Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

খাদ্য অধিদপ্তরে বদলি বাণিজ্য

বহাল তবিয়তে ফ্যাসিস্টের ‘ত্রিরত্ন সিন্ডিকেট’

আওয়ামী সুবিধাভোগীরাও গুরুত্বপূর্ণ পদে পোস্টিং বাগিয়ে নিচ্ছেন * বিতর্কিতদের পদায়ন ঘিরে উত্তেজনা, রাতের অন্ধকারে আদেশ বাতিল

মাহবুব আলম লাবলু

মাহবুব আলম লাবলু

প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বহাল তবিয়তে ফ্যাসিস্টের ‘ত্রিরত্ন সিন্ডিকেট’

ছবি: সংগৃহীত

সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার ও সাবেক সচিব ইসমাইল হোসেন দুর্নীতির দায়ে গ্রেফতার হয়ে কারাবন্দি। কিন্তু খাদ্য অধিদপ্তরে তাদের দোসরদের রাজস্ব এখনো অটুট। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া মহাপরিচালক এখনো ‘ঘোরের’ মধ্যে থাকায় ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে পতিত সরকারের কারাবন্দি মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ একটি চক্র। অধিদপ্তরের ভেতরে-বাইরে এরা ‘ত্রিরত্ন সিন্ডিকেট’ হিসাবে পরিচিত। অভিযোগ আছে-পছন্দের জায়গায় পোস্টিং পেতে সিন্ডিকেট সদস্যদের ম্যানেজ করতে দেনদরবার করছেন বিতর্কিত কর্মকর্তারা। সম্প্রতি ফ্যাসিবাদের দোসর হিসাবে চিহ্নিত এক কর্মকর্তার ভালো পদে পদায়ন ঘিরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ঘুসের টাকাসহ ধরা পড়লে বাধ্য হয়ে রাতের আঁধারেই তার বদলি আদেশ বাতিল করা হয়। ভুক্তভোগীরা বলেছেন, সাধন-ইসমাইলের ঘনিষ্ঠ সহচরদের সেই পুরনো চক্র ফের পুরো মাত্রায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে। একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

জানতে চাইলে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল হাসনাত হুমায়ন কবির যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর একটি বদলির ঘটনায় অর্থ লেনদেনের প্রমাণ পাওয়ায় সেটা বাতিল করা হয়। এছাড়া আর কোনো বদলির ঘটনা ঘটেনি। আজকেও (মঙ্গলবার) আমাকে পাঁচজন বদলির জন্য তদবির করেছে। এগুলো আমাদের এখান থেকে হয় না, এগুলো ওসি, এলএসডি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি আসলে ঘোরের মধ্যে আছি। তাই কে দুর্নীতিবাজ, কে ফ্যাসিস্টের সুবিধাভোগী তা চিহ্নিত করতে একটু সময় লাগবে।’

প্রাপ্ত নথিপত্রে দেখা গেছে, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ড. মহসিন আলীকে ঢাকা রেশনিং ৪নং এলাকা থেকে ময়মনসিংহের ধোবাউরা উপজেলায়, রেশনিং-২ এর কর্মকর্তা নাইয়ারা নূরকে রেশনিং এলাকা-৪ এবং চিন্তামনি তালুকদারকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থেকে রেশনিং এলাকা-২ এ বদলি করা হয়। অভিযোগ আছে-এই বদলির ক্ষেত্রে বিপুল অঙ্কের আর্থিক লেনদেন হয়েছে। বর্তমান মহাপরিচালক যোগদানের পরদিন ‘ত্রিরত্ন সিন্ডিকেট’ তাকে ভুল বুঝিয়ে অতিগোপনে রাতের আঁধারে এই বদলির আদেশ জারি করেন। বদলির এই আদেশে নীতিমালাবহির্ভূতভাবে আওয়ামী লীগের চিহ্নিত দোসর নাইয়ারা নূরকে গুরুত্বপূর্ণ রেশনিং এলাকা-৪ এ (এখানে আগেও ছিলেন তিনি) পদায়নের খবর পেয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। পরে পরিস্থিতি সামাল দিতে খাদ্য সচিবের নির্দেশে রাতেই এই আদেশ সংশোধন করে নাইয়ারা নূরকে নরসিংদী জেলার মনোহরদী উপজেলায় বদলি করা হয়।

জানা গেছে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ মজুমদার ও সাবেক খাদ্য সচিব ইসমাইল হোসেন মিলে শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন। এতে জড়িত ছিলেন মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তরের বেশ কিছু কর্মকর্তা। এছাড়া মন্ত্রীর ভাই মনা মজুমদার, মেয়ে তৃণা মজুমদার, মেয়ের জামাই আবু নাসের বেগ (মাগুরার সাবেক জেলা প্রশাসক), বন্ধু চন্দন সাহাসহ কয়েকজন ব্যবসায়ী এই সিন্ডিকেটে জড়িত ছিলেন। মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের ঠিকাদারি, দেশি-বিদেশি সংগ্রহ, বদলি-পদোন্নতি ও নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন এই সিন্ডিকেট সদস্যরা। খাদ্য অধিদপ্তরের এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে ছিলেন পরিচালক (প্রশাসন) জামাল হোসেন। মন্ত্রী-সচিব দুর্নীতির দায়ে কারাবন্দি থাকলেও জামাল হোসেন এখনো বহাল তবিয়তে। ‘ত্রিরত্ন’ সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক হিসাবে নেমেছেন বদলি বাণিজ্যে। সাধন মজুমদারের আস্থাভাজন হিসাবে পরিচালক পদে বসার আগে স্বৈরশাসকের পুরো আমলেই তিনি রাজশাহী, ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো বড় জায়গায় আরসি ফুডের দায়িত্ব পালন করেন। ডিসি ফুড হিসাবেও তিনি বগুড়া, ঠাকুরগাঁওসহ গুরুত্বপূর্ণ জেলায় চাকরি করেছেন।

অভিযোগ আছে-বদলির টাকা ভাগাভাগি নিয়ে সাধনের মেয়ের জামাইয়ের সঙ্গে বিরোধে জামাল হোসেনকে চট্টগ্রাম থেকে আকস্মিক বদলি করা হয়েছিল। চট্টগ্রামে তার বদলি বাণিজ্যের সহযোগী ছিলেন খাদ্য পরিদর্শক আসাদুজ্জামান ভুঁইয়া। জামাল হোসেন পরিচালক (প্রশাসন) হওয়ার পর আসাদুজ্জামানকে বদলি করে ঢাকায় এনে গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার পোস্টিং দেন। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির ঘনিষ্ঠ আসাদুজ্জামান জুলাই বিপ্লবের সময় ছাত্র-জনতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে ফেসবুকে বহু স্ট্যাটাস দেন। এখনো তিনি বহাল তবিয়তে চাকরি করছেন। ঢাকার আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক শ্রীপুর গুদাম পরিদর্শনে গিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়ার পরও জামাল হোসেনের প্রভাবের কারণে আসাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি।

জানতে চাইলে পরিচালক (প্রশাসন) জামাল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘আমার পদটাই বড় জায়গায় চাকরি করার, তাই গত ১৬ বছর বড় জায়গায় চাকরি করেছি। এখন পরিচালক প্রশাসন হিসাবে খাদ্য ভবন আমি না চালালে কে চালাবে।’

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ‘ত্রিরত্ন’ সিন্ডিকেটের হোতা জামাল হোসেনের বদলি বাণিজ্যের অন্যতম সহযোগী উপপরিচালক মনিরুল ইসলাম ও তেজগাঁও সিএসডির ম্যানেজার আব্দুর রহিম। এই তিনজনের ঘনিষ্ঠতার কারণে তারা ‘ত্রিরত্ন’ সিন্ডিকেট হিসাবে পরিচিত। মনিরুল ফ্যাসিবাদের দোসর ও আওয়ামী সুবিধাভোগী। দলীয় প্রভাব খাটিয়ে তিনি নাটোর, জয়পুরহাট, ঠাকুরগাঁও, কুড়িগ্রামের মতো সংগ্রহপ্রবণ জেলায় ডিসি ফুড হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির এন্তার অভিযোগ। তার দুর্নীতির প্রতিবাদে মানববন্ধন হয়েছে। কুড়িগ্রামে দায়িত্ব পালনকালে ঠিকাদার নিয়োগে অনিয়মের ঘটনায় বিক্ষুব্ধরা অবরুদ্ধ করে রাখে। ফলে বিভাগীয় ব্যবস্থা হিসাবে তাকে প্রত্যাহার করে অধিদপ্তরে সংযুক্ত করা হয়। কিন্তু সাবেক ছাত্রলীগ নেতা পরিচয়ে তিনি কোনো কিছু পাত্তা দেননি। এখানে উপপরিচালক হিসাবে পদায়নের পর তিনি জামাল হোসেনের সিন্ডিকেটে যোগ দিয়ে বদলি বাণিজ্যে মেতে ওঠেন। তাকে ‘ফুয়েল’ না দিলে কোনো ফাইল নড়ে না। এখনো দাপটে চাকরি করছেন সাবেক ছাত্রলীগ পরিচয়ধারী এই কর্মকর্তা।

অভিযোগ সম্পর্কে উপপরিচালক মনিরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি কখনো কোনো রাজনীতি করিনি। জামাল সাহেবের সঙ্গে সিন্ডিকেট কেন করব, আমার ডেস্কের কাজই হলো আমার লাইন ডিরেক্টরের সঙ্গে কাজ করা। ডিজি বা ডিরেক্টরের নির্দেশনা মতো আমি ফাইল ইনেশিয়েট করি।’

জানা গেছে, ত্রিরত্ন সিন্ডিকেটের আরেক সদস্য তেজগাঁও সিএমএসডির ম্যানেজার আব্দুর রহিম। তিনি ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচনের কারিগর হিসাবে পরিচিত নওগাঁর সাবেক জেলা প্রশাসক গোলাম মওলার পারিবারিক ঘনিষ্ঠ। তার (গোলাম মওলা) মাধ্যমে সাধন মজুমদারকে দিয়ে তিনি ইচ্ছেমতো পোস্টিং নিতেন। পতিত সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি সুবিধা ভোগ করেছেন। বেশির ভাগ সময়ই তিনি বড় বড় গুদামে পোস্টিংয়ে ছিলেন। জয়পুরহাট ও সিরাজগঞ্জ গ্রেড-১ খাদ্য গুদামের এসএন্ডএমও, দিনাজপুর সিএসডি এবং সবশেষ গুরুত্বপূর্ণ রাজধানীর তেজগাঁও সিএসডির দায়িত্ব পান। দিনাজপুর সিএসডিতে তার চাকরির মেয়াদ দুই বছর পূর্ণ না হতেই তাকে তেজগাঁওয়ে নিয়ে আসা হয়। পরিচালক (প্রশাসন) জামাল হোসেন তাকে এখনো আগলে রেখেছেন বলে জানা গেছে।

জানতে চাইলে তেজগাঁও সিএসডির ম্যানেজার আব্দুল রহিম বলেন, আমি কারও বদন্যতায় চাকরি করি না। আমার কোনো সিন্ডিকেটও নেই। যারা পোস্টিং দেন তারা ভালো বলতে পারবেন আমাকে কেন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পোস্টিং দিয়েছেন।’

সংশ্লিষ্টরা জানান, সিন্ডিকেটের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে বদলি ও তদবির বাণিজ্যে লিপ্ত ফ্যাসিস্টের সুবিধাভোগী দিনাজপুর সিএসডির দেলোয়ার হোসেন, কিশোরগঞ্জ সদরের খাদ্য নিয়ন্ত্রক তাজুল ইসলাম ও আসাদুজ্জামান ভূঁইয়া। জামাল হোসেন নিজের অধিক্ষেত্র ছাড়াও আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকদের মাধ্যমে বদলি বাণিজ্যে একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। আমন সংগ্রহের কারণে বদলি বন্ধ থাকলেও তিনি রংপুর জেলার পীরগঞ্জ, দিনাজপুরের বিরল, ঠাকুরগাঁও এবং পীরগঞ্জ এলএসডিতে চাপ দিয়ে বদলি করিয়ে নেন। গুদামে পদায়নের আশ্বাস দিয়ে তিনি অনেক কর্মকর্তার কাছ থেকে মোটা টাকা তুলেছেন। আগে বদলি বাণিজ্যের যে টাকা কারাবন্দি সাবেক মন্ত্রী সাধন মজুমদার ও তার ঘনিষ্ঠরা নিতেন এখন সেই টাকা নিচ্ছেন জামাল হোসেনের সিন্ডিকেট। পরিচালক প্রশাসনের দপ্তরে প্রতিদিন বিকালে যেন বদলি বাণিজ্যের হাট বসে।

প্রাপ্ত তথ্য বলছে, বর্তমান খাদ্য সচিব মাসুদুল হাসান দায়িত্ব নেওয়ার পর মন্ত্রণালয় ঘিরে থাকা সাধন সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য উপসচিব কুল প্রদীপ চাকমা, জয়নাল মোল্লা, সাবেক সচিবের পিএস আরিফ ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তা গোলাম রব্বানীকে মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু খাদ্য অধিদপ্তরে পুরোনো দোসরদের রাজত্ব এখনো অটুট। এখানে জামাল হোসেনের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে কোটি কোটি টাকার জোগানদাতা সাধন সিন্ডিকেটের কর্মকর্তারা এখনো বহাল। এদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা দূরের কথা কাউকে বদলি পর্যন্ত করা হয়নি।

সাধন চন্দ্র মজুমদার আওয়ামী লীগ দুর্নীতি

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম