Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

আমতলীতে সেতু ভেঙে বৌভাতের ৯ যাত্রী নিহত

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন, আমতলী (বরগুনা)

প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আমতলীতে সেতু ভেঙে বৌভাতের ৯ যাত্রী নিহত

আমতলীর চাওড়া নদীর হলদিয়া হাট সেতু ভেঙে পড়ে যাওয়া মাইক্রোবাসের যাত্রীদের উদ্ধারের চেষ্টা -যুগান্তর

আমতলী উপজেলা চাওড়া নদীতে হলদিয়া হাট সেতু ভেঙে বৌভাতের নয় যাত্রী নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে এক পরিবারের তিনজন। অপর নিহতরা সবাই পরস্পর আত্মীয়। অভিযোগ রয়েছে, ঠিকাদার শহীদুল ইসলাম মৃধা দায়সারা সেতু নির্মাণ করেছেন। ফলে নির্মাণের ৫ বছরের মাথায় সেতুর মাঝের বিম ভেঙে যায়। 
গত ১০ বছর ধরে এ ভাঙা নড়বড়ে সেতু দিয়ে হলদিয়া ইউনিয়ন ও চাওড়াসহ উপজেলার অন্তত অর্ধলাখ মানুষ চলাচল করতেন। সেতুটি নড়বড়ে হওয়ায় এর আগে সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড লাগানো হয়। সেতু নির্মাণকারী ঠিকাদার শহীদুল ইসলাম মৃধার শাস্তির দাবিতে এলাকাবাসী বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। ঘটনা ঘটেছে শনিবার দুপুর দেড়টায়।

কাউনিয়া ইব্রাহিম একাডেমির সহকারী শিক্ষক উত্তর তক্তাবুনিয়া গ্রামের মাসুম বিল্লাহ মনিরের মেয়ে হুমায়রা আক্তারের বিয়ে হয় একই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আমতলী পৌর শহরের খোন্তাকাটা এলাকার সেলিম মাহমুদের ছেলে ডা. সোহাগের মঙ্গে। শুক্রবার ওই কনেকে বরের বাড়িতে তুলে আনা হয়। শনিবার মেয়ের পক্ষের লোকজন বরের বাড়িতে মাইক্রোবাস ও অটোগাড়িতে যাচ্ছিলেন। পথে হলদিয়া সেতু পার হওয়ার সময় সেতুর মাঝের অংশ ভেঙে যায়। এতে মাইক্রোবাস ও অটোগাড়ি নদীতে পড়ে যায়। অটোতে থাকা যাত্রী সবাই সাঁতরে কিনারে উঠতে পারলেও মাইক্রোবাসের যাত্রীরা নদীতে তলিয়ে যান। তাৎক্ষণিক স্থানীয়রা ওই মাইক্রোবাসের লোকজনকে উদ্ধারের চেষ্টা চালান বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শী নাসির উদ্দিন। 

খবর পেয়ে আমতলী ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে যাত্রীদের উদ্ধারের চেষ্টা চালায়। ততক্ষণে মাইক্রোবাসের নয় যাত্রীর মৃত্যু হয়। নিহতরা হলেন-রুবিয়া, রাইতি, ফাতেমা, জাকিয়া, রুকাইয়াত ইসলাম (৪), তাহিয়া মেহজাবিন আজাদ (৭), তাসফিয়া (১৪), ঋধি (৪) ও রুবি বেগম। এদের মধ্যে রুকাইয়াত ইসলাম ও জাকিয়ার বাড়ি উপজেলার দক্ষিণ তক্তাবুনিয়া গ্রামে। অপর নিহত ৭ জনের বাড়ি মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কোকরার চর গ্রামে। এরা কনে হুমায়রার মামা বাড়ির আত্মীয়স্বজন। লাশ আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রাখা হয়েছে। 

এ ঘটনার পরপর সেতু নির্মাণকারী ঠিকাদার শহীদুল ইসলাম মৃধার বিচার দাবিতে কয়েক হাজার মানুষ বিক্ষোভ করেছেন। খবর পেয়ে বরগুনা-১ আসনের সংসদ-সদস্য গোলাম সরোয়ার টুকু, জেলা প্রশাসক মোহা. রফিকুল ইসলাম, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান গোলাম সরোয়ার ফোরকান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) তারেক হাসান, সহকারী পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, ওসি কাজী সাখাওয়াত হোসেন তপু ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। 

মাইক্রোবাসের যাত্রী সোহেল মিয়া বলেন, মাইক্রোবাসে কনেপক্ষের ১৬ জন বরের বাড়িতে যাচ্ছিলাম। পথে হলদিয়া হাট সেতুতে উঠামাত্রই সেতু মাঝখান দিয়ে ভেঙে মাইক্রোবাসটি নদীতে পড়ে যায়। আমিসহ তিনজন সাঁতরে কিনারে উঠতে পেরেছি। পরে স্থানীয়রা, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ নয়জনের লাশ উদ্ধার করেছে। 

প্রত্যক্ষদর্শী ইউপি সদস্য সাইফুল ইসলাম স্বপন ও নাসির উদ্দিন বলেন, মাইক্রোবাস ও অটোগাড়িটি সেতুর মাঝখানে আসা মাত্রই সেতু ভেঙে নদীতে পড়ে যায়। তাৎক্ষণিক আমরা স্থানীয়দের নিয়ে উদ্ধারের চেষ্টা চালাই। পরে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ এসে উদ্ধার কাজে অংশ নেয়।

একই পরিবারের নিহত তিনজনের স্বজন আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমার কিছুই রইল না। আমার দুই মেয়ে ও স্ত্রী মারা গেছে। 

বরের বাবা সেলিম মাহমুদ বলেন, কনেপক্ষের লোকজনের জন্য সব আয়োজন ছিল, কিন্তু একটি ফোনে সবকিছু ভেস্তে গেছে। কনের বাবা মাসুম বিল্লাহ মনির বলেন, আমি শ্বশুরবাড়ির মানুষকে কি জবাব দেব? 
হলদিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. আসাদুজ্জামান মিন্টু মল্লিক বলেন, ঠিকাদার শহীদুল ইসলাম মৃধা দায়সারা সেতু নির্মাণ করেছেন। ফলে নির্মাণের অল্প দিনের মধ্যেই সেতুর মাঝখানের বিম ভেঙে গেছে। এই ভাঙা সেতু মেরামতের জন্য আমতলী উপজেলা প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে বহুবার জানিয়েছি, কিন্তু তিনি আমলে নেননি। 

আমতলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী সাখাওয়াত হোসেন তপু বলেন, লাশ ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। ঠিকাদার শহীদুল ইসলাম মৃধা বলেন, আমি যথাযথভাবেই সেতু নির্মাণ করেছি। কোনো অনিয়ম করিনি। আমতলী ফায়ার সার্ভিসের ওয়ার ইনচার্জ মো. হানিফ বলেন, ৪ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে মাইক্রোবাস উদ্ধার করতে পারিনি। উদ্ধার চেষ্টা অব্যাহত আছে। 

আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার মো. মনিরুজ্জামান বলেন, সেতু ভেঙে নিহত নয়জনই হাসপাতালে আনার আগে মারা গেছেন। আমতলী উপজেলা প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমতলীতে আমার যোগদানের আগে এ সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে কিছুই জানি না।
আমতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) তারেক হাসান বলেন, উদ্ধার কাজের তদারকি করছি। বরগুনা জেলা প্রশাসক মোহা. রফিকুল ইসলাম বলেন, এ সেতু নির্মাণে যে ঠিকাদার অনিয়ম করেছেন তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

বরগুনা-১ আসনের সংসদ-সদস্য গোলাম সরোয়ার টুকু বলেন, সেতু নির্মাণে অনিয়মের কারণে এমন ঘটনা ঘটে থাকলে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নিহতের পরিবারকে আর্থিকভাবে সহায়তা করা হবে। 
আমতলী উপজেলা প্রকৌশল অধিদপ্তর ২০০৮-০৯ অর্ধ বছরে প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয়ে উপজেলার চাওড়া ও হলদিয়া ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত চাওড়া নদীর উপর হলদিয়া হাট এলাকায় আয়রণ সেতু নির্মাণের দরপত্র আহ্বান করে। ওই সেতু নির্মাণ কাজ পান তৎকালীন হলদিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি শহীদুল ইসলাম মৃধা।

শোকে স্তব্ধ শিবচরের সাহাপাড়া : শিবচর (মাদারীপুর) প্রতিনিধি জানান, আমতলীতে সেতু ভেঙে মাইক্রোবাস পড়ে নিহত ৯ জনের মধ্যে সাতজনই শিবচর উপজেলার ভদ্রাসন ইউনিয়নের সাহাপাড়ার সাবেক সেনাসদস্য মাহাবুবর রহমান সবুজের পরিবারের সদস্য। সবুজ একই এলাকার ফজলুর রহমান খানের ছেলে। দুর্ঘটনার খবর গ্রামের বাড়িতে পৌঁছলে শুরু হয় শোকের মাতম। 

বুধবার সকালে মাদারীপুরের শিবচর থেকে মাহাবুব এবং তার পরিবারের সদস্যরা খালাতো বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বরগুনার উদ্দেশে রওয়ানা দেয়। গত দুদিন বরগুনা অবস্থান করেন তারা। শুক্রবার বিয়ে হয় আমতলীর কাউনিয়া এলাকার মনিরুল ইসলামের মেয়ে হুমায়ারার। শনিবার দুপুরে বরের বাড়িতে যাওয়ার সময় ওই মাহাবুব ও তার পরিবারের সদস্যদের বহনকারী মাইক্রোবাসটি ভেঙে খালে পড়ে যায়।
 

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম