স্বস্তি সংস্কার উদ্যোগে অস্বস্তি বাজারে, মূল্যস্ফীতিই বড় চ্যালেঞ্জ
মিজান চৌধুরী
প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ব্যাংক খাত সংস্কারে টাস্কফোর্স গঠনসহ নানা উদ্যোগে খুব বেশি না হলেও অর্থনীতি স্থিতিশীলতায় কিছুটা স্বস্তি এসেছে। রিজার্ভের ধারাবাহিক পতনের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এরই মধ্যে ডলার বিক্রি বন্ধ করেছে। ব্যাংকগুলোয় বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় এলসি খোলার ক্ষেত্রে নমনীয় করা হয়েছে শতভাগ মার্জিনের শর্ত। যদিও ব্যবসায়ীদের এখনো নির্বিঘ্নে এলসি খোলার মতো অবস্থা তৈরি হয়নি। তবে খাদ্য মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের সহনীয় মাত্রার বাইরে বিরাজ করছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। পাশাপাশি বিনিয়োগের নতুন পরিবেশ এখনো আসেনি। যে কারণে নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে না।
গত তিন বছরের টানাপোড়েনের অর্থনীতির ড্রাইভিং সিটে বসে আজ দুই মাস পূর্ণ করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। অর্থনীতিবিদদের মতে, পরিবর্তিত পরিস্থিতির মুখে যে অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে, সেটি এখনো ঠিক হয়নি। তাদের মতে, দুই মাসে সবকিছু পরিবর্তন বা বদলে যাবে, সেটাও আশা করা বাস্তবসম্মত হবে না। এ প্রসঙ্গে সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়ায় অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ রোববার যুগান্তরকে জানান, দুমাসের অর্থনৈতিক সংস্কারের কার্যক্রম নিয়ে আমি খুশি, বেশি খুশি। আমাদের লক্ষ্য অনুযায়ী সব কাজই করতে পেরেছি।
অবশ্য দায়িত্ব গ্রহণের পর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, প্রথম কাজ হবে আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ফেরানো। এ দুই মাসে তিনি এ বিষয়ে বেশকিছু সংস্কারকাজ যথাযথভাবে করতে পেরেছেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের দুই মাসে অর্থনীতিতে রক্তক্ষরণ কিছুটা বন্ধ হয়েছে, তবে টেকসই কতটা হবে, সেটি অনেকটা অনিশ্চিত-এমন মন্তব্য করেছেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। সোমবার যুগান্তরকে তিনি আরও বলেন, অর্থনীতি তিন বছর ধরে একটা টানাপোড়েনের মধ্যে ছিল। সার্বিকভাবে সেই অবস্থা এখনো রয়ে গেছে। গত দুই মাসে মূল্যস্ফীতির হার সামান্য কিছু কমার লক্ষণ দেখা গেলেও তা উল্লেখযোগ্য নয়। খাদ্য মূল্যস্ফীতির গতি থামছেই না, যা সাধারণ মানুষকে সবচেয়ে ভোগাচ্ছে। তৈরি পোশাক খাত এখন ঠিক হয়নি। নিরাপত্তার দিক থেকে স্বস্তিতে নেই। উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। শিল্প এলাকায় স্বস্তিদায়ক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি। প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও বিক্ষোভ ছাড়াও হামলা-ভাঙচুরের মতো ঘটনা ঘটছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে গেল সেপ্টেম্বরে দশমিক ৯৬ শতাংশ কমে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৪০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। একই মাসে কিছুটা কমে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশে বিরাজ করছে। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিক বেড়ে অস্বস্তিতে ফেলছে সাধারণ মানুষকে। মূল্যস্ফীতি কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, এক্ষেত্রে সরকারের নজরও কম।
অর্থ বিভাগ সূত্র জানায়, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ইতোমধ্যে সরকারের পরিচালনা ও উন্নয়ন ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে কমানোর কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এছাড়া কৃষকের সার আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় ডলারের সরবরাহ নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি পলিসি সুদের হার বাড়িয়ে ৯ শতাংশ নির্ধারণ এবং ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। এছাড়া বাজার মনিটরিং বাড়ানো হচ্ছে। আলুসহ কয়েকটি পণ্যের ওপর শুল্ক কমানো হয়েছে। অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সামষ্টিক অর্থনীতিতে কিছু নীতি উদ্যোগ নিতে হচ্ছে। এটি না করলে অবস্থা আরও খারাপ হতো।
ঋণখেলাপি ও অর্থ পাচার একধরনের পঙ্গু করে দিয়েছে ব্যাংক খাতকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে গত জুন শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। দেশের ব্যাংকগুলো থেকে বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশই এখন খেলাপি হয়ে পড়েছে। যার বড় অংশ পাচার হয়ে বিদেশে চলে গেছে। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, দেশ থেকে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। খেলাপি ঋণসহ ব্যাংক খাত সংস্কারে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। পাচারের অর্থ ফেরত আনতে গঠন করা হয়েছে আরও একটি টাস্কফোর্স।
এদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) সরকারের রাজস্ব আদায় আগের অর্থবছরের তুলনায় ১১ শতাংশ কম হয়েছে। এ সময় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ৪২ হাজার ১০৬ কোটি টাকা আদায় করেছে, যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ১৫ হাজার ৬৯ কোটি টাকা ঘাটতি। তবে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ১৬ দশমিক ২৭ শতাংশ। রেমিট্যান্সের প্রবাহও বেড়েছে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের টানা পতনের মধ্যেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসে। রিজার্ভ পরিস্থিতি বাড়ানোর নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়। রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে রাশিয়া ও চীন থেকে প্রাপ্য ঋণের সুদহার কমানো এবং ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানোর অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকারের কাছে। পাশাপাশি দুই মাসের মধ্যে বেশি নজর দিয়েছে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ সংগ্রহের দিকে। নিয়মিত সহায়তার লক্ষ্যমাত্রার বাইরে অতিরিক্ত ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে সহায়তা চাওয়া হয়। পাশাপাশি বিশ্বব্যাংকের কাছে ১০০ কোটি ডলার এবং জাইকার কাছে ১০০ কোটি ডলারের ঋণ দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। তবে বিভিন্ন দাতা সংস্থার কাছ থেকে ১২০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ পাওয়ার প্রতিশ্রুতি মিলছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, সব উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া পাইপলাইনে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
অর্থনীতি সংস্কারের যত উদ্যোগ : কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরকে প্রধান করে গঠন করা হয়েছে ছয় সদস্যের ‘ব্যাংক খাত সংস্কারে টাস্কফোর্স’। আর্থিক খাতে স্থিতিশীল রক্ষায় ব্যাংক খাতের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরে সুপারিশ করবে এ টাস্কফোর্স। এছাড়া বিদেশে পাচার অর্থ ফেরাতে নয় সদস্যের টাস্কফোর্স পুনর্গঠন করা হয়। যার প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। পাশাপাশি দেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে শ্বেতপত্র প্রকাশের জন্য ১২ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। যার প্রধান হলেন অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। আয়কর আইন ২০২৩ পর্যালোচনা করতে সাত সদস্যের একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কর কমিশনার ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ মামুন এই টাস্কফোর্সের প্রধান। এছাড়া পুঁজিবাজার সংস্কারে সাত সদস্যের একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে।
এছাড়া দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বাজার পরিস্থিতি ও সরবরাহ চেইন তদারকি এবং পর্যালোচনায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে জেলা পর্যায়ে একটি বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। নয় সদস্যের এ টাস্কফোর্সের প্রধান হচ্ছেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক। মূল্য নিয়ন্ত্রণে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের শুল্ক কাঠামো যৌক্তিককরণ, ব্যবসায়ীদের একক ঋণসীমা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এছাড়া সাদা টাকা কালো করার অর্থনৈতিক সুবিধা বাতিল করা হয়। বাণিজ্যের গতি ফেরাতে কনটেইনার জট নিরসন এবং ঢাকায় আনা পণ্য সহজে ছাড় করতে কমলাপুর আইসিডির পাশাপাশি পানগাঁও টার্মিনালের ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়।
ব্যাংক খাত, অর্থনীতি ও পাচার অর্থ ফেরত আনাসহ কয়েকটি খাতে টাস্কফোর্স গঠন প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হাসান মনে করেন, এসব কমিটির সুপারিশ আসতে কত সময় লাগবে, সেটি দেখার বিষয়। কারণ, রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। সংস্কার কার্যক্রম নিতে হলে সময়ের রূপরেখা থাকতে হবে। তিনি বলেন, যেসব খাতে জরুরি প্রয়োজন, তা শনাক্ত করে স্বল্পমেয়াদি সংস্কার করে দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। বিশেষ করে ব্যাংক খাত, রাজস্ব আদায়, সরকারের অর্থ ব্যয়, বিদ্যুৎ খাত, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে।
