Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

অতিমাত্রায় স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ

প্রশ্নের মুখে চারটি ধারা

Icon

আমিরুল ইসলাম

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

প্রশ্নের মুখে চারটি ধারা

প্রশ্নের মুখে পড়েছে সরকারি চাকরি আইনের ৩৯ (১), ৪০, ৪১ ও ৪২ (২)-এই চারটি ধারা। এগুলো কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অতিমাত্রায় স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ দেওয়া হয়েছে-এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে-আইনের এমন দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তারা (কর্মকর্তা-কর্মচারী) নানা ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতিতে উৎসাহিত হয়েছেন।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকার জেনে-বুঝেই কর্মচারীদের নিজেদের পক্ষে রাখার জন্য রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে আইনটিতে এসব ধারা সংযোজন করেছে। সরকারি চাকরি আইন ২০১৮-এর ৩৯ (১) ধারায় বলা হয়েছে, অপরাধ করে জেলে গেলেও অপরাধীকে বরখাস্ত না করার বিধান রাখা হয়েছে।

বরখাস্ত করা বা না করা কর্তৃপক্ষের স্বেচ্ছাধীন রাখা হয়েছে। আর ৪০ ধারায় সরকারি কর্মচারীদের কেউ দ্বৈত নাগরিকত্ব গ্রহণ করলে চাকরিচ্যুত করার বিধান করা হলেও তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা না করার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া বিদেশে পারমান্যান্ট রেসিডেন্ট (পিআর) ও গ্রিনকার্ডধারীদের বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি।

আইনের ৪১ ধারা অনুযায়ী, কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে দায়ের করা ফৌজদারি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র গৃহীত হওয়ার আগে সরকারের অনুমতি ছাড়া তাকে গ্রেফতার করা যাবে না। এছাড়া কোনো অপরাধের জন্য এক বছরের কম কারাদণ্ড হলে সংশ্লিষ্ট চাকরিজীবীর চাকরি যাবে না-এমন বিধান রাখা হয়েছে ৪২(২) ধারায়।

উল্লিখিত বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস-উর রহমান গত বুধবার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, আইনের এসব ধারা চলমান সমস্যা। তিনি ঢাকার বাইরে ব্যস্ত থাকায় আর কোনো মন্তব্য করেননি।

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া যুগান্তরকে বলেন, আইন, বিধি, প্রবিধি দিয়ে প্রশাসন পরিচালিত হয়। যারা সরকারি আদেশ-নিষেধ বাস্তবায়ন করবে তারা যদি বেপরোয়া অনিয়মের সুযোগ পায় তাহলে সরকার কাকে দিয়ে শাসন কাজ পরিচালনা করবে।

কর্মচারীদের সব ধরনের জবাবদিহিতা থেকে মুক্ত করে ছেড়ে দিলে তো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে না। সরকারি চাকরি আইনে ৩৯(১), ৪০, ৪১ ও ৪২ (২) ধারা জনস্বার্থের পরিপন্থি। বিগত সরকার জেনেশুনেই কর্মচারীদের নিজেদের পক্ষে রাখতে রাষ্ট্র ও জনস্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে এসব ধারা রেখেছে-মন্তব্য করেন ফিরোজ মিয়া।

সরকারি চাকরি আইনের ৩৯(১) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় কার্যধারা গ্রহণের প্রস্তাব বা বিভাগীয় কার্যধারা রুজু হলে সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ অভিযোগের মাত্রা ও প্রকৃতি বিবেচনা করে অভিযুক্ত কর্মচারীকে তার দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখার আবশ্যকতা, তিনি তদন্তে প্রভাব বিস্তারের আশঙ্কা ইত্যাদি বিবেচনা করে বিবেচনায় নিয়ে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করতে পারবে।

তবে শর্ত থাকে যে, সরকার অধিকতর সমীচীন মনে করলে ওই কর্মচারীকে বরখাস্তের পরিবর্তে তার প্রাপ্য থেকে ছুটিতে পাঠাতে পারবে। এই ধারার দুর্বলতা প্রসঙ্গে ফিরোজ মিয়া বলেন, বাংলাদেশ সার্ভিস রুলসে (বিএসআর) বলা আছে যদি কেউ, কোনো অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে জেল খাটে, আটক হয় এবং কেউ যদি কোনো অপরাধে দোষী হয়ে জেলে গিয়ে জামিনে মুক্ত হয়, তাহলে তাকে বরখাস্ত করতে হবে। ১৯৯১ সালে বিএসআর এই ধারা সংশোধনের জন্য কমিটি গঠন করে সরকার। আমি ওই কমিটির সদস্য ছিলাম।

আইন মন্ত্রণালয়, তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরো, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, অর্থ বিভাগসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির দীর্ঘ আলোচনার পর আইনটি সংশোধন না করে বহাল রাখার সিদ্ধান্ত হয়। কারণ কোনো কর্মচারীর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হতে পারে, কারও বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা হতে পারে, কারও নামে চুরির মামলা হতে পারে এবং আত্মসাতের মামলা হতে পারে। যার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে সে ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ পরিদর্শক, অ্যাকাউন্টেট, ক্যাশ সরকার এবং অ্যাকাউন্স অফিসার হতে পারে।

ম্যাজিস্ট্রেট মামলার আসামি হয়ে জেলে গিয়ে জামিনে বেরিয়ে বিচার করতে গেলে তা কতটা গ্রহণযোগ্য হবে। পুলিশের কর্মচারীরা মামলার আসামি হয়ে জেলে গিয়ে জামিনে এসে তদন্ত করতে গেলে তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। অভিযুক্তকে বরখাস্ত না করা হলে সে আদালতে হাজিরের দিন কীভাবে দায়িত্ব পালন করবে। আদালতে হাজির হতে গেলে অফিস থেকে ছুটি নিতে হবে।

আবার এমন হতে পারে কর্মচারী দায়িত্ব পালন করছেন এক জেলায় মামলা হয়েছে অন্য জেলায় তখন সে কীভাবে কোর্টে হাজির হবে? তখন তাকে বাধ্যতামূলকভাবে ছুটি দিতে হবে। এতে জনস্বার্থ বিঘ্নিত হবে। এ ধারাটি জনস্বার্থবিরোধী এবং কর্মচারীর স্বার্থ সংরক্ষণ করা হয়েছে।

ফিরোজ মিয়া আরও বলেন, জামিন মানে হচ্ছে কোনো একজন জামিনদারে হেফাজতে থাকা। মূলত আদালতের হেফাজতে থাকা। এখন কোনো কর্মচারী কোনো মামলায় দোষী হয়ে জেলে গিয়ে জামিনে বেরিয়ে হাজিরা দিতে গিয়ে আবার জেলে যাবে না এমন নিশ্চয়তা কে দেবে।

ফিরোজ মিয়া বলেন, এক সময় প্রশ্ন উঠেছে সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা হয়, তখন আমরা বলেছি মিথ্যা মামলা হলেও এ ধারাটি পরিবর্তন করা যাবে না। কিন্তু সরকারি চাকরি আইনের ৩৯(১) দোষী সাব্যস্ত হয়ে জেল খেটে জামিনে বেরোলেও তাকে বরখাস্ত না করার বিধান রাখা হয়েছে। এটা সঠিক হয়নি।

ফিরোজ মিয়া জানান, সরকারের ইচ্ছাধীন করে ধারা তৈরি করে বলা হয়েছে, সরকার চাইলে বরখাস্ত করতে পারবে। না চাইলে বরখাস্ত হবে না। দুর্নীতি করে কেউ কর্তৃপক্ষকে খুশি রাখলে সে জেল খেটে জামিনে বেরোলেও বরখাস্ত হবে না। কারণ কর্তৃপক্ষ তাকে বরখাস্ত করা সমীচীন মনে করেনি।

আইনের এমন বিধান থাকায় যে কেউ বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবে না। ফিরোজ মিয়া উদাহরণ দিয়ে বলেন, কমপক্ষে সরকারি চাকরি আইনে নির্দিষ্ট করে বলে দেওয়া উচিত ছিল নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে যেমন মাদকের অপরাধ, চুরি, ডাকাতি, আত্মসাৎ, রাহাজানি, ধর্ষণের মামলায় দোষী হলে তাকে বরখাস্তের বিধান রাখা জরুরি ছিল।

তাছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলা করলে বরখাস্ত করার বিধান রাখা জরুরি ছিল। এই ধারার মাধ্যমে সরকার কর্মচারীদের আশকারা দিয়ে মাথায় তুলেছে। এই ধারাটি সংশোধন হওয়া জরুরি।

ফিরোজ মিয়া বলেন, আইনটির ৪০ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো কর্মচারী বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে পারবে না। বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করলে কর্মচারীকে দুইবার যুক্তিসঙ্গত কারণ দর্শানোর সুযোগ দিয়ে তার চাকরির অবসান ঘটাতে পারবে।

ফিরোজ মিয়া বলেন, যেখানে একজন সংসদ সদস্য দ্বৈত নাগরিকত্ব নিলে তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, সেখানে কর্মচারীদের ক্ষেত্রে কেন এ সুযোগ থাকবে। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা কেন হবে না। এছাড়া সরকারি চাকরি আইনে তো পারমান্যান্ট রেসিডেন্ট (পিআর), গ্রিনকার্ডসহ বিদেশি রাষ্ট্রের যেসব সুযোগ নেওয়ার অবারিত ক্ষেত্র রয়েছে সে বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। এসব দুর্বলতা দূর করা জরুরি বলে তিনি মন্তব্য করেন।

সরকারি চাকরি আইনের ৪১ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো কর্মচারীর দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সম্পর্কিত অভিযোগ দায়ের করা ফৌজদারি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র গৃহীত হওয়ার আগে তাকে গ্রেফতার করতে হলে সরকারের পূর্বানুমতি নিতে হবে। এই ধারার দুর্বলতা প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া যুগান্তরকে বলেন, দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়ে কর্মচারীদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো অভিযোগ আসে না।

তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, পুলিশ সদস্যরা আসামি ধরতে গিয়ে অনেক সময় বাড়াবাড়ি করেন অথবা চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ থাকে, এছাড়া সরকারি জমি, বাড়ি, স্থাপনা থেকে উচ্ছেদের সময় কিছু ঘটনা ঘটে, যা দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ তিনটি ক্ষেত্র ছাড়া দায়িত্বপালনের সঙ্গে সম্পৃক্ত অভিযোগ খুব একটা আসে না। এসব ক্ষেত্রে ফৌজদারি আইনে বলা আছে, সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে সরকারের পূর্বানুমতি নিতে হবে।

তিনি বলেন, দেশে কর্মচারীরা কর্মরত অবস্থায় ঘুস নিচ্ছে, অনেক কর্মচারী কর্মরত অবস্থায় সেবা প্রত্যাশীর সঙ্গে মারামারি করছে। অথচ আইনে বলা হয়েছে, এ ধরনের অপরাধ ও দুর্নীতির ক্ষেত্রে তাদের গ্রেফতারের আগে সরকারের পূর্বানুমতি নিতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ফাঁদে দুর্নীতিবাজ কর্মচারীদের অনেকেই ঘুসের টাকাসহ ধরা পড়েছে। অথচ সরকারি চাকরি আইনে বলা আছে, তাকে গ্রেফতার করতে সরকারের পূর্বানুমতি নিতে হবে। এটা হাস্যকর।

সরকারি চাকরি আইনের ৪২(২) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মচারী ফৌজদারি মামলায় আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ড বা এক বছর মেয়াদের অধিক কারাদণ্ড হলে, ওই দণ।ড আরোপের রায় বা আদেশ প্রদানের তারিখ থেকে চাকরি থেকে তাৎক্ষণিক বরখাস্ত হবে।

কিন্তু কোনো কর্মচারীর ফৌজদারি মামলায় আদালতের রায়ে অনূর্ধ্ব এক বছরের কারাদণ্ড কিংবা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড হলে তাকে তিরস্কার, নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য পদোন্নতি ও বেতন বৃদ্ধি স্থগিত, নিু পদ বা নিুতর বেতন স্কেলে অবনমিতকরণ এবং ক্ষতিপূরণ আদায়ের দণ্ড আরোপ করা যাবে। তার চাকরি থাকবে। আইনের এসব ধারা তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয় বলে মন্তব্য করেন ফিরোজ মিয়া।

চাকরি

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম