৮ প্রকল্পের নথি চেয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে চিঠি
হাসিনার পরিবারের দুর্নীতি খুঁজতে তৎপর দুদক
পদ্মা সেতু ও নভোথিয়েটার দুর্নীতির অনুসন্ধানের প্রস্তুতি * কমিশনে উপস্থাপনের জন্য তৈরি করা হচ্ছে ফাইল
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনকালে নেওয়া মেগা প্রকল্পের দুর্নীতির অনুসন্ধানে তৎপর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মেগা প্রকল্পের মেগা দুর্নীতিতে জড়িত হাসিনা পরিবারের সদস্যরা। ইতোমধ্যে রূপপুরসহ ৯ প্রকল্পে হাসিনা পরিবারের ৮০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি এবং শেখ হাসিনা ও সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে ৩০ কোটি মার্কিন ডলার (প্রায় ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা) পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে সংস্থাটি। মঙ্গলবার আট প্রকল্পের তথ্য চেয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে অনুসন্ধান টিম। এর আগে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছে শেখ হাসিনা, রেহানা, জয়, টিউলিপসহ অন্যদের বিদেশি ব্যাংক হিসাবের নথির বিবরণ চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়। এছাড়া সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের আমলে ফাইলবন্দি হয়ে যাওয়া পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির অনুসন্ধান পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নতুন করে অনুসন্ধান শুরুর প্রক্রিয়া চলছে নভোথিয়েটার দুর্নীতিকাণ্ডের। এ সংক্রান্ত ফাইল অনুমোদনের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
জানতে চাইলে দুদকের উপপরিচালক আখতারুল ইসলাম বলেন, মঙ্গলবার দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানকাজের ধারাবাহিকতায় আটটি মেগা প্রকল্পের তথ্য চেয়ে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
জানা যায়, আটটি প্রকল্প বাস্তবায়নে ২১ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল, খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প, মিরসরাই বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের পানি শোধনাগার ও গভীর নলকূপ স্থাপন, মিরসরাইয়ের ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর উন্নয়ন প্রকল্প। মঙ্গলবার এসব প্রকল্পের তথ্য চেয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে এসব প্রকল্পের প্রস্তাব/প্রাক্কলন, অনুমোদিত প্রস্তাব/প্রাক্কলন, বাজেট অনুমোদন, বরাদ্দ, অর্থ ছাড়করণ, ব্যয় অর্থের পরিমাণ ও এ সংক্রান্ত যাবতীয় নথিপত্র এবং এসব প্রকল্প নিয়ে কোনো তদন্ত হয়ে থাকলে প্রতিবেদন ও প্রকল্প সময়ের পৃথক সারসংক্ষেপ কপি চাওয়া হয়েছে।
আরও জানা যায়, এর আগে শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, ছোট বোন শেখ রেহানা, তার মেয়ে ব্রিটিশ মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকের দেশে-বিদেশে লেনদেনের যাবতীয় নথি তলব করে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছে চিঠি দেয় দুদক। একই সঙ্গে টিম নির্বাচন কমিশন অফিস এবং ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অফিসেও তাদের ব্যক্তিগত নথিপত্র তলব করে চিঠি দিয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, অনুসন্ধান টিম প্রথম দফায় অভিযোগসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত নথিপত্র, নির্বাচন কমিশন এবং ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অফিসের নথি তলব করে। পরে তাদের নামে পরিচালিত অফশোর ব্যাংক অ্যাকাউন্টের নথি এবং দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের বিস্তারিত বিবরণ সরবরাহের জন্য বিএফআইইউ-এর কাছে চিঠি দিয়েছে অনুসন্ধান টিম। শিগ্গিরই আরও কিছু সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নথি তলব করে চিঠি পাঠানো হবে।
দুদকের কাছে তথ্য রয়েছে, শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, ছোট বোন শেখ রেহানা, মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ নয়টি প্রকল্পে ৮০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ উদ্ঘাটনে কাজ করছে একটি বিশেষ অনুসন্ধান টিম। একই টিমের সদস্যরা শেখ হাসিনা ও তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচারের পৃথক আরও একটি অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করেছে। অভিযোগ অনুসন্ধানে পাঁচ সদস্যের যে টিম কাজ করছে, তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন দুদকের উপপরিচালক মো. সালাহউদ্দিন। অন্যরা হলেন, উপপরিচালক মো. সাইদুজ্জামান, সহকারী পরিচালক আফনান জান্নাত কেয়া, সহকারী পরিচালক এসএম রাশেদুল হাসান ও সহকারী পরিচালক একেএম মর্তুজা আলী সাগর।
অভিযোগ আছে, ১৭ ডিসেম্বর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৫০০ কোটি ডলারের বেশি বা ৫৯ হাজার কোটি টাকাসহ বিভিন্ন প্রকল্পে ৮০ হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। রূপপুর ছাড়াও আশ্রয়ণসহ ৮টি প্রকল্প দুর্নীতির তথ্য আমলে নিয়ে ১৮ ডিসেম্বর অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়।
এদিকে ২২ ডিসেম্বর শেখ হাসিনা এবং তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচারের পৃথক আরও একটি অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অভিযোগে বলা হয়েছে, আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই সম্প্রতি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিষয়ে একটি প্রাথমিক তদন্ত করে। ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র বনাম রিজভী আহমেদ মামলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের নাম প্রথম নজরে আসে। এফবিআই-এর তদন্তে সজীব ওয়াজেদ জয়ের গুরুতর আর্থিক কেলেঙ্কারির বিষয়টি উন্মোচিত হয়। বিশেষ করে তার নামে থাকা হংকং এবং কেম্যান আইল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংক হিসাব থেকে স্থানীয় একটি মানি এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে ওয়াশিংটন ডিসি, নিউইয়র্ক এবং লন্ডনের বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে টাকা পাচারের তথ্য উঠে এসেছে। এফবিআই তাদের লন্ডনের প্রতিনিধির মাধ্যমে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে এবং প্রমাণ পেয়েছে যে সেখানে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম এবং মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসের (ডিওজে) সিনিয়র ট্রায়াল অ্যাটর্নি লিন্ডা সেমুয়েলস স্পেশাল এজেন্ট লা প্রিভোটের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাংলাদেশ থেকে ৩০০ মিলিয়ন ডলার যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে জমা করা হয়েছে।
১৬ ডিসিম্বর শেখ হাসিনা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও ভাগনি টিউলিপ সিদ্দিকের মালয়েশিয়ার ব্যাংকের মাধ্যমে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র (আরএনপিপি) থেকে ৫ বিলিয়ন বা ৫০০ কোটি ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা) লোপাটের অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদকের নিস্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। ৩ সেপ্টেম্বর এ অভিযোগ অনুসন্ধানের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন এনডিএম-এর চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ। রিটে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতি অনুসন্ধানে দুদকের নিস্ক্রিয়তার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হয়। দুদক চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের রিটের বিবাদী করা হয়। এ ঘটনায় ২৩ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্যে টিউলিপ সিদ্দিককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন দেশটির কর্মকর্তারা। মূলত দেশটির মন্ত্রিপরিষদ অফিসের ন্যায় ও নৈতিকতা দল তাকে এই জিজ্ঞাসাবাদ করে। যুক্তরাজ্যের সংবাদপত্র সানডে টাইমসের বরাতে এ তথ্য জানার পর দুদক কর্মকর্তারা তা সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছেন। দুদক সূত্রে জানা যায়, শেখ হাসিনা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৫০০ কোটি ডলারের বেশি আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ আছে। গ্লোবাল ডিফেন্স করপোরেশনের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে আসে। প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা রোসাটম মালয়েশিয়ার একটি ব্যাংকের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে এ অর্থ আত্মসাতের সুযোগ করে দেয়। যাতে মধ্যস্থতা করেন ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও ভাগনি টিউলিপ সিদ্দিক। দেশের সবচেয়ে বড় ও ব্যয়বহুল প্রকল্প রূপপুরের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। অভিযোগ আছে-রাশিয়ার সহযোগিতায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে খরচ ধরা হয় ১ হাজার ২৬৫ কোটি ডলার। দরকারের তুলনায় যা অনেক বেশি। যাতে মালয়েশিয়ার একটি ব্যাংকের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে এই বাজেট থেকে ৫০০ কোটি ডলার আত্মসাতের সুযোগ করে দেয় প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা রোসাটম। নিজের ভাগনি টিউলিপ সিদ্দিকের মধ্যস্থতায় রাশিয়ার সঙ্গে এ চুক্তি করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর এ মধ্যস্থতার বিনিময়ে পাচার করা অর্থের ৩০ শতাংশ পেয়েছেন টিউলিপ সিদ্দিক, শেখ রেহানা ও পরিবারের কয়েকজন সদস্য।
২০১৩ সালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে শেখ হাসিনার সাক্ষাতের সময় সঙ্গী ছিলেন টিউলিপ সিদ্দিক। গ্লোবাল ডিফেন্স করপোরেশনের দাবি, সেসময় ঢাকা-মস্কোর বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র চুক্তির মধ্যস্থতাও করেন তিনি। ২০০৯ সালে ‘প্রচ্ছায়া লিমিটেড’ নামে একটি ভুয়া কোম্পানি চালু করেন টিউলিপ সিদ্দিক, তার মা শেখ রেহানা ও চাচা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক। যুক্তরাষ্ট্রেও জুমানা ইনভেস্টমেন্ট নামে একটি কোম্পানি রয়েছে তাদের। গ্লোবাল ডিফেন্স করপোরেশনের অভিযোগ, এ কোম্পানির মাধ্যমেই বিভিন্ন দেশের অফশোর অ্যাকাউন্টে অর্থ পাচার করতেন শেখ হাসিনা।
এদিকে ২০১৬ সালে দেশে পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এই দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। বিশ্বব্যাংকের ১১ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগের কথা উল্লেখ করে প্রকল্পে ঋণ সহায়তা দেওয়া থেকে সরে দাঁড়ায় বিশ্বব্যাংক। বিশেষ করে কানাডিয়ান নির্মাণ কোম্পানি এসএনসি লাভালিনের একটি নির্মাণ চুক্তির বিনিময়ে একজন বাংলাদেশি কর্মকর্তাকে ঘুস দেওয়ার অভিযোগকে আমলে নিয়ে তারা এই সিদ্ধান্ত নেয়। এসব অভিযোগ তখন অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দুদক। কিন্তু রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপে তখন সেই ফাইল আর সচল হয়নি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেই ফাইল এখন পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ সংক্রান্ত কাজও শুরু হয়েছে। শিগ্গিরই বিষয়টির অনুসন্ধানের অনুমোদনের জন্য ফাইল কমিশনে তোলা হবে। কমিশনের অনুমোদনের পর শুরু হবে অনুসন্ধান। আর নভোথিয়েটার দুর্নীতির অভিযোগের নতুন অনুসন্ধান শুরুর প্রক্রিয়াও চলছে।
