ক্ষতিগ্রস্ত হবে দুই দেশই
ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করল ভারত
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১০ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বাংলাদেশকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা হঠাৎ করেই বাতিল করেছে ভারত সরকার। ভারতের কেন্দ্রীয় পরোক্ষ কর ও শুল্ক বোর্ডের এক সার্কুলারে এই সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে। ট্রান্সশিপমেন্টের আওতায় বর্তমানে বাংলাদেশের পণ্যবোঝাই যেসব ট্রাক ভারতের মাটিতে অবস্থান করছে, দ্রুততম সময়ের মধ্যে সেগুলো সরিয়ে ফেলার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার থেকে নতুন এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করেছে ভারত সরকার। দেশটির এমন সিদ্ধান্তে ভারত হয়ে তৃতীয় দেশে পণ্য পরিবহণের সুবিধা হারালেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা। তবে ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে প্রভাব পড়বে না বলে জানিয়েছে ভারত সরকার।
এদিকে ভারতের এ সিদ্ধান্তের পর বুধবার রাতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জরুরি বৈঠকে বসেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ওই বৈঠক চলাবস্থায় রাত সাড়ে ৮টায় বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান যুগান্তরকে জানান, বৈঠক শেষ হওয়ার পর সিদ্ধান্ত জানানো হবে।
বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভারতও ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা পেয়ে আসছে। ওই চুক্তির বিষয়ে সরকার কিছু ভাবছে না বলে জানিয়েছেন নৌপরিবহণ উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারসংক্রান্ত চুক্তি পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে গতকাল রাতে তিনি যুগান্তরকে বলেন, চুক্তিগুলো যে অবস্থায় হয়েছে, সেই অবস্থায় আছে। এগুলো নিয়ে এই মুহূর্তে আমরা কিছুই চিন্তা করছি না। এই চুক্তির আওতায় ভারতীয় পণ্য নৌপথে বাংলাদেশে এসে সড়কপথে দেশটির সেভেন সিস্টার্সভুক্ত রাজ্যগুলোতে নেওয়া হয়।
বাংলাদেশকে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের বিষয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এতে দেশটি জানিয়েছে, দেশটির বিমানবন্দর ও বন্দরগুলোতে পণ্য চাপ বেড়েছে। এতে তাদের নিজস্ব রপ্তানি কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং রপ্তানি ব্যয় ও সময় বাড়ছে। ওই কারণে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে প্রভাব পড়বে না বলে জানিয়েছে ভারত সরকার। যদিও ভারতের এমন সিদ্ধান্তে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। তারা বলেছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক জারির মধ্যে আরেকবার হোঁচট খেলেন তারা। তবে দুদেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ভারত
উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রাজস্ব হারাবে আর বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের দ্রুত পণ্য রপ্তানির সুযোগ কমবে।
জানতে চাইলে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ট্যারিফ প্ল্যানের পর ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল তৈরি পোশাক রপ্তানির জন্য আরেকটি ধাক্কা। এই মুহূর্তে ভারতের দিল্লি, কলকাতা এয়ারপোর্ট বা অন্য সমুদ্রবন্দর দিয়ে পণ্য বিদেশে কম রপ্তানি হচ্ছে। কিন্তু এই সুযোগ বন্ধ হওয়ায় একটা সম্ভাবনা কমে গেল। এতে পণ্য রপ্তানির লিড টাইম ও খরচ দুটোই বেড়ে যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, করোনার সময়ে ঢাকা এয়ারপোর্টে স্ক্যানার অচল থাকায় দিল্লি ও কলকাতা এয়ারপোর্ট দিয়ে প্রচুর পণ্য ইতালি, জার্মানিতে রপ্তানি হয়েছে। কেন ভারত ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করল তা খতিয়ে দেখা দরকার। সাম্প্রতিক সময়ে স্থলবন্দর দিয়ে ভারতীয় সুতা আমদানি বন্ধ করায় এই সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
এমন সিদ্ধান্তে ভারত রাজস্ব হারাবে বলে মনে করেন বিজিএমইএর সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি আব্দুল্লাহ হিল রাকিব। তিনি বলেন, এ সিদ্ধান্ত আমাদের ব্যবসার ওপর তেমন প্রভাব পড়বে না। তবে ভারত উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রাজস্ব হারাবে। কারণ তারা তাদের অতিরিক্ত কার্গো স্পেস আমাদের পণ্যের জন্য বরাদ্দ করেছিল। বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফা) সভাপতি কবির আহমেদ বলেন, প্রাথমিকভাবে এতে কিছুটা চাপ সৃষ্টি হতে পারে, কারণ আগে আমাদের অতিরিক্ত কার্গো ভারতীয় বিমানবন্দর দিয়ে যেত। তবে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এবং বাফার মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে এই ধাক্কা সামলানো সম্ভব। কারণ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো হ্যান্ডলিং সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে। প্রয়োজনে আমরা শ্রীলংকা ও মালদ্বীপের বিমানবন্দরও অতিরিক্ত কার্গোর জন্য ব্যবহার করতে পারি। এতে বাংলাদেশ কিছু অতিরিক্ত রাজস্ব ধরে রাখতে পারবে। আর ভারত সেই রাজস্ব হারাবে। ভারত সরকারের এমন সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক বলে মনে করেন তিনি।
২০২০ সালের জুনে জারি করা এক আদেশে বাংলাদেশকে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দিয়েছিল ভারত। এই সুবিধার আওতায় বাংলাদেশ তৃতীয় কোনো দেশে পণ্য রপ্তানির জন্য ভারতের স্থলবন্দর ও বিমানবন্দর ব্যবহার করতে পারত। এখন সেই সুবিধা বাতিল করল মোদি সরকার। সাধারণত সমুদ্রপথে রপ্তানি পণ্য পাঠিয়ে থাকেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। তবে যেসব রপ্তানি পণ্য জরুরিভাবে পাঠাতে হয়, সেগুলো সড়কপথে দিল্লিতে যায়, সেখান থেকে বিমানে পাঠানো হয়। এতে খরচ ও সময় দুই সাশ্রয় হয় বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের।
বাংলাদেশের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের কারণ তুলে ধরে ভারতীয় গণমাধ্যম পিটিআই জানিয়েছে, বিশেষত গার্মেন্টস খাতের ভারতীয় রপ্তানিকারকরা দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশকে দেওয়া এই সুবিধা বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। তারা অভিযোগ করছিলেন, প্রতিদিন প্রায় ২০-৩০টি ট্রাক বাংলাদেশ থেকে দিল্লি বিমানবন্দর কার্গো টার্মিনালে প্রবেশ করে, যার ফলে ভারতীয় পণ্যের রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে। বিমান সংস্থাগুলো অতিরিক্ত ভাড়া নিচ্ছে ও কার্গো প্রক্রিয়ায় দেরি হচ্ছে, যার ফলে ভারতীয় পণ্যের প্রতিযোগিতা ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ভারতের অ্যাপারেল এক্সপোর্ট প্রমোশন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান সুধীর সেখরি বলেন, দিল্লির কার্গো টার্মিনালে বাংলাদেশের পণ্য প্রবেশে জটলা তৈরি হচ্ছে। এর ফলে প্লেন ভাড়ার হার বেড়েছে, রপ্তানি পণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণে বিলম্ব হচ্ছে ও ভারতীয় রপ্তানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
ভারতীয় বিশ্লেষকদের দাবি, এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ধাক্কা। গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের প্রতিষ্ঠাতা অজয় শ্রীবাস্তব বলেন, বাংলাদেশের রপ্তানি-আমদানি ব্যবস্থাপনা অনেকাংশে ভারতীয় অবকাঠামোর ওপর নির্ভর করে। ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বন্ধ হলে, বাংলাদেশের রপ্তানি প্রক্রিয়ায় দেরি, খরচ বৃদ্ধি ও অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে। তিনি আরও বলেন, এই সিদ্ধান্ত নেপাল ও ভুটানের জন্যও সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, কারণ দুটি দেশই ভূমিবেষ্টিত ও তারা বাংলাদেশে পণ্য পাঠাতে ভারতীয় রুট ব্যবহার করে। এর ফলে, এই দুই দেশও ভারতের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করতে পারে। শ্রীবাস্তব আরও জানান, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী, সদস্য দেশগুলোকে ভূমিবেষ্টিত দেশগুলোর জন্য স্বাধীন ট্রানজিট সুবিধা দিতে হয়। অর্থাৎ, তাদের পণ্য অবাধে গন্তব্যে যেতে দিতে হবে, যাতে অপ্রয়োজনীয় দেরি, শুল্ক বা নিষেধাজ্ঞা আরোপ না করা হয়। ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য হওয়ায় এই সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি অনুযায়ী প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে।
