‘মায়ের ডাক’র সমাবেশ
‘আমাদের চোখের পানি শুকিয়ে গেছে’
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
‘স্বজন হারিয়ে ১০ বছর ধরে আমরা কাঁদছি। কাঁদতে কাঁদতে আমাদের চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। গুমের শিকার ৬৭৫ জনের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না।’ শনিবার রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে গুম, খুন, ক্রসফায়ার ও কারা নির্যাতন বন্ধের দাবিতে ‘মায়ের ডাক’ আয়োজিত সমাবেশে রাজনৈতিক মতাদর্শগত কারণে গুম ও খুন ব্যক্তির স্বজনরা এমন সব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে ২০১৩ সালে গুমের শিকার সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের সভাপতি সেলিম রেজা পিন্টুর বোন রেহানা বানু মুন্নী বলেন, আপনি তো মাদার অব হিউম্যানিটি; মানবতার মা; আপনি রোহিঙ্গাদের সাহায্য করেছেন। তবে আমাদের কান্না কি আপনি শুনতে পান না? ১০ বছর ধরে আমরা কাঁদছি, কেন আপনি শুনছেন না? কাঁদতে কাঁদতে আমাদের চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, আমার ভাইকে ২০১৩ সালের ১১ ডিসেম্বর মাঝরাতে বাসা থেকে তুলে নেওয়া হয়। এখনো ভাইয়ের কোনো খোঁজ নেই। আমার বাবা মারা গেছেন, মাও মৃত্যুপথযাত্রী। তিনি আরও বলেন, কথা বলতে শাহবাগে আমরা দাঁড়িয়েছিলাম-কেন টেনেহিঁচড়ে সেখান থেকে আমাদের তাড়িয়ে দিলেন? আমরা কি এ দেশের নাগরিক নই?
মায়ের ডাকের সমাবেশ শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পুলিশি বাধায় সেখানে সমাবেশ করতে না পেরে মিছিল নিয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ করে সংগঠনটি। ২০১৩ সালে গুম হওয়া বংশাল থানা ছাত্রদল সহসভাপতি মোহাম্মদ সোহেলের মেয়ে সাফা বলেন, ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর আমার বাবাকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গুম করা হয়েছে। রাস্তায় রাস্তায় বাবাকে খুঁজেছি, পাইনি। সরকারের কাছে একটাই দাবি, আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিন। বাবাকে ছাড়া আর কিছুই চাই না। নিউমার্কেট থানা ছাত্রদলের সভাপতি বাচ্চুর বোন ঝুমুর আক্তার বলেন, ২০১৪ সালে আমার ভাইকে নির্যাতন করে মেরে ফেলা হয়েছে, আমাকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল। তিনি বলেন, আমরা এ কেমন স্বাধীন দেশে বাস করছি। যেখানে ভাইয়ের জন্য বোন, ভাইয়ের জন্য ভাই, বাবার জন্য ছেলে জেল খাটে? তিনি বলেন, আমার ভাইকে তো মেরে ফেলা হয়েছে। কিন্তু যাদের ভাই গুম হয়েছেন, তাদের আমরা ফেরত চাই। সমাবেশে গুমের শিকার বংশাল থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক পারভেজ হোসেনের স্ত্রী ফারহানা আক্তার, গাড়িচালক কাউসার হোসেনের মেয়ে লামিয়া আক্তার মীম বক্তব্য দেন।
ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা সমাবেশে বক্তব্য দেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেন, তারা (সরকার) হেলমেট বাহিনী, লাঠিয়াল বাহিনী বানিয়ে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে ঘরে ঘরে মানুষকে অত্যাচার করছে, হত্যা করছে। এর কোনো বিচার নেই। আন্দোলনে শ্রমিক মারা গেলেও কোনো কথা বলা হচ্ছে না। এ হলো আজকে আমাদের অবস্থা। তিনি আরও বলেন, নতুন করে পাতানো নির্বাচনের খেলা খেলছে। নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ১০ বছরে আমরা কতবার প্রেস ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়েছি, কতবার কথা বলেছি। আমাদের মানবতার ডাক সরকারের কানে যায়নি। এখন মানুষের সব মানবিক অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার, মৌলিক অধিকার, ভোটের অধিকার হরণ করে তারা (সরকার) একটি তামাশা তৈরির চেষ্টা করছে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, গুম-খুন চলছে, বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড চলছে, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গায়েবি, মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেফতার করে নির্যাতন করা হচ্ছে। নিু আদালতকে দিয়ে ফরমায়েশি সাজা দেওয়া হচ্ছে। গণঅধিকার পরিষদের (একাংশ) সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, জনগণের ওপর সরকার ইট-পাথরের মতো চেপে বসে ভিন্নমত দমন করছে, নির্যাতন-নিপীড়ন করে দেশ চালাচ্ছে। গণতন্ত্রের জন্য যারা আন্দোলন করছে তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, মামলা দেওয়া হচ্ছে। বিচারের নামে প্রহসন করা হচ্ছে। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, মায়ের ডাকের মতো অরাজনৈতিক সংগঠনের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি নিয়ে পর্যন্ত তারা (সরকার) ভয় পাচ্ছে। সরকারের এ তৎপরতার তীব্র নিন্দা জানাই, কঠোর সমালোচনা করি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সিনিয়র সহসভাপতি তানিয়া রব বলেন, আমাদের কেন শাহবাগে দাঁড়াতে দেওয়া হলো না? আমরা কি দেশের নাগরিক নই? মায়ের ডাকের যে ক্রন্দন, দুঃখ, আক্ষেপ তা নিয়ে কি আমরা কোথাও দাঁড়াতে পারব না?
সভাপতির বক্তব্যে ‘মায়ের ডাক’র সমন্বয়কারী আফরোজা ইসলাম আঁখি বলেন, স্বজনদের ফিরে পেতে ও বিচারের দাবিতে ১০-১২ বছর ধরে আমরা রাজপথে আছি। তিনি আরও বলেন, গায়েবি মামলা দিয়ে বাসা থেকে অনেককে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কারাগারে নির্যাতন করা হচ্ছে। অনেককে না পেয়ে তাদের স্বজনদের, বাবা, ভাই ও স্ত্রীকে সন্তানসহ কারাগারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এগুলোর বিচার ও তাদের ফিরে পাওয়ার দাবিতে আমরা রাজপথে দাঁড়িয়েছি। এ সরকারের নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য আমরা রাজপথে দাঁড়িয়েছি।
