জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক
প্রাদেশিক সরকার প্রতিষ্ঠায় দ্বিমত এনসিপির
‘মৌলিক সংস্কারের রূপরেখা’ হস্তান্তর * গণভোটের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন * কুমিল্লা ও ফরিদপুরকে নতুন বিভাগ দাবি
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৭ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
গণভোটের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন চায় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তবে রাষ্ট্রের ক্ষমতাসংশ্লিষ্ট এবং জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছাড়া ছোট সংশোধনীতে গণভোটের প্রয়োজন নেই। প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিতে হবে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে। দেশে প্রাদেশিক সরকার প্রতিষ্ঠায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে দ্বিমত তাদের। অন্যদিকে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি কুমিল্লা ও ফরিদপুরকে বিভাগ ঘোষণা করার পক্ষে মত দিয়েছে দলটি। মঙ্গলবার জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এনসিপির সঙ্গে ‘বর্ধিত আলোচনায়’ বসে। এ সময় দলটির পক্ষ থেকে কমিশনের কাছে ‘মৌলিক সংস্কারের রূপরেখা’ তুলে ধরা হয়। আলোচনার বিরতিতে সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার ও সদস্য সচিব আখতার হোসেন।
ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বে বৈঠকে অংশ নেন কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, বদিউল আলম মজুমদার, ড. ইফতেখারুজ্জামান, সফর রাজ হোসেন, আইয়ুব মিয়া ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য) মনির হায়দার। এনসিপির পক্ষে আরও উপস্থিত ছিলেন দলটির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম, জাবেদ রাসিন, আরমান হোসাইন প্রমুখ। এ সময় অধ্যাপক আলী রীয়াজ আশা প্রকাশ করেন, সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য গঠনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ১৫ মের মধ্যে আলোচনা শেষ হবে।
জেলা পরিষদ ও উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পদ বাতিলের বিপক্ষে এনসিপি মত দিয়েছে উল্লেখ করে সারোয়ার তুষার বলেন, স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার বিষয়টিতে তারা জোর দিয়েছেন। কমিশন ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যদের ভোটে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচনের কথা বলেছে। কিন্তু এনসিপি জনগণের সরাসরি ভোটে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচনের বিধান করার কথা বলেছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহারের বিপক্ষে এনসিপির অবস্থান জানিয়ে তিনি বলেন, এই নিয়ম আওয়ামী ফ্যাসিবাদ তাদের স্বার্থে চালু করেছিল। যেটা সমাজে ভয়াবহ সাংস্কৃতিক বিপর্যয় ঘটিয়েছে। দলীয় প্রতীক না থাকলে সমাজের ভালো মানুষগুলো জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন। নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে সেটা তদন্ত করার প্রস্তাব দেয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এনসিপি এই প্রস্তাবের সঙ্গে দ্বিমত জানিয়ে বলেছে, নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে তদন্ত করা যেতে পারে।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে এনসিপি আগে অর্থ বিল এবং অনাস্থা ভোট ছাড়া অন্য যে কোনো প্রস্তাবে সংসদ-সদস্যদের স্বাধীনতার পক্ষে মত দেয়। আলোচনায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সংবিধান সংশোধনীর ক্ষেত্রে এনসিপির অবস্থানকে পুনরায় বিবেচনা করার আহ্বান জানায়। সারোয়ার তুষার বলেন, আমরা কমিশনকে জানিয়েছি, সংবিধান সংশোধনীর ক্ষেত্রে সংসদ-সদস্যদের স্বাধীনতার পক্ষে আমরা এখনো অনড় রয়েছি। তবে এ অবস্থানের বিষয়ে আমরা পরবর্তী সময়ে আলোচনা করব। সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রধান হিসাবে বিরোধী দলের সদস্যকে রাখার প্রস্তাব দিয়েছে এনসিপি। সব মন্ত্রণালয় না হলেও জনপ্রশাসন, সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু দায়িত্বে বিরোধী দলের সদস্যদের রাখতে আলোচনা হয়েছে।
সংবিধান সংশোধনীর ক্ষেত্রে গণভোটের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এনসিপি এই প্রস্তাবের পক্ষে। তবে রাষ্ট্রের ক্ষমতাসংশ্লিষ্ট এবং জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছাড়া সংবিধানের ছোট সংশোধনীর ক্ষেত্রে গণভোটের আয়োজন করার বাধ্যবাধকতা রাখার প্রয়োজন নেই। কোন ধারায় গণভোটের বাধ্যবাধকতা থাকবে, সেটাও সুনির্দিষ্ট হতে হবে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে ঐকমত্য কমিশন সংসদের উচ্চকক্ষ ও নিুকক্ষের সদস্যদের ভোটের কথা বলেছে। এনসিপি এই প্রস্তাবের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে। এছাড়া ভোটারের আওতা আরও বাড়ানোর পক্ষে মত দিয়েছে।
এর আগে সকালে বৈঠকের শুরুতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে মৌলিক সংস্কারের রূপরেখা তুলে দেন এনসিপির প্রতিনিধিরা। ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, সংস্কারের পথ উন্মুক্ত করতে এই আলোচনা কার্যকরী হবে বলে আমরা আশাবাদী।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, মৌলিক সংস্কার বলতে কোনো নির্বাচনি ব্যবস্থার সংস্কার নয় বা আসনভিত্তিক দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সংবিধান সংস্কারের মতো বিষয়গুলো নয়। ক্ষমতার ভারসাম্য, জবাবদিহিতা ও বিকেন্দ্রীকরণ-এ তিন বিষয়ে সংস্কারকে আমরা মৌলিক সংস্কার বলছি। সাংবিধানিক ও রাষ্ট্র কাঠামো থেকে কীভাবে স্বৈরতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী উপাদানগুলো সরানো যায়, সাংবিধানিক পদগুলোয় নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয়করণের বাইরে এসে কীভাবে জাতীয় স্বার্থকে প্রতিফলিত করা যায়, কীভাবে বিচার বিভাগকে রাজনীতিমুক্ত করে সত্যিকার অর্থে ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসাবে হাজির করা যায়, এ বিষয়গুলো মৌলিক সংস্কারের অন্তর্ভুক্ত। এসব বিষয়ে এনসিপির তরফে একটি রূপরেখা দেওয়া হয়েছে।
