জুলাই শহিদের কন্যার আত্মহত্যা
সংঘবদ্ধ ধর্ষণের নেপথ্যে বয়ফ্রেন্ড ও সহপাঠীরা
বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে ইমরানের পরিবার * মা বলছেন, ‘দোষীদের বিচার নিজ হাতে করতে চাই’
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সংঘবদ্ধ ধর্ষণের জেরে জুলাই আন্দোলনে শহিদ জসিম উদ্দিনের কন্যা লামিয়ার (১৭) আত্মহত্যার নেপথ্যে জড়িত তারই বয়ফ্রেন্ড ইমরান মুন্সি। ঘটনার পর থেকে সে আত্মগোপনে চলে যায়। মামলার এজাহারে নাম না থাকা এবং বাবার রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে ইমরানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ। লামিয়ার আত্মহত্যার খবর জানতে পেরে বয়ফ্রেন্ড ইমরান মুন্সির বাবা-মাসহ পুরো পরিবার বাড়িঘরে তালা দিয়ে আত্মগোপনে চলে গেছে। প্রতিবেশী ও স্বজনরা বলছেন, নির্দোষ হলে তারা গা-ঢাকা দিত না। স্বামীকে হারানোর পর মেয়ে লামিয়ার এমন করুণ মৃত্যুতে পাগলপ্রায় মা রুমা বেগম। ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, ‘আমার মেয়েকে যারা বাঁচতে দেয়নি আমি নিজ হাতে তাদের বিচার করতে চাই।’ লামিয়ার পরিবার ও স্বজনরা এমন নিষ্ঠুর ঘটনার নেপথ্যে জড়িতদের কঠোর শাস্তি দাবি করেছেন। রোববার রাতে পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলার পাঙ্গাসিয়া গ্রামের বাড়িতে বাবা শহিদ জসিম উদ্দিনের কবরের পাশে লামিয়াকে কবর দেওয়া হয়েছে। এর আগে তার জানাজায় অংশ নেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ও এনসিপির মুখ্যসংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমসহ গণ্যমান্য ব্যক্তি ও এলাকার লোকজন।
শনিবার রাত ৯টার দিকে রাজধানীর শেখেরটেক ৬ নম্বর রোডের বি/৭০ নম্বর বাড়িতে ভাড়া বাসায় নিজ রুমে ফ্যানের সঙ্গে ওড়না প্যাঁচিয়ে ফাঁস দেয় কলেজছাত্রী লামিয়া। গুরুতর অবস্থায় উদ্ধার করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। রোববার সকালে ময়নাতদন্ত শেষে পুলিশ পরিবারের কাছে লামিয়ার মৃতদেহ হস্তান্তর করে। পরে ফ্রিজিং অ্যাম্বুলেন্সে তার মৃতদেহ পটুয়াখালীর গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়।
এর আগে ১৮ মার্চ পটুয়াখালীর দুমকিতে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় লামিয়া। পরদিন থানায় গিয়ে মামলা করে। শহিদ বাবার কবর জিয়ারত করে নানাবাড়ি ফেরার পথে গণধর্ষণের শিকার হয় বলে মামলায় অভিযোগ করে সে। মামলার এজাহারে দুজনকে আসামি করা হয়। ১৯ মার্চ রাতে এজাহারভুক্ত সাকিব মুন্সিকে বাড়ি থেকে এবং ২১ মার্চ অপর আসামি সিফাত মুন্সিকে পিরোজপুরের নাজিরপুর থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে তারা গণধর্ষণে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতেও অপরাধ স্বীকার করে পুরো ঘটনার বিবরণ দিয়েছে। এর নেপথ্যে লামিয়ার বয়ফ্রেন্ড ইমরান মুন্সির জড়িত থাকার কথাও স্বীকার করেছে তারা। তবে পুলিশ রহস্যজনক কারণে বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, ধর্ষক ইমরানের বাবা মালেক মুন্সি স্থানীয় প্রভাবশালী হওয়ায় এই ঘৃণ্য অপরাধে ইমরানের নাম এলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ। এ কারণে মানসিকভাবে আরও ভেঙে পড়ে লামিয়া। পটুয়াখালীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাজেদুল ইসলাম সজল জানান, ধর্ষণের ঘটনায় ভুক্তভোগী ওই তরুণী মামলার এজাহারে সিফাত মুন্সী ও শাকিব মুন্সিকে আসামি করেছিল। ওই তরুণীর সঙ্গে ইমরান মুন্সির সম্পর্ক ছিল বলে আমাদের ধারণা। যে কারণে তরুণী মামলার এজাহারে ইমরান মুন্সি?কে এড়িয়ে গেছে। এ কারণে পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে ইমরান মুন্সির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেনি। পরে তদন্তে ইমরান মুন্সির সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। ইমরান মুন্সি এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কারণেই আত্মগোপনে চলে গেছে। তাকে আইনের আওতায় আনতে পুলিশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
লামিয়ার মায়ের আহাজারি : সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার লামিয়ার আত্মহত্যার খবরে অসুস্থ হয়ে পড়েন তার মা রুমা বেগম। তাকে শনিবার রাতেই শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। সেখানে তিনি মেয়ের কথা বলতে গিয়ে আহাজারি করছিলেন আর বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। আহাজারি করতে করতে তিনি বলেন, ‘আমার মেয়েকে যারা বাঁচতে দেয়নি, তাদের আমার সামনে এনে দিন, আমি নিজ হাতে তাদের মেরে ফেলব। আমি আর কিছু চাই না। তিনি জানান, ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর থেকেই লামিয়া কোনো কথা বলত না। জিজ্ঞেস করলেও কোনো কথার জবাব দিত না। চুপ করে থাকত। আমি তাকে ঢাকায় নিয়ে আসি ডাক্তার দেখাতে। রোববার বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল। তার এইচএসসি পরীক্ষা সামনে। এজন্য নিউমার্কেট থেকে কিছু জামা-কাপড়ও কিনে দেই। তিনি বলেন, বাড়ি ফিরল আমার মেয়ে, তবে লাশ হয়ে।
ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের ডিসি ইবনে মিজান জানান, প্রাথমিক তদন্তে নিশ্চিত হওয়া গেছে, লামিয়া আত্মহত্যা করেছে। তার আত্মহত্যার নেপথ্যে কোনো কারণ আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মোহাম্মদপুর শাখার আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম রাব্বী বলেন, যেই উপদেষ্টারা জসিম ভাইয়ের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে উপদেষ্টা হয়েছেন, তারা এখন পর্যন্ত শহিদের মেয়ের ধর্ষকদের বিচার করতে পারেননি। আপনারা ধর্ষকদের বিচার করতে না পারলে পদ থেকে সরে যান।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ১৯ জুলাই ঢাকার মোহাম্মদপুরে লামিয়ার বাবা জসিম উদ্দিন গুলিবিদ্ধ হন। ১০ দিন পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।
বাবার কবরের পাশেই শায়িত লামিয়া : লামিয়ার লাশ রোববার সন্ধ্যায় নিজ বাড়ি পটুয়াখালীর দুমকির পাঙ্গাশিয়া ইউনিয়নের গ্রামের বাড়িতে এসে পৌঁছে। রাত ৮টার দিকে বাড়ির পাশে মাঠে লামিয়ার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ঢাকা ও পটুয়াখালী জেলা বিএনপি নেতৃবৃন্দ ও এনসিপির নেতৃবৃন্দসহ জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা অংশ নেন। জানাজা শেষে রাতেই বাবা শহিদ জসিমের কবরের পাশেই তাকে দাফন করা হয়। বাবার কবরের পাশেই তার জন্য কবর খুঁড়েছেন দাদা আবদুস সোবাহান। তিনি বলেন, শনিবার সকালে আমার সঙ্গে লামিয়ার কথা হয়েছিল। আন্দোলনে ছেলেকে হারালাম। ভেবেছিলাম নাতনি রয়েছে, সেও চলে গেল। লামিয়ার মৃত্যুর খবরে দুমকির পাঙ্গাশিয়া ইউনিয়নজুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। এই মর্মান্তিক ঘটনায় এলাকাবাসী, সমাজকর্মী এবং ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে শহিদ কন্যার আত্মহত্যা খবর পেয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে ‘আমরা বিএনপি পরিবার’-নামে সংগঠনের একটি প্রতিনিধি দল পটুয়াখালীর দুমকিতে চলে এসেছে। এ প্রতিনিধি দলে রয়েছেন সংগঠনের প্রধান উপদেষ্টা ও বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, সংগঠনের আহ্বায়ক আতিকুর রহমান রুমন ও সদস্য সচিব মোকছেদুল মোমিন মিথুন। এছাড়াও এনসিপির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, যুগ্ম সদস্য সচিব ফয়সাল মাহমুদ শান্ত এবং গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় সদস্য সচিব জাহিদ হাসান শোকার্ত পরিবারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।
