কমিশনকে কাজের স্বাধীনতা দিতে হবে
সংবিধান সংশোধন না পুনর্লিখন সিদ্ধান্ত আলোচনার পর
দুই মেয়াদের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না এবং ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণকে মোকাবিলা করতে হবে -আলী রীয়াজ * অন্তর্বর্তী সরকারই সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাব বাস্তবায়ন করবে -মাহফুজ আলম
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সংবিধান সংশোধন, পুনর্বিন্যাস নাকি পুনর্লিখন হবে-তা রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে সংবিধান সংস্কার কমিশন। আগামী সপ্তাহে অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ শুরু হচ্ছে। আর রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত ও প্রস্তাব নিতে আগামীকাল মঙ্গলবার ওয়েবসাইট খোলা হবে। সংবিধান সংস্কার কমিশন সরাসরি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বসবে না। অন্তর্বর্তী সরকার দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করবে। পতিত আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদ এবং জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ডে যুক্ত ও সমর্থনকারীদের সুপারিশ নেবে না কমিশন। রোববার জাতীয় সংসদের এলডি হলে সংবাদ সম্মেলনে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ এসব কথা বলেন।
কমিশনের প্রস্তাব বর্তমান সরকার নাকি পরবর্তী নির্বাচিত সরকার বাস্তবায়ন করবে, এমন প্রশ্নের জবাবে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম বলেন, আমি কমিশনের সদস্য হিসাবে এই প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি না। তবে ছাত্র প্রতিনিধি হিসাবে বলতে পারি, অবশ্য অবশ্যই এই সরকার করে যাবে। কেন করবে না? এই সরকার ছাড়া আর কেউ করবে না। তিনি বলেন, যেদিন অভ্যুত্থানের একদফা ঘোষণা করা হয়েছিল সেদিনই সংবিধানের প্রশ্নটা বাতিল হয়ে গেছে। সেখানে বলা হয়েছিল, পুরাতন রাজনীতির সেটেলমেন্ট খারিজ করছি। আমরা নতুন রাজনীতির বন্দোবস্ত চাই। নতুন রাজনীতি বন্দোবস্ত মানে নতুন সংবিধান। ওইটা শুনেই বাংলাদেশের মানুষ আন্দোলনে নেমেছিল।
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকার বেশ কিছু বিষয়ে সংস্কারে কমিশন গঠন করেছে। এর একটি সংবিধান সংস্কার কমিশন। ওই কমিটির প্রধান ড. আলী রীয়াজ। কমিশন গঠনের পর রোববার প্রথম সংবাদ সম্মেলনে আসেন কমিশনের সদস্যরা। ড. আলী রীয়াজ বলেন, জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলের লক্ষ্যে সংবিধানের সামগ্রিক সংশোধন, সংযোজন, বিয়োজন, পরিমার্জন, পুনর্বিন্যাস এবং পুনর্লিখন সংস্কার পরিধির অন্তর্ভুক্ত। অংশীজনদের কথা শোনার পর আমাদের পর্যালোচনায় যেটা প্রয়োজন হবে, সেটা সুপারিশ করতে কমিশন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তিনি বলেন, আমরা অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করব। তার মধ্য দিয়ে আমরা চিহ্নিত করতে পারব কোন কোন জায়গা সুনির্দিষ্টভাবে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন, বিয়োজন অথবা পুনর্লিখন প্রয়োজন। আমরা পূর্বধারণা থেকে কিছুই শুরু করছি না।
সংবিধান সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশন সরাসরি আলোচনা করবে না জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের সনির্বন্ধ অনুরোধ করব লিখিত মতামত এবং সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পাঠানোর জন্য। সরকার বিভিন্ন কমিশনের কাছ থেকে পাওয়া সুপারিশগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করবে। তাদের দেওয়া প্রতিটি লিখিত প্রস্তাব ও মতামত কমিশন নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করবে এবং কমিশনের সুপারিশে তার যথাসাধ্য প্রতিফলন ঘটাতে সচেষ্ট থাকবে।
লিখিত বক্তব্যে আলী রীয়াজ সাংবিধানিক সংস্কারের সাতটি উদ্দেশ্য উল্লেখ করেন। তার অন্যতম হলো-দীর্ঘ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতিশ্রুত উদ্দেশ্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার এবং ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের আলোকে বৈষম্যহীন জনতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানো, রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনায় সর্বস্তরের জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিতের ব্যবস্থা।
অন্য উদ্দেশ্যগুলো হলো-ভবিষ্যতে যে কোনো ধরনের ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থার উত্থান রোধ, রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ-নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ ও ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, রাষ্ট্রক্ষমতা ও প্রতিষ্ঠানের বিকেন্দ্রীকরণ ও পর্যাপ্ত ক্ষমতায়ন এবং রাষ্ট্রীয়, সাংবিধানিক এবং আইন দ্বারা সৃষ্ট প্রতিষ্ঠানের কার্যকর স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিতকরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা।
সংবিধান থেকে ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার উত্থান রোধে ব্যাখ্যা জানতে চাইলে আলী রীয়াজ বলেন, ক্ষমতার এককেন্দ্রিকতার কারণে ফ্যাসিবাদ তৈরি হয়। আমাদের লক্ষ্য ভবিষ্যতে যাতে ফ্যাসিবাদী শাসন না তৈরি হয়। এজন্য ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণকে মোকাবিলা করতে হবে। এটা এড়িয়ে যাওয়ার কোনো পথ নেই। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আলোচনায় গুরুত্ব পাচ্ছে এক ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবে না। এটা ওয়েস্ট মিনিস্টারে নেই। নেই বলে করা যাবে না তা নয়। রাজনৈতিক বাস্তবতায় যা প্রয়োজন তা করা হবে।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব কোন প্রক্রিয়ায় পাশ হবে সে বিষয়ে সুপারিশ থাকবে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাব তৈরি করব। সরকারের কাছে উপস্থাপন করব। পাশের প্রক্রিয়ার বিষয়ে পরিপত্রের কথা বলা নেই। যদি সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় সেটা বিবেচনা করব। শুধু সুপারিশ করার কথা সেটাই করব।
সংসদ বহাল না থাকা অবস্থায় সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব পাশের বিষয়ে জানতে চাইলে এ কমিশনের সদস্য ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম বলেন, আমরা অনির্বাচিত হতে পারি। কিন্তু আমরা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করি। পুরো দুনিয়ায় কোথাও ছাত্ররা সরাসরি সরকারে যায়নি। আন্দোলন করেছে, সরকারে গেছে এমনটি হয়নি। এটা একটা এক্সট্রা অর্ডিনারি সিচুয়েশন। এই সরকারের সময়ে নির্বাচিত-অনির্বাচিত শব্দগুলোর কী তাৎপর্য আছে জানি না। যখন প্রধান উপদেষ্টার অফিসে থেকে কথা বলব তখন এসব বিষয়ে উত্তর দেব।
সুপারিশ কীভাবে বাস্তবায়ন হবে-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কমিশন থেকে যখন প্রস্তাবনা দেওয়া হবে তখন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে রাজনৈতিক দলগুলো ডাকা হবে। কমিশন থেকে যে প্রস্তাব দেওয়া হবে তা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে পরামর্শকে কার্যকর করা হবে। তিনি বলেন, এর আগ পর্যন্ত কমিশনকে তার কাজের স্বাধীনতা দিতে হবে, যাতে রাজনৈতিক চাপ না আসে।
অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করবে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ছাত্র প্রতিনিধি হিসাবে ধরলে বলব, অবশ্য অবশ্যই এই সরকার করে যাবে। কেন করবে না? এই সরকার ছাড়া আর কেউ করবে না। সংবিধান সংস্কার কাজে কোনো রাজনৈতিক চাপ আছে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোনো চাপ নেই। তখন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান আলী রীয়াজ বলেন, আমি সুস্পষ্টভাবে বলতে পারি আমরা কোনোভাবে চাপ-প্রভাবের মধ্যে নেই।
