কমান্ডারর্স কনফারেন্সে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান
ভারত যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করলে দাঁতভাঙা জবাব
উত্তরপ্রদেশের গঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে ভারতের বিমানবাহিনীর মহড়া * দুদেশকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ০৩ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ভারত ও পাকিস্তানের চলমান উত্তেজনার মধ্যে কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখায় ট্যাংক, কামান, গোলা নিয়ে পূর্ণমাত্রার সামরিক মহড়া চালিয়েছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। সেই সঙ্গে পহেলগাঁওয়ের ঘটনার জেরে ভারত যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করলে দাঁতভাঙা জবাব দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। এদিকে সংকট নিরসনে ভারতকে রাজি করাতে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক করেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ। আর উত্তেজনা প্রশমনে ভারত ও পাকিস্তানকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। খবর জিও টিভি, রয়টার্স, ইকোনোমিক টাইমস, এক্সপ্রেস ট্রিবিউনের।
টাইমস অব ইন্ডিয়া শুক্রবার জানিয়েছে, পাকিস্তান টানা ৮ম দিনেও নিয়ন্ত্রণ রেখাজুড়ে বিনা উসকানিতে গুলি চালিয়েছে আর ভারত এর পালটা জবাব দিয়েছে। ভারতের সেনাবাহিনী জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার রাতে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী জম্মু ও কাশ্মীরের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল কুপওয়ারা, বারামুল্লা, পুঞ্চ, নওশেরা এবং আখনুর এলাকার বিপরীতে নিয়ন্ত্রণ রেখাজুড়ে বিনা উসকানিতে ছোট অস্ত্রের গুলি চালিয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সৈন্যরা একটি সুশৃঙ্খল এবং আনুপাতিকভাবে এর জবাব দিয়েছে।
ইকোনমিক টাইমস বৃহস্পতিবার জানিয়েছে, পাকিস্তানের সেনারা সীমান্তে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েন করেছে। এছাড়া গোলন্দাজ ইউনিটগুলোকে সামনের দিকে নিয়ে এসেছে। পাকিস্তান রাজস্থানের লংয়েওয়ালা সেক্টরের সীমান্তে রাডার সিস্টেম এবং আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েন করেছে। অন্যদিকে পাক বিমানবাহিনী একই সময়ে তিনটি আলাদা মহড়া চালিয়েছে। এতে এফ-১৬, জে-১০ এবং জেএফ-১৭সহ সব ধরনের বড় যুদ্ধবিমান মহড়ায় যুক্ত করেছে তারা। ২৯ এপ্রিল থেকে বিমানবাহিনীর এসব মহড়া চলছে। এছাড়া ভারতের সঙ্গে সীমান্তবর্তী লাইন অব কন্ট্রোলের (এলওসি) কাছে পূর্ণমাত্রার সামরিক মহড়া চালিয়েছে পাকিস্তানের সেনারা। সেখানেও তারা ট্যাংক, কামান, গোলা ও তাজা গুলি নিয়ে মহড়া দিয়েছে। সেনাবাহিনীর সূত্র জানিয়েছে, এই মহড়া শত্রুপক্ষের যে কোনো ধরনের আগ্রাসনকে কঠোর জবাব দেওয়ার জন্য সাজানো হয়েছে। এতে বিভিন্ন ইউনিটের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সাধারণ সেনারা অংশ নেন।
জিও নিউজ জানায়, ভারতের পহেলগাঁওয়ে বন্দুক হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার জেরে ভারত যদি যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করে, তাহলে দাঁতভাঙা জবাব দেওয়া হবে। এমন কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। একইসঙ্গে তারা দেশের জনগণের সম্মান রক্ষায় যেকোনো মূল্যে প্রস্তুত থাকার অঙ্গীকারও করেছে। শুক্রবার পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে সেনা সদর দপ্তরে সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত স্পেশাল কর্পস কমান্ডারর্স কনফারেন্স (সিসিসি)-এর পর এই ঘোষণা দেওয়া হয়। বৈঠকে অংশগ্রহণকারী শীর্ষ সেনা কর্মকর্তারা দেশের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় অটল থাকার অঙ্গীকার করেন।
সিসিসি বৈঠকে ভূরাজনৈতিক পরিবেশ, পাকিস্তান-ভারতের চলমান উত্তেজনা, এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সেনাপ্রধান আসিম মুনির দেশের সশস্ত্র বাহিনীর পেশাদারত্ব, মনোবল এবং অপারেশনাল প্রস্তুতির ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি সব সীমান্তে উচ্চ সতর্কতা ও কার্যকর প্রস্তুতিও জোরদারের তাগিদ দেন।
এর আগে বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত সামরিক দুঃসাহস দেখালে কঠোর জবাব দেওয়ার হুমকি দেন পাক সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির। সেনাদের মহড়া পরিদর্শনে গিয়ে সেনাপ্রধান একটি ট্যাংকের ওপর দাঁড়িয়ে বলেন, ‘কোনো অস্পষ্টতা নেই। ভারতের যে কোনো সামরিক দুঃসাহসের দৃঢ়, দ্রুত ও কঠোর জবাব দেওয়া হবে। পাকিস্তান আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় আমাদের প্রস্তুতি এবং সংকল্প অত্যন্ত দৃঢ়।’
এদিকে এক সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার জানিয়েছেন, পাকিস্তান আগে থেকে যুদ্ধ শুরু করবে না। কিন্তু ভারত যদি করে তাহলে তাদের কঠোর জবাব দেওয়া হবে। তিনি বলেন, ‘বিশ্ব নেতারা সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানাচ্ছেন। সরকার এবং জাতির পক্ষ থেকে আমি স্পষ্ট করেছি, পাকিস্তান প্রথমে কোনো ধরনের উত্তেজনা বৃদ্ধির ব্যবস্থা নেবে না, যুদ্ধ শুরু করবে না। কিন্তু যদি ভারতীয় পক্ষ থেকে এমন কিছু হয়। আমরা অত্যন্ত শক্তির সঙ্গে জবাব দেব।’
এদিকে দুদেশের উত্তেজনার মধ্যে বিকল্প রানওয়ের ক্ষমতা যাচাই করতে ভারত উত্তর প্রদেশের গঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে বিমানবাহিনীর মহড়া চালিয়েছে। হিন্দুস্থান টাইমস জানিয়েছে, শুক্রবার পরিচালিত এ মহড়ায় বিমানবাহিনীর রাফায়েল থেকে জাগুয়ার সব ধরনের যুদ্ধ বিমানই অংশ নিয়েছে। এএনআই জানিয়েছে, জাতীয় আপৎকালীন পরিস্থিতি বা যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এই এক্সপ্রেসওয়ের বিকল্প রানওয়ে হিসাবে ব্যবহার করার ক্ষমতা যাচাই করতেই এই মহড়া চালানো হয়েছে। শুক্রবার উত্তর প্রদেশের আকাশজুড়ে ফ্লাইপাস্ট করেছে রাফাল, জাগুয়ার, সুখোই-৩০ এমকেআই, মিরাজ-২০০০, মিগ-২৯, সি ১৩০ জে সুপার হারকিউলিস, এএন ৩২ ট্রান্সপোর্ট এয়ারক্রাফ্ট, এমআই ১৭ ভি ফাইভ হেলিকপ্টার।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শুক্রবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত নাওয়াফ বিন সাঈদ আল-মালিকির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন এবং পহেলগাঁও ঘটনার পর দক্ষিণ এশিয়ার সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে পাকিস্তানের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তান সব ধরনের সন্ত্রাসবাদের নিন্দা করে। ‘বিগত বছরগুলোতে সন্ত্রাসবাদবিরোধী প্রচেষ্টায় তারা ত্যাগ স্বীকার করেছে। এটি শুধু পাকিস্তানকে নয়, সমগ্র বিশ্বকে রক্ষা করার জন্য করা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। সেই সঙ্গে তিনি দক্ষিণ এশিয়ায় উত্তেজনা প্রশমন ও উত্তেজনা প্রশমনে ভারতকে চাপ দিতে সৌদি আরব এবং অন্যান্য ভ্রাতৃপ্রতিম দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূত হামাদ ওবায়েদ ইব্রাহিম সালেম আল জাবিরও শুক্রবার তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তার সঙ্গে বৈঠকেও প্রধানমন্ত্রী বতর্মান উত্তেজনাকর পরিস্থিতি প্রশমনে ভারতকে রাজি করাতে আরব আমিরাতকে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান।
এদিকে পহেলগাঁওয়ে হামলার পর ভারত ও পাকিস্তানকে সামরিক সংঘাত এড়িয়ে শান্তির লক্ষ্যে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে আমেরিকা। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে এক ফোনালাপে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও উত্তেজনা কমাতে সংলাপের আহ্বান জানান। রুবিও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সঙ্গেও কথা বলেছেন, হামলার তদন্তে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন। জয়শঙ্কর অপরাধীদের জবাবদিহিতার ওপর জোর দিলেও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে বলেছে যে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অধীনে, সন্ত্রাসবাদকে সমর্থনকারীরা পরিণতির মুখোমুখি হবে।
পহেলগাঁওয়ে হামলা নিয়ে পালটাপালটি বক্তব্য : ভারতশাসিত কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে হামলার পেছনে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ জড়িত; টেলিগ্রামে ‘ফাঁস’ হওয়া এক গোপন নথির উদ্ধৃতি দিয়ে চাঞ্চল্যকর এ দাবি করেছে পাকিস্তানের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম। তবে ওই নথিটি আসল কিনা, তা স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। টেলিগ্রামে ফাঁস হওয়া গোপন নথির বরাতে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়েছে, পহেলগাঁয়ের ওই ঘটনাটিকে ‘অমুসলিম জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে চালানো হামলা’ বলে প্রচার চালানোর সুস্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই হামলার সঙ্গে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) ও লস্কর-ই-তৈয়বার যোগসূত্র ছিল। আইএসআইর একাধিক লোকজনের নির্দেশে লস্কর এই ভয়াবহ হামলার পরিকল্পনা করেছিল। পাকিস্তানে লস্করের সদর দপ্তরেই এই ছক কষা হয়েছিল বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। বলা হচ্ছে, ওভারগ্রাউন্ড কনটাক্ট হিসাবে কয়েকজন কাজ করেছিল। তাদের মধ্যে সন্দেহভাজন কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। আর তাদের কাছ থেকে একের পর এক তথ্য মিলছে। সেখানেই দেখা যাচ্ছে পাকিস্তানভিত্তিক দুষ্কৃতকারীরাই এই হামলার ঘটনায় কলকাঠি নেড়েছিল।
