তদন্তকারীদের হত্যার চেষ্টা
আয়নাঘরে বোমার সঙ্গে সেট করা হয় টাইমার
সাংবাদিকদের চিফ প্রসিকিউটর: শিগগিরই দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালের যাত্রা শুরু হবে * বিচার বানচালে আসামিদের কোনো চেষ্টা সফল হবে না
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৭ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ‘আয়নাঘর’ নামের কুখ্যাত গোপন বন্দিশালা নিয়ে এবার বেরিয়ে এলো আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। ওই বন্দিশালায় তদন্তকারী কর্মকর্তাদেরও হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এর অংশ হিসাবে আয়নাঘরে আগে থেকেই বোমা পুঁতে রাখা হয়। তদন্তসংশ্লিষ্টরা হঠাৎ করে আয়নাঘর পরিদর্শনে গেলে আওয়ামী লীগের দোসরদের অপরাধ পরিকল্পনা ধরা পড়ে যায়।
রোববার গণহত্যার কয়েকটি মামলার শুনানি শেষে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের কাছে এমন তথ্য প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, বন্দিশালায় রাখা বোমাগুলোর সঙ্গে টাইমারও সেট করা ছিল। এ থেকে বোঝা যায়, এ সংক্রান্ত তদন্ত যারা করতে গিয়েছেন তাদেরও হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। তদন্ত শুরুর প্রথম থেকেই চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম এই বিচারকে ঘিরে নানা ষড়যন্ত্রের কথা বলে আসছিলেন। জুলাই গণহত্যার বিচার বানচালে মোটা অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগের প্রমাণ মিলেছে বলে গত ৩ এপ্রিল সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন তিনি। প্রসিকিউশনের একটি সূত্র যুগান্তরকে জানিয়েছে, তদন্তকারীদের হত্যার জন্য আয়নাঘরে বোমার সঙ্গে টাইমার সেট করা সংক্রন্ত অপরাধের বিষয়টি তারা ট্রাইব্যুনালের নজরে আনা হতে পারে। তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের আরও বলেন, ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা গুমের মামলাগুলো তদন্ত করছে। টিএফআই সেলের নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সেটার ভেতরে ভূগর্ভস্থ, অনেকটা বলা যাবে সেমি ভূগর্ভস্থ সেলগুলো আবিষ্কার করা হয়েছে। যেগুলো ওয়াল তুলে বন্ধ করা হয়েছিল। সেই ওয়াল ভাঙতে হয়েছে। গার্বেজ দিয়ে সেটাকে ভরে রাখা হয়েছিল। সেগুলো সরিয়ে ক্রাইম সিন বের করতে (শনাক্ত) হয়েছে।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এই কাজ (তদন্তসংক্রান্ত) করতে গিয়ে অর্থাৎ স্বয়ং চিফ প্রসিকিউটর এই ইনভেস্টিগেশন চলাকালে প্রেজেন্ট (উপস্থিত) ছিলেন। সেখানে বোমার সঙ্গে টাইমারও সেট করা ছিল। অ্যাপারেন্টলি বোঝা যায় যে, এই ইনভেস্টিগেশন করতে যারা গিয়েছেন তাদের হত্যা করারও চেষ্টা করা হয়েছে।’ এ বিষয়ে অপর এক প্রশ্নে তাজুল ইসলাম বলেন, ‘এ বিষয়ে আর মন্তব্য করছি না। সময় হলে জানতে পারবেন।
এত সব জটিলতার মধ্য দিয়ে যে কাজগুলো এগিয়েছে, সেগুলো প্রতিদিন জনসমক্ষে আসেনি উল্লেখ করে তাজুল ইসলাম বলেন, ‘যে কারণে অনেকে মনে করতে পারেন তদন্তকাজ কিছু হয়নি। মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত সময়সাপেক্ষ। এই ট্রাইব্যুনাল যখন আগের রেজিমের সময় ছিল, তখন প্রথম তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে ১৬ মাস সময় নিয়েছে।’ তিনি জানান, এ মাসের মধ্যে অন্তত দুটি মামলার ফরমাল (আনুষ্ঠানিক) চার্জ দাখিল করা সম্ভব হবে বলে আশা করছি।
তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনালের বিচারকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছে। কিন্তু কোনো ষড়যন্ত্র বা কোনো স্ক্যান্ডাল বিচারকাজ থামাতে পারবে না। ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থার কোনো দুর্নীতি কেউ প্রমাণ করতে পারবে না। আসামিদের পক্ষ থেকে বিচার বানচালের চেষ্টা সফল হবে না বলে জানান তিনি।
শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দায়ের করা মামলার তদন্ত প্রসঙ্গে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, জুলাই-আগস্টের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার প্রভাবশালী মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দায়ের হওয়া তিন মামলার তদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনের হাতেও এসেছে। প্রতিবেদন তিনটি যাচাই-বাছাই চলছে। আশা করছি অন্তত দুটি মামলার ফরমাল চার্জ এ মাসেই দাখিল করতে পারব। এর মধ্যে রয়েছে হত্যা ও গণহত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এক মামলা, আশুলিয়ায় লাশ পোড়ানোর ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে এক মামলা ও চানখাঁরপুল গণহত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন। এর মধ্যে অন্তত দুটি মামলার ফরমাল চার্জ এ মাসেই ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হবে।
এদিকে জুলাই-আগস্ট গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার দ্রুত করার জন্য শিগগিরই দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের যাত্রা শুরু হবে বলে জানিয়েছেন চিফ প্রসিকিউটর। সরকার এ বিষয়ে ইতিবাচক চিন্তা-ভাবনা করছে বলেও জানান তিনি। বলেন, আমরা মনে করি একটি ট্রাইব্যুনাল যথেষ্ট নয়। আরও ট্রাইব্যুনাল হওয়া উচিত।
গত ১২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার কচুক্ষেতে ডিজিএফআই এবং উত্তরা ও আগারগাঁওয়ে র্যাবের আয়নাঘর পরিদর্শন করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সঙ্গে ছিলেন উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, প্রসিকিউশন, তদন্ত সংস্থা, ভুক্তভোগী ও সাংবাদিকরা। পরিদর্শন শেষে প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন, যে খুপরির মধ্যে ভুক্তভোগীদের রাখা হয়েছে, গ্রামে মুরগির খাঁচাও এর থেকে বড় হয়। তাদেরকে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর এভাবে বন্দি করে রাখা হয়েছে। মানুষ হিসাবে সামান্যতম মানবিক অধিকার থেকেও তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে।
গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যা ও গণহত্যা এবং আওয়ামী লীগের বিগত সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে গুম-খুনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরদ্ধে এ পর্যন্ত তিন শতাধিক অভিযোগ জমা পড়ে ট্রাইব্যুনালে। এতে শেখ হাসিনা ও তার দলের রাজনীতিক, সাবেক সেনা কর্মকর্তা, সাবেক মন্ত্রী, পুলিশ এবং গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠকদের নাম রয়েছে।
সূত্র জানায়, প্রাপ্ত অভিযোগ যাচাই-বাছাই করে প্রসিকিউশন বাদী হয়ে ট্রাইব্যুনালে ২৩টি মামলা (মিস কেস) করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩টি মামলা হয়েছে গুমের ঘটনায়। বাকি ২০টি মামলা হয়েছে গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায়। এসব মামলায় ১৫৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি রয়েছে। এছাড়া গ্রেফতার আছেন ৫২ জন (২৭ মার্চ পর্যন্ত)। গত ১৭ অক্টোবর দুই মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা এবং দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল। এছাড়া শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে ‘নির্বিচারে হত্যা ও লাশ গুম করে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে বেশ কয়েকটি আবেদন হয়েছে। তদন্ত শেষে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচারকাজ শুরু হবে।
এসি তানজিল-ওসি আবুল হাসান ট্রাইব্যুনালে : এদিন জুলাই-আগস্টের গণহত্যা মামলায় ঢাকার ওয়ারী জোনের সাবেক এসি তানজিল আহমেদ ও যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসানকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়েছে। সকালে প্রিজন ভ্যানে করে ট্রাইব্যুনালে তাদের হাজির করে পুলিশ। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় গণহত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রোববার প্রতিবেদন দাখিলের কথা ছিল।
দুই পুলিশ সদস্যকে একদিন করে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি : রোববার পৃথক দুই আবেদনে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সাভারের ইয়ামিন হত্যা এবং চানখাঁরপুলে আনাছ হত্যা মামলায় দুই পুলিশ সদস্যের একদিন করে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন ট্রাইব্যুনাল।
