শিকলে বেঁধে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ
পর্নো ব্যবসার জন্য গোপন ভিডিও পাঠাত বিদেশে
জড়িত প্রভাবশালী ব্যারিস্টার, যিনি করতেন লিভ টুগেদার, এখন আছেন বিদেশে * গ্রেফতার ৪ জন রিমান্ডে
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০২ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
খোদ রাজধানীতে এক তরুণীর ওপর বর্বরোচিত ঘটনা ঘটেছে। শিকলে বেঁধে যার ওপর প্রায় এক মাস যাবত পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়। এভাবে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার তরুণীকে (২৩) শুক্রবার রাতে মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিংয়ের একটি ফ্ল্যাট থেকে শিকলবন্দি অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। ভুক্তভোগী ইতোমধ্যে পুলিশের কাছে চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য দিয়েছে। তাকে শুধু পৈশাচিকভাবে ধর্ষণই নয়, সংঘবদ্ধভাবে শারীরিক নির্যাতনও চালানো হয়। এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় চারজন গ্রেফতার হয়েছে। গ্রেফতারদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ রিমান্ডে নিয়েছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ ক্লু হিসাবে এখন পর্যন্ত মুঠোফোনটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
পুলিশ তরুণীকে শুক্রবার উদ্ধার করলেও জড়িতদের গ্রেফতার করার স্বার্থে বিষয়টি গোপন রাখে। ঘটনাস্থল থেকে গ্রেফতারকৃত সালমা ওরফে ঝুমুরের তথ্য এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা নিয়ে অপর তিনজনকে দু’দিন পর গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, লিভ টুগেদারে থাকা তরুণী অন্য যুবকের সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে পড়ায় প্রতিশোধ নিতে জনৈক ব্যারিস্টার ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী। যিনি আছেন বিদেশে। তার পরিকল্পনায় এই বর্বোরচিত ঘটনা ঘটেছে। শুধু এভাবে নির্যাতন করেই তিনি ক্ষ্যান্ত হননি সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ভিডিও ফুটেজকে পণ্য বানিয়ে তিনি এক ধরনের পর্নো ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। এ কাজের জন্য ওই আইনজীবী গণধর্ষণ ও গোপন ক্যামেরায় ভিডিও ধারণে সহায়তাকারীদের এ পর্যন্ত দুই লাখ টাকা দিয়েছেন।
এ ঘটনায় সোমবার বেলা ১১টার দিকে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) এইচ এম আজিমুল হক। তিনি তার নিজ কার্যালয়ে আয়োজিত এ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ এবং পরে তারা দুজনই অন্যত্র বিয়ে করায় ভুক্তভোগী তরুণী একা হয়ে পড়েন। এরপর থাকতেন তার বড় বোনের বাসায়। সেই সময় ভগ্নিপতির মাধ্যমে মাসুদ নামের এক ব্যারিস্টারের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরিচয়ের সূত্র ধরে একপর্যায়ে মাসুদের সঙ্গে লিভ টুগেদার করতেন ওই তরুণী। তবে মাসুদ বেশির ভাগ সময় বিদেশে থাকেন। দেশে এলে এই তরুণীকে সময় দিতেন। পরে মাসুদের মাধ্যমে এক প্রবাসীর স্ত্রী সালমা ওরফে ঝুমুরের সঙ্গে পরিচয় হয় তরুণীর। এক পর্যায়ে মাসুদের পরিকল্পনা মোতাবেক সালমার সঙ্গে নবীনগর হাউজিং এলাকায় ভাড়া ফ্ল্যাটে ওঠেন ওই তরুণী। যে কারণে সব খরচ বহন করতেন মাসুদ। পরে ঝুমুরের মাধ্যমে আবিদ তাসিন সান (২০) নামের এক যুবকের সঙ্গে পরিচয় ঘটে ওই তরুণীর। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু বিষয়টি বেশি দিন আর গোপন থাকেনি। জেনে যান মাসুদ। আর এতেই তিনি চরম ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন।
ডিসি আজিমুল হক আরও জানান, মাসুদ ভুক্তভোগী তরুণীকে শায়েস্তা করতে তার বর্তমান প্রেমিক সানের সঙ্গে হাত মেলান। ঝুমুরকে দিয়ে তাদের টাকার প্রলোভন দেখিয়ে মাসুদের নির্দেশনায় বিভিন্ন অপকর্ম করান। ঝমুরের মাধ্যমে তরুণীর রুমে বসানো হয় গোপন ক্যামেরা। পরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন সময় সান ও তার বন্ধু আতিক রহমান হিমেল ভুক্তভোগী তরুণীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে যুক্ত হলে সেটি গোপনে ধারণ করে রাখতেন ঝুমুর। আর নির্দেশনা অনুযায়ী এসব ভিডিও ফুটেজ পাঠানো হতো মাসুদের কাছে। দীর্ঘদিন ধরে এভাবে ভিডিও পাঠানো অব্যাহত থাকে। তবে একপর্যায়ে গোপনে ভিডিও করার বিষয়টি ভুক্তভোগী তরুণী জেনে গেলে বিষয়টি ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। তরুণী এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হলে এবার তার ওপর শুরু হয় অমানুষিক নির্যাতন। এমনকি হাত-পা ও মুখ বেঁধে পৈশাচিক নির্যাতন চালাতেন সান ও তার বন্ধুরা। যার প্রতিটি মুহূর্ত ভিডিও ধারণ করে পাঠানো হতো বিদেশে অবস্থান করা আইনজীবী মাসুদের কাছে।
ডিসি আজিম বলেন, গত ২৯ মার্চ রাত ৯টার দিকে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ কল পেয়ে ভুক্তভোগী তরুণীকে শিকলে বাঁধা অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। ওইদিন সন্ধ্যায় তরুণীকে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়।
ভুক্তভোগী তরুণী ঘুমিয়ে গেলে বাইরে যান সালমা, সান ও অন্যরা। কিছুক্ষণ পর ঘুম ভেঙে গেলে বাসায় কেউ না থাকার সুযোগে চিৎকার দিলে পথচারীরা ৯৯৯-এ কল দিয়ে পুলিশকে জানায়। পরে পুলিশ গিয়ে নবীনগরের একটি বহুতল ভবনের চারতলা থেকে তরুণীকে উদ্ধার করে। বর্তমানে ওই তরুণী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) চিকিৎসাধীন। ভুক্তভোগী তরুণীকে নির্যাতনের বেশির ভাগ ভিডিও ও ছবি ঝুমুরের মোবাইল ফোনে সংরক্ষণ করা আছে বলে প্রাথমিকভাবে তারা স্বীকার করেছে। তবে গতকাল পর্যন্ত মোবাইলটি উদ্ধার করা যায়নি। তিনি জানান, মোবাইলটি উদ্ধার করা হলে পৈশাচিক নির্যাতনের বিষয়ে আরও বিস্তারিত তথ্য ও ভিডিওর গন্তব্য সম্পর্কে জানা যাবে।
এদিকে সোমবার নির্যাতনের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে গ্রেফতারদের আদালতে হাজির করে সাতদিন করে রিমান্ডের আবেদন করেন মোহাম্মদপুর থানার এসআই ফারুকুল ইসলাম। আদালত সূত্র জানায়, এসময় আসামিপক্ষের আইনজীবীরা রিমান্ড বাতিল চেয়ে আবেদন করেন। আর রাষ্ট্রপক্ষ জামিনের বিরোধিতা করে রিমান্ডের পক্ষে শুনানি করেন। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ জসিমের আদালত তাদের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। একই সঙ্গে ঘটনায় জড়িত সবার নাম যেন অভিযোগপত্রে আসে তদন্ত কর্মকর্তাকে তা নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
শুনানির এক ফাঁকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে উদ্দেশ করে বিচারক বলেন, ‘যত বড় ব্যক্তি হোক না কেন, সংশ্লিষ্ট সবার নাম যেন অভিযোগপত্রে আসে।’
তদন্ত কর্মকর্তা এসআই ফারুকুল ইসলাম সোমবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে যুগান্তরকে বলেন, রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তারা মূলত ট্রাপে ফেলে নারীদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও ধারণ করে। আসামিরা স্বীকার করেছে, তারা এর আগেও অনেক নারীর সঙ্গে এমন করেছেন। এসব ক্ষেত্রে সহায়তার করেছে সালমা।
পুলিশ জানিয়েছে, সানের বাড়ি চাঁদপুরের মতলব উত্তর থানার মাথাভাঙ্গা বালুচর গ্রামে। বাবার নাম মো. শাহিন মিয়া। আর সালমার বাড়ি ঝালকাঠি সদর থানার নবগ্রামে। তার বাবার নাম আব্দুস সালাম।
