Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে রাজনৈতিক দলের সংলাপে সম্মিলিত বার্তা

সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে ঐকমত্য

বাংলাদেশকে দুর্বল নতজানু ভাবার সুযোগ নেই * গণ-অভ্যুত্থানকে ভয়ংকর কাণ্ড উল্লেখ করে এর বিরুদ্ধে অনেকে শক্তি দেখাতে চায় * ১৫ বছরে ভারতের সঙ্গে করা চুক্তি প্রকাশ্যে আনার দাবি * বাংলাদেশের প্রতি ভারতের অর্থনৈতিক নিপীড়ন, সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর চেষ্টার নিন্দা

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে ঐকমত্য

দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কোনো ছাড় নয়। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মতাদর্শ ভিন্ন হতে পারে, মতপার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু দেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে সবাই ঐক্যবদ্ধ। ঐক্যবদ্ধ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেশবাসীর ওপর চেপে বসা জগদ্দল পাথর সরেছে।

এটা যাদের পছন্দ হয়নি, তারা এখন আমাদের দেশের বিরুদ্ধে নানাভাবে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। তারা অভ্যুত্থানের মতো অর্জনকে মুছে দিতে চায়। এ পরিস্থিতিতে সব রাজনৈতিক দলের নেতারা প্রধান উপদেষ্টাকে আশ্বস্ত করেছেন দেশের সার্বভৌমত্ব, অস্তিত্ব, স্বাধীনতা ও মর্যাদা রক্ষার প্রশ্নে তারা একসঙ্গে আছেন।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপে এ ঐকমত্যের কথা উঠে আসে। শুরুতে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানকে নস্যাৎ করার যড়যন্ত্র চলছে। দেশের বিরুদ্ধেও চলছে ষড়যন্ত্র। এ ষড়যন্ত্র রুখে দিতে সব রাজনৈতিক দলের ঐক্যের জরুরি।

বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ শীর্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বলেন, বাংলাদেশকে দুর্বল, শক্তিহীন, নতজানু ভাবার কোনো অবকাশ নেই। আমাদের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পরিবর্তনকে ভারতের শাসকগোষ্ঠী এখনো মেনে নেয়নি। পতিত ফ্যাসিবাদের পরাজয়কে ভারত সরকার নিজেদের পরাজয় হিসাবে বিবেচনা করছে। সংলাপে তিনটি বিষয় আলোচনায় অগ্রাধিকার পায়। এগুলো হলো-বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতীয় মিডিয়ার অপপ্রচার, ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন এবং তাদের অধিকার নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশ।

রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বুধবার জাতীয় ঐক্য নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর এই সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, গণতন্ত্র মঞ্চের ছয় দল, এবি পার্টি, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, গণঅধিকার পরিষদসহ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি অংশ নেন। তবে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও এলডিপিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।

বিকাল ৪টা থেকে সাড়ে ৬টা পর্যন্ত আলোচনা হয়। সংলাপ শেষে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এর আগে মঙ্গলবার সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ছাত্র প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। আজ ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে।

আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, সংলাপে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের প্রতি ভারতের অর্থনৈতিক নিপীড়ন, সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ, অভ্যন্তরীণ ও রাজনৈতিক বিষয়ে নাক গলানোর চেষ্টার নিন্দা জানান।

প্রসঙ্গত, আওয়ালী লীগ সরকারের পতন হলে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। এরপর থেকেই দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক শীতল হতে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে এ বৈরী সম্পর্কের বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে। বিভিন্ন ইস্যুতে একে অপরকে অভিযুক্ত করছে। এ অবস্থায় ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় সোমবার বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা করে একটি উগ্রবাদী সংগঠন। এ সময় সংগঠনটি ব্যাপক ভাঙচুরের পাশাপাশি বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা পুড়িয়ে ফেলে।

এরপর বিষয়টি আরও জটিল আকার ধারণ করে। এ অবস্থায় ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে মঙ্গলবার তলব করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ভারতের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ-মিছিল সমাবেশ চলছে। ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন ও বিভিন্ন স্থাপনার নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিলেন প্রধান উপদেষ্টা।

উদ্বোধনী বক্তব্যে ড. ইউনূস বলেন, ৫ আগস্ট বাংলাদেশে বিরাট একটা অভ্যুত্থান হয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জগদ্দল পাথর আমরা সরাতে পারলাম। সেটা অনেকের পছন্দ হয়নি। ফলে তারা এই অভ্যুত্থানকে মুছে দিতে চায়। আড়াল করতে চায়। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘তারা গণ-অভ্যুত্থানকে একটা ভয়ংকর কাণ্ড হিসাবে দেখাতে চাইছে।

তারা বলছে, বাংলাদেশে একটা ভয়ংকর কাণ্ড হয়ে গেছে। সেই ভয়ংকর কাণ্ড থেকে রক্ষা করতে হবে। তারা রক্ষার জন্য এগিয়ে আসতে চায়। আমরা মুক্ত, স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরি করলাম অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। সেটাকে তারা মুছে দিতে চায়। তারা আগেরটাতে ফিরে যেতে চায়। আগেরটা কীভাবে তারা নিয়ে আসবে? তারা একটা কাল্পনিক বাংলাদেশ তৈরি করে রাখতে চায়। এটি জাতি হিসাবে আমাদের অস্তিত্বের বিষয়।’ এই ষড়যন্ত্র রোধে সবাইকে একজোট হতে হবে।

আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ‘বৈঠকে, আমরা গোটা জাতি ভারতের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছি। এজন্য আমরা সবাই মিলে একটি সমাবেশ করতে পারি কি না, পলিটিক্যাল কাউন্সিল করতে পারি কি না, এমনকি নিরাপত্তার কাউন্সিল করতে পারি কি না এই প্রস্তাব এসেছে।’

আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘দেশের সব রাজনৈতিক দল আজ উপস্থিত ছিল। এই বৈঠকে সবাই বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, অস্তিত্ব, স্বাধীনতা ও মর্যাদা রক্ষার প্রশ্নে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন। সভায় সব সম্প্রদায়ের মানুষের ভূমিকার প্রশংসা করা হয়েছে। যে কোনো উসকানির মুখে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট রাখার কথা বলা হয়েছে।’ আসিফ নজরুল বলেন, ‘যে কোনো ধরনের অপপ্রচার ও উসকানির বিরুদ্ধে আমরা সাহসী, অটুট ও ঐক্যবদ্ধ থাকব। ভবিষ্যতে কোনো ধরনের উসকানি এলে আমরা আমাদের ঐক্য আরও বেগবান দেখানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখব।

তিনি বলেন, ‘এই সভার মূল সুর ছিল আমাদের মধ্যে মত, পথ, আদর্শের ভিন্নতা থাকবে। কিন্তু দেশ, সার্বভৌমত্ব, অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে সবাই এক। সবার ওপরে দেশ। এটা থেকে আমরা কখনো বিচ্যুত হবো না। বাংলাদেশকে দুর্বল, শক্তিহীন, নতজানু ভাবার কোনো অবকাশ নেই, এই বার্তা প্রকাশ করতে বা জানিয়ে দিতে বলা হয়েছে।’ ভারতকে সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।

আসিফ নজরুল বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা ভারতের সঙ্গে গত ১৫ বছরে যত চুক্তি হয়েছে, তা প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন। পাশাপাশি রামপালসহ যত ক্ষতিকারক চুক্তি হয়েছে তা বাতিলেরও দাবি জানান। তিনি আরও বলেন, সংলাপে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের প্রতি ভারতের অর্থনৈতিক নিপীড়ন, সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ, অভ্যন্তরীণ ও রাজনৈতিক বিষয়ে নাক গলানোর চেষ্টার নিন্দা জানান। পাশাপাশি ভারতকে বাংলাদেশের সঙ্গে মর্যাদাশীল ও সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণের আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

আসিফ নজরুল বলেন, বাংলাদেশবিরোধী বিভিন্ন তৎপরতা চলছে। হাইকমিশনে হামলা, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ, বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা এসবের তীব্র নিন্দা জানানো হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে ভারতের এসব পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বর্তমান সরকার যে আত্মমর্যাদাশীল সাহসী ভূমিকা নিয়েছে, তার প্রশংসা করা হয়েছে। সরকারের সঙ্গে সলিডারিটি প্রকাশ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

আইন উপদেষ্টা আরও বলেন, একই সঙ্গে ভারতের এসব প্রচারণার বিরুদ্ধে আরও শক্তিশালীভাবে এবং আরও বেগবানভাবে মোকাবিলার কথা বলা হয়েছে। এজন্য আমাদের যারা প্রবাসী বন্ধু এবং বিদেশি সাংবাদিকদের নিয়ে আসার পরামর্শ দেওয় হয়েছে। আমাদের যোগাযোগ দক্ষতা এবং আইনি দক্ষতা বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। যে কোনো ধরনের অপপ্রচার এবং উসকানির বিরুদ্ধে আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকব। আমাদের ঐক্য অটুট রাখব। আমরা সজাগ থাকব, ভবিষ্যতে যে কোনো অপপ্রচার, উসকানি এলে আমরা আমাদের ঐক্যকে আরও বেগবান রাখার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখব।

আসিফ নজরুল

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম