দুর্নীতি-ক্ষমতার দাপট নির্যাতনের চিহ্ন পদে পদে
মোশাররফের প্রাসাদোপম বাড়িগুলো বিরানভূমি
ফরিদপুর ব্যুরো
প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ফরিদপুর-৩ (সদর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ১০ বছরের সাম্রাজ্যের পতনের পর তার ফরিদপুরের বাড়িঘরগুলো বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে। জনমানবহীন বাড়িগুলো গেট লাগিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আগে সাধারণ মানুষ প্রবেশ করতে পারলেও বর্তমানে সে সুযোগ নেই। ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে খন্দকার মোশাররফ গড়ে তুলেছেন অঢেল সম্পদ। তার অনুসারীরাও দুর্নীতি আর লুটপাটের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা পাচারে অভিযুক্ত। দেশের বহুল আলোচিত দুই হাজার কোটি টাকা মানি লন্ডারিংয়ের মামলায় মোশাররফ হোসেনের অনেক অনুসারী এখনো কারাগারে। তবে দুর্নীতির মহোৎসব চললেও ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে তখন রক্ষা পান মোশাররফ। তারপর দেশ ছেড়ে সুদূর সুইজারল্যান্ডে বসবাস করছেন শেখ হাসিনার বেয়াই খন্দকার মোশাররফ হোসেন। সরেজমিন দেখা যায়, ফরিদপুর শহরে গড়ে তোলা খন্দকার মোশাররফ হোসেনের তিনটি জৌলুসপূর্ণ বাড়ি। যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় শত কোটি টাকা। এক সময় ক্ষমতার কেন্দ্র হিসাবে পরিচিত খন্দকার মোশাররফের বাড়িগুলো এখন খাঁ খাঁ করছে। ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। প্রথমবার শ্রমমন্ত্রী, এরপর প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী এবং সর্বশেষ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। তার ছেলে খন্দকার মাশরুর হোসেন মিতু সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের স্বামী। ক্ষমতার বলয়েই এলজিইডি, বিআরটিএ, সড়ক, বিএডিসিসহ বিভিন্ন সরকারি বিভাগের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে অনিয়ম, অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং বিদেশে অর্থ পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। খন্দকার মোশাররফের ‘হেলমেট বাহিনী’র হাতে শুধু বিএনপি নেতারাই নন, আওয়ামী লীগের অনেকে হামলা-নির্যাতনের শিকার হন বলে অভিযোগ রয়েছে।
দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেন। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে অতিশয় নিরীহ প্রতিবেশীদের ওপর নির্মম নির্যাতনের পথ বেছে নেন। অনেকের কাছ থেকে জোর করে জমিজমা লিখে নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। যারা জমি লিখে দিতে চাননি তাদেরটা জোর করেই নিতেন তিনি। এ শোক সইতে না পেরে শোকে কষ্টে মারা গেছেন কেউ কেউ।
জানা গেছে, শেখ হাসিনার সঙ্গে আত্মীয়তার সুবাদে এমপি ও মন্ত্রী হয়ে খন্দকার মোশাররফ বিশেষ বাহিনী তৈরি করে দুর্নীতির রাজত্ব কায়েম করেন। যার মধ্যে হেলমেট বাহিনী ফরিদপুরে ব্যাপক নাম ছড়ায়। বাড়ি তৈরির বিলাসিতায় মেতে ওঠেন তিনি। শহরের বদরপুর, কমলাপুর এবং ডিক্রিরচরে সরকারি খাস ও ব্যক্তিমালিকানার জায়গাজমি নামমাত্র মূল্যে কিনে ও দখল করে জেলা সদরেই নির্মাণ করেন বিলাসবহুল ও নয়নাভিরাম তিনটি বাড়ি।
দুর্নীতি ও দখলবাজির কেলেঙ্কারিতে ব্যাপক সমালোচিত হয়ে পতন হয় তার। ২০২০ সালের জুন মাসে ফরিদপুরে কথিত এক শুদ্ধি অভিযানের পর ২৬ জুন ঢাকার কাফরুল থানায় খন্দকার মোশাররফের ভাই খন্দকার বাবরসহ মোশাররফ অনুসারীদের বিরুদ্ধে দুই হাজার কোটি টাকা পাচারের একটি মামলা করেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক এসএম মিরাজ আল মাহমুদ। ওই শুদ্ধি অভিযানে খন্দকার মোশাররফের একের পর এক আস্থাভাজন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। হত্যাসহ অসংখ্য মামলায় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের কারাগারে ঢোকানো হয়।
ওই মামলায় খন্দকার মোশাররফের ভাই বাবরকে মানি লন্ডারিংয়ের ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসাবে আখ্যায়িত করেন বিচারিক আদালত। ২০০৯ সালের মাঝামাঝি থেকে ফরিদপুরে ভাইয়ের ছায়া হিসাবে আবির্ভূত হন খন্দকার মোহতেশাম হোসেন। তিনি খন্দকার মোশাররফের অলিখিত প্রতিনিধি হিসাবে ফরিদপুরের যাবতীয় কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করতেন।
ফরিদপুর শহরের প্রবেশমুখ ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পাশে বদরপুরে স্ত্রী আফসানার নামকরণে ‘আফসানা মঞ্জিল’ বাড়িটিতে প্র্রায় ৫০ বিঘার মতো জমি রয়েছে। যার মধ্যে উত্তরাধিকার সূত্রে ছিল মাত্র দুই বিঘার মতো। বাকি সবটুকুই জোরপূর্বক নামমাত্র মূল্যে কিনে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন প্রতিবেশীরা। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে শেখ হাসিনার বেয়াই পরিচয়ের সুবাদে এলজিআরডিসহ একাধিক মন্ত্রণালয়ে প্রভাব খাটিয়ে শিষ্য-সাগরেদদের এই দুই হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে উপার্জনের পথ করে দেন খন্দকার মোশাররফ। যার সুবাদেই তিনি গড়ে তুলেছেন শত কোটি টাকার এসব সম্পদ। অথচ ওই মামলায় তার ছোট ভাই খন্দকার বাবরকে আসামি করা হলেও আত্মীয়তার সুবাদে রক্ষা পান খন্দকার মোশাররফ হোসেন।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর সম্প্রতি সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
প্রতিবেশী প্রশান্ত কুমার বলেন, আমার ১০ শতাংশ জায়গাসহ আরও তিনজনের পাঁচ শতাংশ জায়গা দখল করে গরুর খামার গড়ে তোলা হয়েছে। আমরা আমাদের জমি দখলমুক্ত করে ফেরত চাই।
সদর উপজেলার ডিক্রিরচরে রয়েছে নামে-বেনামে কয়েকশ বিঘা সম্পত্তি। বিস্তীর্ণ জমিজুড়ে গড়ে ওঠা খন্দকার মোশাররফের বাংলো বাড়িটি পরিচিত ছিল ‘রঙমহল’ হিসাবে। দেশ-বিদেশ থেকে শিল্পী এনে বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো।
শহরের দক্ষিণ কালিবাড়ীতে রাজেন্দ্র কলেজসংলগ্ন পৈতৃক বাড়ির পাশে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি নামমাত্র মূল্যে তিনি লিখে নেন। সে সময় এ নিয়ে ব্যাপক হইচই হয়। এখানেও গড়ে তোলেন বিলাসবহুল প্রাসাদোপম আরেকটি বাংলো বাড়ি।
গাছগাছালিতে ঢেকে থাকা আফসানা মঞ্জিলের প্রকৃত রূপ আসলে বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। বড় গেট মাড়িয়ে পিচঢালা পথ পেরিয়ে তবেই দেখা মেলে বাংলো প্যাটার্নের এই দৃষ্টিনন্দন বাড়িটির। এই অঞ্চলে এমন বিলাসী বাড়ি আরেকটা খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। শুধু বাড়ি বললে ভুল হবে। সেখানে সরকারি প্রটোকল গার্ড অব অনার নেওয়ার জন্য তৈরি পতাকার স্ট্যান্ড সংবলিত বেদিও রয়েছে। বাড়ির পেছনে রয়েছে শান বাঁধানো পুকুর। ছোট চিড়িয়াখানায় আছে বিচিত্র প্রজাতির জন্তু-জানোয়ার। তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী করা হয়েছে শ্বেতপাথরে বাঁধানো আগাম কবরস্থান।
এসব ব্যাপারে খন্দকার মোশাররফ হোসেন বা তার পরিবারের বক্তব্য জানতে তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা কেউ দেশে না থাকায় বক্তব্য জানা যায়নি।
