আজ ট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু
জালিয়াতিতে ‘সহজ ডটকম’
শিপন হাবীব
প্রকাশ: ২৪ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আসন্ন পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে আজ থেকে ট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হচ্ছে। ৩০ মার্চ পর্যন্ত চলবে এ কার্যক্রম। ফিরতি টিকিট পাওয়া যাবে ৩ থেকে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত। ঈদ স্পেশালসহ ১২৫টি আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিট শতভাগ অনলাইনে বিক্রি হবে। টিকিট বিক্রি থেকে শুরু করে যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘সহজ ডটকম’র কব্জায়ই থাকছে। যাত্রীসেবা ও নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা বলছেন, রেলে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন একের পর এক দৃশ্যমান হচ্ছে। আমূল পরির্বতনও আসছে। কিন্তু ট্রেনের টিকিট বিক্রির পুরো কার্যক্রমই বেসরকারি সংস্থার হাতে থাকছে। টিকিট কালোবাজারি কিংবা জালিয়াতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার প্রমাণও মিলছে বেসরকারি সংস্থাগুলোর। বর্তমানে ‘সহজ ডটকম’ কিংবা আগের ‘সিএনএস’ উভয় সংস্থা দুটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী একাধিকবার গ্রেফতারও হয়েছেন। সহজের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী লাগাতারই গ্রেফতার হচ্ছেন। এদের মাধ্যমে পুরো রেলে সফটওয়্যার চক্র গড়ে উঠেছে। যে চক্র টিকিট কালোবাজারি নিয়ন্ত্রণ করছে। যদিও রেল কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে এখনও উদাসীন বলে অভিযোগ। এ পরিস্থিতিতেই আজ থেকে ঈদের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু।
টিকিট জালিয়াতির সঙ্গে সম্পৃক্ত সহজের ৯ জনকে শুক্রবার গ্রেফতার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। কমলাপুর স্টেশনে কর্মরত এক রেল কর্মকর্তা জানান, সহজের লোকজনকে বেশ কয়েকবার গ্রেফতার করা হয়েছে। এ অবস্থায় টিকিট বিক্রি কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। লোকস্বল্পতায় ভুগছে সহজ অফিস। র্যাব সূত্র বলছে, শুধু ঢাকা রেল ডিভিশন নয়, এ সফটওয়্যারের জাল ছড়িয়ে রয়েছে দেশজুড়ে। গোটা কারবার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। যদিও র্যাব কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অন্য সব স্টেশনে (যেসব স্টেশনে সহজ দ্বারা টিকিট বিক্রি নিয়ন্ত্রিত) অভিযানে নামছেন না-অভিযোগ সাধারণ যাত্রীদের।
এ প্রসঙ্গে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল-মঈন শনিবার বিকালে যুগান্তরকে বলেন, ‘ট্রেন ভ্রমণে টিকিট প্রাপ্তিটা যথাযথ নিয়মে হবে, এমনটা সবাই চাচ্ছে। টিকিট যার ভ্রমণ তার, এমন আশায় সাধারণ যাত্রীরা টিকিট কাটতে চান। টিকিটসংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করছে সহজ ডটকম। কিন্তু তাদের লোকজনই যদি টিকিট কালোবাজারি-জালিয়াতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকেন-সেটি নিশ্চয় চরম অপরাধ। আমরা একাধিকবার তাদের গ্রেফতার করেছি। শুক্রবারও ৯ জন গ্রেফতার হয়েছেন। যেসব রেলস্টেশনে সহজ দ্বারা টিকিট কার্যক্রম নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে-অভিযান সেখানেও পরিচালিত হবে, হচ্ছেও। চক্রের সদস্যরা ঢাকা থেকেই সব নিয়ন্ত্রণ করে। আমরা আশা করি, টিকিট নিয়ে জালিয়াতি পুরোপুরি বন্ধ হবে। এজন্য রেলকেও যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। আমরা মাঠে আছি-থাকব।
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, কাউন্টার ঘিরে এক প্রকার উদ্বেগ বিরাজ করছে। সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ঘোরাফেরা করছেন। চট্টগ্রামগামী যাত্রী জান্নাতুল বারি কেকা জানালেন, ঈদের আগেই তিনিসহ পরিবারের ৬ সদস্য ট্রেনে চট্টগ্রাম যাচ্ছেন। শত চেষ্টায় অগ্রিম টিকিট পাবেন না, এমনটা ধরেই নিয়েছেন। র্যাবের অভিযান নিশ্চয় প্রশংসনীয়, তবে তা যেন চলমান থাকে এ দাবি তার। রেলে এত উন্নয়ন, টিকিট বিক্রয়ে কেন পিছিয়ে। সক্ষমতা নেই কেন। এমন প্রশ্ন শুধু কেকার নয়, বহু যাত্রীরও।
রেলওয়ে অপারেশন ও পরিবহণ দপ্তর সূত্র বলছে, ঈদ উপলক্ষ্যে পুরো দেশে ১০৯টি আন্তঃনগর এবং ঈদ স্পেশাল ১৬টি ট্রেন চলবে। ঢাকা থেকে ছেড়ে যাবে ৮২টি আন্তঃনগর এবং ৬৭ জোড়া মেইল, লোকাল ও কমিউটার ট্রেন। অনলাইনে টিকিট বিক্রি হবে শুধু আন্তঃনগর ট্রেনের। বাকি ট্রেনের টিকিট বিক্রি হবে বিভিন্ন স্টেশন কাউন্টার থেকে। ২৪ মার্চ ৩ এপ্রিলের অগ্রিম টিকিট বিক্রি হবে। ২৫, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯ এবং ৩০ মার্চ পর্যন্ত ৪, ৫, ৬, ৭, ৮ এবং ৯ এপ্রিলের অগ্রিম টিকিট বিক্রি হবে। অনলাইনে প্রতিদিন ঢাকা থেকে ৩৩ হাজার ৫০০ টিকিট বিক্রি হবে। মেইল, লোকাল ও কমিউটার ট্রেনের ২৬ হাজার টিকিট বিক্রি হবে কাউন্টার থেকে। প্রতিদিন সকাল ৮টায় পশ্চিমাঞ্চলে চলা ট্রেনের টিকিট বিক্রি শুরু হবে। দুপুর ২টায় শুরু হবে পূর্বাঞ্চলের ট্রেনগুলোর টিকিট বিক্রি।
র্যাব সূত্র বলছে, টিকিট কালোবাজারি রোধে সাধারণ ট্রেন যাত্রীদেরও সচেতন হতে হবে। কালোবাজারিদের কাছ থেকে টিকিট কেনা বন্ধ করতে হবে। কালোবাজারিদের কাছ থেকে টিকিট কেনাও অপরাধ।
সূত্র বলছে, বিশেষ করে ঈদ, পূজা, সাপ্তাহিক ছুটিসহ বিশেষ দিনকে উপলক্ষ্য করে সহজ ঘিরে গড়ে ওঠা চক্রটি কারসাজির মাধ্যমে সাধারণ সময়ের তুলনায় বেশি পরিমাণ টিকিট সংগ্রহ করে। শুক্রবার গ্রেফতার মিজান ও সোহেল প্রতিবছর ঈদ মৌসুমে টিকিট কালোবাজারি করতেন। চক্রটি সহজ ডটকমের কর্মচারী ও টিকিট কাউন্টারম্যানদের মাধ্যমে প্রায় ২-৩ হাজার টিকিট কালোবাজারির মাধ্যমে বিক্রি করত।
অভিযোগ রয়েছে, সারা দেশে ১০৩টি স্টেশনে সহজ ডটকম টিকিট কার্যক্রম পরিচালনা করে। ওই সব স্টেশন ঘিরেও কালোবাজারি চক্র গড়ে উঠেছে। কখনও কখনও কমলাপুর স্টেশনে অভিযান চললেও অন্তরালেই থাকে বাকি স্টেশনগুলো। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেটসহ বড় স্টেশনগুলোতে চলে টিকিট কালোবাজারি। কার মোবাইল নাম্বার কিংবা এনআইডি কার্ডে টিকিট কাটা হয়, তা সংশ্লিষ্ট মোবাইল ও এনআইডি কার্ডধারী ব্যক্তি জানতে পারে না।
সহজ ডটকমের জনসংযোগ কর্মকর্তা সন্দ্বীপ দেবনাথ বলেন, ‘সহজ টিকিট বিক্রি করে না। কালোবাজারির সঙ্গেও জড়িত নয়। সহজ সফটওয়্যার বিষয়টি দেখে। টিকিট বিক্রি করে রেলওয়েসংশ্লিষ্টরা। সারা দেশে ১০৩টি স্টেশনে সহজ কাজ করছে।’ বিভিন্ন সময় সহজের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের গ্রেফতার করা হচ্ছে কেন ওটা জানি না। আমি তো বলেছি সহজ সরাসরি টিকিট বিক্রি করে না।’
ঢাকা রেলওয়ে বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা শাহ আলম কিরণ শিশির যুগান্তরকে জানান, ২৪ মার্চ থেকে ট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হচ্ছে। ওই দিন ৩ এপ্রিলের অগ্রিম টিকিট বিক্রি হবে। সকাল ৮টা ও দুপুর ২টা থেকে শতভাগ টিকিট অনলাইনে বিক্রি শুরু হবে। ঈদ ফিরতি অগ্রিম টিকিট বিক্রি হবে ৩ এপ্রিল থেকে। ৩ এপ্রিল বিক্রি হবে ১৩ এপ্রিলের ফিরতি অগ্রিম টিকিট। ঈদে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহণে চলমান ট্রেনের সঙ্গে আরও ৮ জোড়া ঈদ স্পেশাল ট্রেন চালানো হবে। তিনি বলেন, কালোবাজারিরা টিকিট রঙিন ফটোকপি করেও বিক্রি করছে। আমরা যখন ট্রেনে চেকিং করছি-এমন বহু যাত্রীর হাতে নকল ফটোকপি টিকিট পাচ্ছি। জরিমানা করছি। এ ক্ষেত্রে কালোবাজারিদের কাছ থেকে টিকিট ক্রয় না করতে তিনি অনুরোধ করেন।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. হুমায়ুন কবির বলেন, এবার টিকিট কালোবাজারি রোধে সর্বোচ্চ অবস্থানে থাকবে সংশ্লিষ্টরা। পুরো বিষয়টি নজরদারিতে রাখা হবে। টিকিট যার ভ্রমণ তার নিশ্চিত করা হবে। কালোবাজারিদের কাছ থেকে টিকিট ক্রয় করে ট্রেন উঠলে অপরাধী হিসাবে জরিমানা ও শাস্তি প্রদান করা হবে। আমরা অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহণে ১৬টি ঈদ স্পেশাল ট্রেন চালু করছি। এটা দিন দিন বৃদ্ধি করা হবে।
