নাসা গ্রুপের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে সিআইডি
আসাদুল্লা লায়ন
প্রকাশ: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
চাঁদাবাজি, অবৈধ দখল, জালিয়াতি, অর্থ পাচার ও কর ফাঁকির মতো অপরাধে জড়িয়েছে নজরুল ইসলাম মজুমদার ও তার মালিকানাধীন নাসা গ্রুপ। বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) চেয়ারম্যান ও এক্সিম ব্যাংকের সাবেক এই চেয়ারম্যানের বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের তথ্য সামনে আসছে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের খুব ঘনিষ্ঠ এই ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যাংক খাতে নানা অনিয়মের অভিযোগও রয়েছে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে প্রাথমিক অনুসন্ধান শুরু করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এছাড়াও ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দীলিপ কুমার আগরওয়ালার বিদেশে বিপুল অবৈধ সম্পদের প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছে পুলিশের এই তদন্ত সংস্থাটি।
মঙ্গলবার সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এসব তথ্য জানিয়েছেন। তারা বলছেন, ব্যাংক লুট ও অর্থ পাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে নাসা গ্রুপ ও নজরুল ইসলাম মজুমদার। প্রাথমিকভাবে তাদের অবৈধ সম্পদ সংক্রান্ত কিছু তথ্য পাওয়া গেছে, যেগুলো যাচাই করা হচ্ছে। প্রাথমিক প্রমাণের ভিত্তিতে অর্থ পাচার আইনে এই ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা করে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করা হবে। এখন পর্যন্ত যাচাই প্রক্রিয়ায় থাকা তথ্যগুলোয় উল্লেখ করা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটি দেশের প্রচলিত আইনকানুনকে তোয়াক্কা না করে ব্যাংক লুট, অর্থ পাচারের নেতৃত্ব দিয়েছে। বন্ড সুবিধায় আমদানি করা পণ্য রপ্তানি না করে খোলাবাজারে বিক্রি করেছে। বন্ড সুবিধার অপব্যবহার ও আমদানি-রপ্তানিতে জালিয়াতির মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা হাতিয়েছে।
এছাড়া ২০২২ সালে নিজের চারটি প্রতিষ্ঠানে অবৈধভাবে ২১ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেন নজরুল ইসলাম। তার এসব অবৈধ অর্থে কেনা যুক্তরাজ্যের লন্ডনের দুটি বাড়ির সন্ধান পাওয়া যায়। ২০১৯ ও ২০২০ সালে এ দুটি বাড়ি কিনতে ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ৭৯ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড। তখনকার হিসাবে বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ছিল ২৩১ কোটি টাকা। ব্রিটিশ সরকারের ল্যান্ড রেজিস্ট্রি দপ্তর ও ব্রিটিশ কোম্পানি হাউজের নথিপত্রে এমন তথ্য উঠে এসেছে। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে কমপক্ষে ২১০ কোটি টাকা যুক্তরাজ্যসহ একাধিক দেশে পাচার করার অভিযোগ আছে। এছাড়াও সম্পদ গোপন ও কর ফাঁকি দিতে ভুয়া দলিল তৈরি করে মাছের খামার থেকে ২১৫ কোটি টাকা আয় দেখানোসহ নানা অপকৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন তিনি।
সিআইডির তথ্যে আরও রয়েছে, রাজধানীতে ৬০ কোটি টাকার খাসজমি নাসার দখলে ছিল। আরএস এবং মহানগর জরিপের ধারাবাহিকতায় সরকারের নামে ১নং খাস খতিয়ানে রেকর্ড ৭৭.৮০ শতাংশ জমি দীর্ঘদিন নাসা গ্রুপের অবৈধ দখলে ছিল। এছাড়াও নাসা গ্রুপ জনতা ব্যাংক থেকে সুদ মওকুফ নিয়েছে ২৬১ কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ও ব্যাংকের নিজস্ব নীতিমালা না মেনে ২০২১ সালে ওই সুবিধা দেওয়া নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ১৫ বছরে ব্যাংকগুলো থেকে চাঁদা তুলে শেখ হাসিনার হাতে দেওয়ার কারণে তিনি আলোচনায় ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে ব্যাংক কোম্পানি আইন পরিবর্তন করে উদ্যোক্তাদের সুবিধা বাড়ানো ও নীতি পরিবর্তনে ভূমিকা রেখে আসছিলেন তিনি। এসবের বিপরীতে বিপুল অর্থ হাতিয়েছেন।
অন্যদিকে স্বর্ণ ও হীরা চোরাচালানের অভিযোগে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড এবং এর স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সিআইডি অনুসন্ধান শুরু করেছে। সিআইডি জানিয়েছে, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দীলিপ কুমার আগরওয়ালার বিরুদ্ধে বিদেশ থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে সোনা ও হীরা আমদানির নামে বিদেশে অর্থ পাচার, প্রতারণা ও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে বিভিন্ন জেলায় নামমাত্র শোরুমের মাধ্যমে প্রকৃত ডায়মন্ডের বদলে উন্নত মানের কাচের টুকরাকে প্রকৃত ডায়মন্ড হিসাবে বিক্রির প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। এছাড়া দুবাই-সিঙ্গাপুরে স্বর্ণ চোরাচালান সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ, ভারতের কলকাতায় তিনটি জুয়েলারি দোকান ও ১১টি বাড়ি এবং মালয়েশিয়া, দুবাই ও কানাডায় বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য রয়েছে। এছাড়াও প্রতারণার মাধ্যমে ৪০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে অবৈধভাবে একটি ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার অভিযোগ প্রাথমিকভাবে পাওয়া গেছে।
এদিকে নজরুল ইসলাম মজুমদারের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে স্ত্রী নাছরিন ইসলাম ও তাদের পুত্র-কন্যার ব্যাংক হিসাবও স্থগিত করা হয়েছে। অন্যদিকে নাসা গ্রুপের বড় অঙ্কের ব্যাংক লেনদেনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই গ্রুপের কোম্পানি বা কোম্পানির স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে বড় অঙ্কের কোনো লেনদেন করতে পারবে না। সূত্র জানায়, সরকার পতনের পর নাসাসহ তিনটি গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানির পক্ষে বড় অঙ্কের অর্থ ব্যাংক থেকে তুলে নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওইসব অর্থ তারা বিদেশে পাচার করেছেন বা করার চেষ্টা করছেন। এ কারণেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগাম সতর্কতা হিসাবে তাদের বড় অঙ্কের লেনদেনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে নজরুল ইসলাম মজুমদারকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি।
