবিত্ত ও নিু মধ্যবিত্ত। আমাদের সবার চোখের সামনেই এই বাজারটি গড়ে উঠেছে। হঠাৎ করে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এত বড় একটা ক্ষতি হয়ে গেল। পুরো মার্কেটের প্রায় পাঁচ থেকে ছয়শ পরিবার একদম সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে। তারা যেন অর্থনৈতিকভাবে আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারেন, আমরা সরকারের পক্ষ থেকে সে সহযোগিতা করব। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে সর্বাত্মক সহযোগিতা করব। কৃষি মার্কেটের বিষয়ে আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেছি। তিনিও এ বিষয়ে অবগত আছেন।
