‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ’ অনুমোদন
‘বিতর্কিত’ ৯টি ধারা বাতিল মামলাও খারিজ
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৭ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ’র খসড়া অনুমোদন দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। এতে আগের সাইবার নিরাপত্তা আইনের ৯টি ‘বিতর্কিত’ ধারা বাদ দেওয়া হয়েছে। এসব ধারাতেই বিগত সরকারের সময় ৯৫ শতাংশ মামলা হয়েছিল। বাতিল ধারাগুলোতে দায়েরকৃত মামলা স্বয়ংক্রিয়ভাবে খারিজ হয়ে যাবে। ধর্মীয় উসকানিমূলক বক্তব্য বা কনটেন্ট, যা সহিংসতা উসকে দিতে পারে, তাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। এছাড়া প্রস্তাবিত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে ইন্টারনেটকে প্রথমবারের মতো মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে অনলাইন জুয়া নিষিদ্ধ এবং সাইবার জগতে নারী ও শিশু নির্যাতন এবং যৌন হয়রানিকেও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে দেখানো হয়েছে। এদিনের বৈঠকে সিভিল প্রসিডিউর কোড (সিপিসি) চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়।
মঙ্গলবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল এসব তথ্য জানান। এর আগে সকালে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের খসড়া উপস্থাপন করা হয়। কিছু সংশোধন শেষে এই সপ্তাহে গেজেট আকারে প্রকাশ হতে পারে।
সাইবার নিরাপত্তা আইনের বিভিন্ন নেতিবাচক দিক তুলে ধরেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, কিছু কিছু ধারা পরিবর্তন করা হয়েছে। মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে দুটি অপরাধ রাখা হয়েছে নতুন অধ্যাদেশে। একটি হচ্ছে নারী ও শিশুর প্রতি যৌন নির্যাতনমূলক কন্টেন্ট প্রকাশ, হুমকি দেওয়া। আরেকটি হচ্ছে ধর্মীয় ঘৃণা ছড়ানো, যেই ঘৃণা ছড়ানোর মধ্য দিয়ে সহিংসতা উসকে দেওয়া হয়। ধর্মীয় ঘৃণাকে কঠোরভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, যাতে ভুল বোঝাবুঝি না হয়, কেউ কাউকে হয়রানি করতে না পারে। ধর্মীয় উসকানিমূলক বক্তব্য বা যেকোনো কনটেন্ট যেটার কারণে সহিংসতা উসকে দিতে পারে, সেটাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করা হয়েছে।
উপদেষ্টা বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথমবারের মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে যদি কোনো সাইবার অপরাধ করা হয়, সেটাকে শাস্তিযোগ্য করা হয়েছে। নারী ও শিশুর প্রতি যৌন নির্যাতনমূলক কন্টেন্ট প্রকাশ বা ধর্মীয় ঘৃণা ছড়ানোর কন্টেন্ট প্রকাশের মাধ্যমে সহিংসতা উসকে দেওয়ার অপরাধের ক্ষেত্রেও রক্ষাকবচ রেখেছি। এ ধরনের কোনো মামলা কারও বিরুদ্ধে হলে এটা আমলি আদালতে যাবে, যাওয়ার পর ম্যাজিস্ট্রেট যদি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দেখেন এই মামলায় কোনো যৌক্তিকতা নেই, তাহলে প্রি-ট্রায়াল স্টেজে তিনি মামলা বাতিল করে দিতে পারবেন। অর্থাৎ চার্জশিটের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। যদি দেখেন সম্পূর্ণ ভুয়া মামলা, এই মামলার কোনো ভিত্তি নেই, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এই মামলা বাতিল করে দিতে পারবেন। এই অপরাধগুলোকে যেমন আমলযোগ্য রেখেছি তেমনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে আপসযোগ্যও রেখেছি।
যেসব বিধান বিলুপ্ত করা হয়েছে
আসিফ নজরুল বলেন, সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে আগের বেশ কিছু বিধান বিলুপ্ত করা হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-আগের আইনের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় শহিদ বা জাতীয় পতাকা সম্পর্কিত বিদ্বেষ বিভ্রান্তি ও কুৎসামূলক প্রচারণার দণ্ডসংক্রান্ত যে বিধান, সেটা বিলুপ্ত করা হয়েছে। এই বিধানে প্রচুর হয়রানিমূলক মামলা হতো। মানহানিকর তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে দণ্ডের যে বিধান, এটাতে প্রচুর মামলা হতো, অনেক সাংবাদিক এই মামলার ভুক্তভোগী হয়েছেন। এ ধারা সম্পূর্ণ বাতিল করা হয়েছে। আরেকটি হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে এ ধরনের কোনো কন্টেন্ট বা কথাবার্তা বলায় প্রচুর মামলা হতো, এটাও সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করা হয়েছে। আক্রমণাত্মক বা ভীতিকর তথ্যউপাত্ত প্রকাশ এটাও সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করা হয়েছে।
আগের আইনের নির্যাতনমূলক ৯টি ধারায় ৯৫ শতাংশ মামলা হয়েছিল। এই আইনটি (নতুন অধ্যাদেশ) যখন গেজেট নোটিফিকেশন হবে, তার আগের দিন পর্যন্ত ওই ৯ ধারায় যত মামলা হয়েছে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। এছাড়া, সাইবার সিকিউরিট অ্যাক্টের কিছু কিছু ধারায় যে মামলা করা হয়েছিল, সেসব ধারার মামলাও বাতিল হবে। যেমন সাইবার সন্ত্রাসী কার্য সংগঠন ও দণ্ড, পরিচয় প্রতারণা বা ছদ্মবেশ ধারণের দণ্ড। এই ধারাগুলো নতুন আইনেও আছে, তবে সংজ্ঞা এমনভাবে পরিবর্তন হয়েছে যে আগের ধারায় করা মামলা আর টিকে থাকবে না। সাইবার স্পেসে জালিয়াতির অপরাধ, ই-ট্রানজেকশনের অপরাধ, ধর্মীয় বা জাতিগত সহিংসতা বা ঘৃণা বিদ্বেষমূলক তথ্য প্রকাশ, যৌন হয়রানি, ব্ল্যাক মেইলিং অর্থাৎ কথা বলে মতামত প্রকাশের মাধ্যমে যে অপরাধ হতো সেগুলো সবকিছু জামিনযোগ্য করা হয়েছে।
তিনি বলেন, এখানে সাইবার সিকিউরিটি কাউন্সিল আছে। যারা কন্টেন্ট অপারেশন করবে। কোনো আক্রমণাত্মক বা অপরাধমূলক কন্টেন্ট থাকে সেই কন্টেন্ট অপসারণ করবে। এই কাউন্সিলে সিভিল সোসাইটির লোক থাকবে। কন্টেন্ট অপারেশনের পরে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে আদালতের অনুমোদন নিতে হবে। আদালত যদি বলে এই কন্টেন্ট সরানো যাবে না, তাহলে সেটা পুনরায় প্রকাশ করতে হবে। এটা আবার জনগণকে জানাতে হবে।
সিভিল মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হবে
আসিফ নজরুল বলেন, গত বৈঠকে (উপদেষ্টা পরিষদ) সিপিসি (সিভিল প্রসিডিউর কোড)-এটা আগে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। মঙ্গলবার এটা চূড়ান্তভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশে সিভিল মামলা নিষ্পত্তি নিয়ে বছরের পর বছর এমনকি যুগের পর যুগ লাগে। এখানে আমরা অনেক পরিবর্তন এনেছি। তার মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হলো-আগে ইচ্ছেমতো মামলার শুনানি মুলতবি করা যেত। এখন আর করা যাবে না। তিনি বলেন, সিভিল মামলার রায় পাওয়ার পর বাস্তবায়নের জন্য আলাদা মামলা করতে হতো। এটাও আর করতে হবে না। সমন জারির ক্ষেত্রেও অনেক সহজ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছি। আশা করি সিভিল মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হতে এই আইন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
নারী কমিশনের প্রস্তাব সরকারি সিদ্ধান্ত নয়
নারী সংস্কার কমিশনসংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে ড. আসিফ নজরুল বলেন, যে কোনো ধরনের বড় সংস্কার রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া বাস্তবায়ন হবে না। ভিন্নমত ও প্রতিক্রিয়া জ্ঞাপনের ক্ষেত্রে সহনশীলতা ও শালীনতার পরিচয় দেয়ার আহ্বান জানান তিনি। আইন উপদেষ্টা বলেন, নারী সংস্কার কমিশনের যে প্রস্তাব তা একটি কমিশনের প্রস্তাব, সরকারি সিদ্ধান্ত নয়। আমাদের যতগুলো সংস্কার কমিশন হয়েছে সবগুলোর ব্যাপারে কিছু না কিছু ক্ষেত্রে ভিন্নমত এসেছে। নারী সংস্কার কমিশনের যে প্রস্তাব সেখানেও ভিন্ন মত থাকতেই পারে। আসিফ নজরুল বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভিন্নমত শালীনভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে অত্যন্ত বিদ্বেষমূলক, আক্রমণাত্মক এবং নারী শুধু নয়, গোটা জাতির প্রতি অবমাননাকরভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে। আমরা এটা আশা করি না, সমাজে ভিন্নমতের চর্চা থাকবে।
নির্বাচন কমিশন আইনের সংশোধন
আইন উপদেষ্টা আরও বলেন, অনেক রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন কমিশনের আপত্তি এবং অভিযোগের পর বিভিন্ন নির্বাচনি এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণসংক্রান্ত আইন সংশোধনীর অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। নির্বাচন কমিশনের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে এ সংশোধন করা হয় বলেও জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, গত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে ইচ্ছেমতো নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। এগুলো নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়া সীমানা নির্ধারণসংক্রান্ত আইনের একটি মিসটেকের কারণে নির্বাচন কমিশন কাজ করতে পারছিল না। নির্বাচন কমিশন অনুরোধ করেছে সেটা সংশোধন করার জন্য। আমরা আইনটি সংশোধন করে দিয়েছি। ড. আসিফ নজরুল বলেন, এখন সীমানা পুনর্নির্ধারণ-সংক্রান্ত নির্বাচন কমিশনের যে সাংবিধানিক দায়িত্ব আছে তা তারা এই আইন গেজেট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু করতে পারবেন।
অতীতে অনেক ঢাকঢোল পেটানো হয়েছে
যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছেন, এন্টারপ্রেনারশিপ নিয়ে অতীতে অনেক ঢাকঢোল পেটানো হয়েছে। কিন্তু স্ট্রাকচারাল কোনো কাজ সেভাবে চোখে পড়েনি। এখনো যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উদ্যোক্তা বলতে সেই সেলাই মেশিন ও পাটের বস্ত্র বানানো। কিন্তু উদ্যোক্তা বিষয়টি তো এখন পৃথিবীতে অন্য লেভেলে চলে গেছে। আমাদের অনেকেই আছে যে ভালো ভালো স্টার্টআপ আছে। সেই জায়গা থেকে সরকার অনেক পিছিয়ে আছে। সেই জায়গা থেকে উদ্যোক্তা নীতিমালা ২০২৫ করা হয়েছে। যাতে করে এন্টারপ্রেনারদের আমরা সহযোগিতা করতে পারি।
উপদেষ্টা বলেন, দেশের তরুণ ও যুবসমাজকে এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেবে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর। আগামী জুন-জুলাই থেকে এ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি শুরু হতে পারে। তিনি বলেন, পৃথিবীর সঙ্গে তালমিলিয়ে তরুণরা যাতে নিজেদের তৈরি করতে পারে ঠিক সেভাবেই সামনে প্রশিক্ষণগুলো ডিজাইন করা হবে।
আঁশ তুলা কৃষিপণ্য হিসেবে ঘোষণা
সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব জানান, আঁশ তুলা কৃষিপণ্য হিসাবে ঘোষণা করার প্রস্তাব অনুমোদন পেয়েছে। এর ফলে যারা তুলা চাষ করতে আগ্রহী, তাদের জন্য কৃষিঋণ পাওয়া সহজ হবে। চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশ এনার্জি পোর্ট লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি গঠনের জন্য যে কমিটি তৈরি করা হয়েছিল, সেই কমিটি এবং কোম্পানির প্রস্তাব দুটোই বাতিল করা হয়েছে।
