Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

লাশ টুকরো টুকরো করে কসাই জিহাদ

লাশের খোঁজে জিহাদকে নিয়ে ভাঙড়ের খালে তল্লাশি * কলকাতার বারাসাত আদালতে লোমহর্ষক তথ্য, ১২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর

Icon

কৃষ্ণকুমার দাস, কলকাতা থেকে

প্রকাশ: ২৫ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

লাশ টুকরো টুকরো করে কসাই জিহাদ

ঢাকার বসুন্ধরা ও গুলশানের বাসায় মাসখানেক আগেই বসে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারকে খুনের ছক কষা হয়। পরে কলকাতার নিউটাউনে ফ্ল্যাটে এসে ভাড়াটে খুনি এবং কসাইদের নিয়ে খুনের চূড়ান্ত পরিকল্পনা করেন মূল হোতা আক্তারুজ্জামান শাহীন। সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশের এক কুখ্যাত দুষ্কৃতকারী আমানুল্লাহ আমান ও সেলেস্তি রহমান নামে শাহীনের এক বান্ধবী। নিউটাউনের যে ফ্ল্যাটে খুন করা হয় সেখানেই বসে খুলনার বাসিন্দা ইদানীং মুম্বাইয়ে থাকা কসাই জিহাদকে ডেকে এনে বুঝিয়ে দেওয়া হয়, এমপিকে খুনের পর কীভাবে দেহ টুকরো টুকরো করে গায়েব করা হবে। আদালতের নির্দেশে শুক্রবার নিজেদের হেফাজতে পাওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গ সিআইডির গোয়েন্দাদের জেরায় খুনের পর ফ্ল্যাটেই দেহ টুকরো টুকরো করে লোপাটের লোমহর্ষক তথ্য স্বীকার করেছে কসাই জিহাদ হাওলাদার।
বনগাঁ সীমান্ত থেকে সিআইডি এসটিএফ ও বাংলাদেশ পুলিশের সহযোগিতায় বৃহস্পতিবারই গ্রেফতার করা হয়েছে খুলনার বাসিন্দা জিহাদ কসাইকে। গ্রেফতারের পর তাকে নিয়ে লাশের খোঁজে নামে কলকাতা পুলিশ। শুক্রবার জিহাদকে নিয়ে পুলিশ চব্বিশ পরগনার ভাঙড়ের খালে অভিযান চালায়। এর আশপাশে মৃতদেহের খণ্ডিত অংশ ফেলা হয়েছে বলে জিহাদ স্বীকার করে। বস্তুত এই কসাইকে গ্রেফতারের পরই এমপি খুনের নৃশংসতার কথা জানতে পেরেছেন তদন্তকারী গোয়েন্দারা। জেরায় জিহাদ স্বীকার করেছে, এমপির দেহাংশ যাতে চিনতে না পারা যায় তার জন্য খুনের পরই দেহ থেকে ছাড়িয়ে নেওয়া হয় চামড়া। তারপর টুকরো টুকরো করে কেটে তাতে হলুদ জাতীয় কোনো রাসায়নিক মেশানো হয়েছে। এরপরই প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে ট্রলিতে করে কলকাতার নানা জায়গায় দেহাংশ ফেলে দেওয়া হয়েছে। এমন তথ্য কলকাতা পুলিশের ফরেনসিক টিমের তদন্তকারীরাও অনুমান করছেন। শুক্রবার উত্তর চব্বিশ পরগনার বারাসাত আদালতে পেশ করা হয় জিহাদকে। অভিযুক্ত জিহাদের বিরুদ্ধে খুনের জন্য অপহরণ, তথ্য নষ্ট করা, ভুল তথ্য দেওয়া, খুন ও অপরাধের চক্রান্ত করার ভারতীয় আইনের নানা ধারা যোগ করা হয়েছে। সিআইডির আবেদন মেনেই বিচারক ১২ দিনের পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছেন।
বারাসাত আদালতে জিহাদকে হাজির করানো হলে তাকে ঘিরে ধরেন সাংবাদিকরা। জানতে চান ‘কেন মারলে?’ জিহাদের মুখ কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল। পুলিশের গাড়ি থেকে নেমে তিনি আদালতে ঢুকে যান। কোনো প্রশ্নের জবাব দেননি। তদন্তে গোয়েন্দারা জেনেছেন, নিউটাউনে হত্যাকাণ্ডের মাসখানেক আগেই ঢাকার গুলশান ও বসুন্ধরার বাসায় বসে খুনের ছক আঁটা হয়। এমপিকে হত্যার পর শরীরের বিভিন্ন অংশ টুকরো করে হলুদ জাতীয় রাসায়নিক লাগিয়ে ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে, যার কারণে লাশ উদ্ধার করা কঠিন। আদালতের নির্দেশ হাতে পাওয়ার পর শুক্রবার বিকালেই জিহাদকে কলকাতা লাগোয়া দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ভাঙড়ে খালের পাশে একটি জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কারণ আজিমের দেহাংশ সেখানেই ফেলা হয়েছে বলে জেরায় স্বীকার করেছেন জিহাদ। এই সংবাদ কলকাতা থেকে পাঠানোর সময় পর্যন্ত অবশ্য কোনো দেহাংশ উদ্ধার হয়নি। বৃহস্পতিবার রাতেও অ্যাপ ক্যাবচালকের সূত্র ধরেও একবার এই ভাঙড়ে এসে তল্লাশি চালান গোয়েন্দারা। কিন্তু রাতের অন্ধকারে সেখান থেকে কোনো দেহাংশই মেলেনি। তাই ফের শুক্রবার জিহাদকে ভাঙড়ে নিয়ে গিয়ে দীর্ঘক্ষণ তল্লাশি চালান গোয়েন্দারা। তবে অভিযুক্তরা কোনোভাবে তদন্তকারীদের ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন কি না, তা-ও খতিয়ে দেখছেন সিআইডির শীর্ষকর্তারা। পশ্চিমবঙ্গ থেকে সিআইডির একটি দল বৃহস্পতিবারই ঢাকায় গিয়েছে। ধৃতদের সেখানেও জেরা করা হবে।
নিউটাউনের যে ফ্ল্যাটে খুন হয়েছেন বাংলাদেশের সংসদ সদস্য, তার ভাড়াটে আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশি আক্তারুজ্জামান শাহীন নিজেও সোনা চোরাচালানকারী বলে নিশ্চিত হয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ সিআইডি। গোয়েন্দাদের সন্দেহ, কলকাতায় শাহীন ও নিহত আনোয়ারুল আজিমের যৌথ ব্যবসা ছিল। এমপিকে হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ছিল তার ছোটবেলার বন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনার এই শাহীন। হত্যার পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দিয়েছিল আরেক বন্ধু ও বাংলাদেশের চরমপন্থি দলের নেতা আমানুল্লাহ আমানকে। কসাই জিহাদকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এদিন গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, কলকাতায় বসে হত্যার চূড়ান্ত পরিকল্পনার পর বাংলাদেশে চলে যান শাহীন। হত্যার জন্য পাঁচ কোটি টাকার চুক্তি করেছিলেন আমেরিকা প্রবাসী শাহীন। খুনের আগে আমানকে বেশ কিছু টাকাও দেন। বাকি টাকা দেওয়ার কথা ছিল হত্যাকাণ্ডের পর।
সিআইডি সূত্রের খবর, ৩০ এপ্রিল আক্তারুজ্জামান শাহীন ও আমানুল্লাহ আমান সেলেস্তি রহমান নামে এক বান্ধবীকে নিয়ে কলকাতা আসেন। আগে থেকেই ভাড়া করে রাখা নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনের ফ্ল্যাটে ওঠেন তারা। কলকাতায় আরও আগে থেকেই চলে এসেছিল সিয়াম ও জিহাদ। এখানে বসেই তারা সংসদ সদস্য আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করে। হত্যার পুরো দায়িত্ব আমানকে বুঝিয়ে দিয়ে ১০ মে দেশে চলে যান শাহীন। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমান বাংলাদেশ থেকে আরও দুই ভাড়াটে খুনিকে কলকাতায় নিয়ে আসে। কলকাতার ১০ নম্বর সদর স্ট্রিটে ‘হোটেল প্লাজা’য় একটি ঘর ভাড়া নেয় ফয়সাল আলি সাজি ও মোস্তাফিজুর রহমান নামে ওই দুই ভাড়াটে খুনি। ওই হোটেলের ১২এ রুমে ২ থেকে ১৩ মে ছিল তারা। হোটেলের রেজিস্টারে তার উল্লেখ আছে। গোয়েন্দাসূত্রে জানা গেছে, সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম যে ১২ মে কলকাতায় আসবেন, তা আগে থেকেই জানতেন শাহীন। সেই মতো তাকে খুনের পরিকল্পনা করা হয়। ১২ মে দর্শনা-গেদে সীমান্ত দিয়ে কলকাতায় আসেন এমপি আনার। প্রথম দিন তিনি তার পরিচিত গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে থাকেন। পরদিন ১৩ মে নানা কৌশলে তাকে নিউটাউনের সেই ফ্ল্যাটে ডেকে নিয়ে যায় হত্যাকারীরা। বিকালের দিকে বাংলাদেশের এমপি সঞ্জীবা গার্ডেনের সেই ফ্ল্যাটে আসেন। এরপরই আমান ও তার সহযোগী ফয়সাল, মোস্তাফিজুর, সিয়াম ও জিহাদ শাহীনের পাওনা টাকা পরিশোধের জন্য চাপ দেয়। এ নিয়ে শুরু হয় তর্কাতর্কি। তার মধ্যেই একটা সময় সবাই মিলে তাকে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করে। হত্যার পর সে খবরও জানানো হয় এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান শাহীনকে।
 

এমপি আজিম

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম