জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা
খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান খালাস
মামলা ছিল প্রতিহিংসামূলক, এতে তাদের সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে। রায়ে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ায় তারা হারানো সম্মান ফিরে পাবেন -আদালতের পর্যবেক্ষণ
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ১০ বছরের সাজা থেকে খালাস পেয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। একই সঙ্গে বিচারিক আদালত ও হাইকোর্টের রায় বাতিল করা হয়েছে। একই মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ অন্য আসামিরাও খালাস পেয়েছেন। খালেদা জিয়াসহ তিনজনের আপিল মঞ্জুর করে বুধবার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগ এ রায় দেন।
সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রায় দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে আপিল বিভাগ বলেন, এ মামলার বিচারিক আদালত ও হাইকোর্ট বিভাগের রায় বাতিল করা হলো। আপিলকারীদের দোষী সাব্যস্ত না করে তাদের সম্পূর্ণ খালাস দেওয়া হয়েছে। রায়ের পর খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, আপিল মঞ্জুর করা হয়েছে। নিম্ন আদালত ও হাইকোর্টের রায় বাতিল করেছেন আদালত। এ মামলায় যারা আপিল করতে পারেননি, তারেক রহমানসহ সবাইকে খালাস দিয়েছেন আদালত। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, এ মামলায় আসামিদের যে সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে, নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ায় তারা হারানো সম্মান ফিরে পাবেন এবং তাদের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া অযৌক্তিক বিচারিক কার্যক্রমের অবসান ঘটবে।
খালাসপ্রাপ্ত চারজন হলেন সাবেক সংসদ-সদস্য কাজী সালিমুল হক কামাল, সাবেক মুখ্যসচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ ও মমিনুর রহমান। তাদের সবাইকে বিচারিক আদালত ১০ বছর করে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দিয়েছিলেন। ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর হাইকোর্ট খালেদা জিয়ার আপিল খারিজ করে ১০ বছর সাজা বাড়িয়ে দেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ১৪ মার্চ খালেদা জিয়া পৃথক দুটি লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করেন। গত বছরের ১১ নভেম্বর আপিল বিভাগ খালেদা জিয়ার লিভ টু আপিল মঞ্জুর ও সাজার রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত করে আদেশ দেন। এর ধারাবাহিকতায় সাজার রায়ের বিরুদ্ধে পৃথক আপিল করেন খালেদা জিয়া। এছাড়া ১০ বছর কারাদণ্ড বহাল রেখে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সাবেক সংসদ-সদস্য কাজী সালিমুল হক কামাল ও ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ গত বছর পৃথক আপিল করেন। খালেদা জিয়ার আপিলের ওপর ৭ জানুয়ারি শুনানি শুরু হয়। চতুর্থ দিনে মঙ্গলবার শুনানি শেষ হয়।
ওইদিন শুনানিতে খালেদা জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নামে কুয়েত সরকার এই ফান্ড দিয়েছিল। ওই অর্থ ব্যাংকে জমা আছে, যে অর্থ দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে। আর এই অর্থে জিয়াউর রহমানের নামে বগুড়া ও বাগেরহাটে দুটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য রয়েছে। ২০০৬ সাল থেকে দুটি প্রতিষ্ঠান করার কাজ শুরু হয়। শুনানি শেষে আদালত বুধবার রায়ের জন্য দিন রাখেন। বুধবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে রায়ের আদেশ অংশটুকু ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। পর্যবেক্ষণে আদালত আরও বলেন, আপিলের বিষয়বস্তু থেকে এটা প্রমাণিত হয় যে, এ মামলায় আইনের কাল্পনিক অপপ্রয়োগ ঘটেছে। সেই বিবেচনায় এটি একটি বিদ্বেষপূর্ণ মামলা। এ রায় অন্যান্য আপিলকারী এবং যারা আপিল করেননি-উভয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। আদালতে খালেদা জিয়ার পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, ব্যারিস্টার এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন, ব্যারিস্টার এম বদরুদ্দোজা বাদল ও ব্যারিস্টার কায়সার কামাল শুনানিতে অংশ নেন। খালেদা জিয়া ও শরফুদ্দিনের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. রুহুল কুদ্দুস শুনানি করেন। কাজী সালিমুল হক কামালের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এসএম শাহজাহান। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আরশাদুর রউফ ও অনীক আর হক। দুদকের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আসিফ হাসান। শুনানির সময় খালেদা জিয়ার পক্ষে আইনজীবী রাগীব রউফ চৌধুরী, জাকির হোসেন ভূইয়া, মাকসুদ উল্লাহ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। রায়ের পর দুদকের আইনজীবী আসিফ হাসান বলেন, চারটি আপিল ছিল। চারটিই মঞ্জুর করেছেন আদালত। হাইকোর্ট বিভাগ ও বিচারিক আদালতের রায় বাতিল করেছেন। সঙ্গে যারা আপিল করতে পারেননি, তাদেরও (খালাস) দিয়েছেন। যেহেতু পুরো মামলাই বলেছেন ম্যালিসাস প্রসিকিউশন (বিদ্বেষপূর্ণ কার্যধারা), তাই তারাও এ সুবিধা পেয়ে খালাস পেলেন। দুজনের মধ্যে একজন তারেক জিয়া। আরেকজন কামাল সিদ্দিকী। রায়টি দুদককে জানানো হবে। এরপর দুদক সিদ্ধান্ত নেবে।
রায়ের পর জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, যে মামলায় কিছুই ছিল না, সে মামলায় হাইকোর্ট বিভাগ সাজা পাঁচ বছর থেকে ১০ বছর করেন। এটি খুবই দুঃখজনক। সেই মামলার মধ্যে কোনো সারবত্তাই ছিল না। অর্থাৎ বিচারব্যবস্থা বলে কিছু ছিল না। ফ্যাসিস্ট সরকার যেভাবে বলত, সেভাবে রায় হতো। আজ মনে হয়েছে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করেছে। তিনি বলেন, আজ রায়ে আদালত বলেছেন, আপিল ইজ অ্যালাউড (আপিল মঞ্জুর)। আরও বলেছেন, বিচারিক আদালতের যে রায় দেওয়া হয়েছে, হাইকোর্ট বিভাগের যে রায় দেওয়া হয়েছে, সেগুলো বাতিল করে দেওয়া হলো। আদালত বলেছেন, যারা আপিল করতে পারেননি, তারেক রহমানসহ সবাইকে খালাস দেওয়া হয়েছে। এ প্রসিকিউশন ছিল বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসামূলক। কার বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা? পুরো জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে। সারা দেশের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা।
এতিমদের সহায়তার উদ্দেশ্যে বিদেশ থেকে পাঠানো ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে। এ অভিযোগে খালেদা জিয়াসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই মামলাটি করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বিশেষ জজ আদালত-৫ রায় দেন। রায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক সংসদ-সদস্য কাজী সালিমুল হক কামাল, সাবেক মুখ্যসচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ ও মমিনুর রহমানকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে হাইকোর্টে আপিল করেন খালেদা জিয়া। কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে কাজী সালিমুল হক ও শরফুদ্দিন আহমেদ পৃথক আপিল করেন। অন্যদিকে খালেদা জিয়ার সাজা বৃদ্ধি চেয়ে দুদকের করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট রুল দেন। তিনটি আপিল ও রুলের ওপর শুনানি শেষে ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর হাইকোর্ট একসঙ্গে রায় দিয়েছিলেন। রায়ে খালেদা জিয়ার আপিল খারিজ হয়। দুদকের রিভিশন আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দেওয়া রুল যথাযথ ঘোষণা করে খালেদা জিয়ার সাজা বাড়িয়ে ১০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ ও কাজী সালিমুল হকের আপিল খারিজ করেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে গত বছর পৃথক আপিল করেন শরফুদ্দিন আহমেদ ও কাজী সালিমুল হক। এ দুটি আপিল খালেদা জিয়ার আপিলের সঙ্গে শুনানির জন্য কার্যতালিকায় ওঠে এবং শুনানি হয়।
