Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরলেন খালেদা জিয়া

জনতার ভালোবাসায় সিক্ত

পথে পথে নেতাকর্মীসহ লাখো মানুষের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস * পুত্রবধূর হাত ধরে হেঁটে ‘ফিরোজায়’ * ১৭ বছর পর মাকে স্পর্শ করলেন জোবাইদা রহমান * অল্প কিছুদিনের মধ্যেই দেশে ফিরবেন তারেক রহমান * দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা বিএনপি চেয়ারপারসনের

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ০৭ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জনতার ভালোবাসায় সিক্ত

ছবি: সংগৃহীত

চিকিৎসা শেষে চার মাস পর মঙ্গলবার লন্ডন থেকে দেশে ফিরেছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তার এই ফিরে আসায় দলের নেতাকর্মীসহ লাখো জনতা রাজপথে নেমে তাকে অভ্যর্থনা জানান। বিমানবন্দর, বনানী হয়ে গুলশান সড়কজুড়ে জনতার ঢল নামে। কারও হাতে ফুল, ব্যানার-প্ল্যাকার্ড, কেউবা প্রিয় নেত্রীর ছবি সংবলিত টি-শার্ট পরা, আবার কেউ স্রেফ একনজর চেয়ে ছিলেন সেই মুখপানে; যেখানে জমে আছে আবেগ ও ইতিহাস। খালেদা জিয়া হাসলেন, হাত নাড়লেন, এতেই কাঁপল লাখো নেতাকর্মীর মন। তার এই প্রত্যাবর্তন শুধু একটি রাজনৈতিক ঘটনাই নয়, এটা প্রিয় মানুষের ঘরে ফেরা; যা মানুষের মনে জাগিয়েছে নতুন আশা, নতুন ভোরের স্বপ্ন। তিনি ছিলেন, আছেন, থাকবেন-এ কথা যেন আরেকবার প্রমাণ হয়ে গেল বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী-সমর্থক ও সাধারণ মানুষের ভালোবাসার ফুলেল অভ্যর্থনায়। সর্বস্তরের মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে ফিরোজায় পৌঁছালেন দেশনেত্রী খালেদা জিয়া। দেশবাসীর প্রতিও শুভেচ্ছা-কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। 

খালেদা জিয়াকে বহনকারী কাতারের রাজপরিবারের বিশেষ বিমান এয়ার অ্যাম্বুলেন্স সকাল ১০টা ৪২ মিনিটের দিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এ সময় সঙ্গে ছিলেন দুই পুত্রবধূ-বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সহধর্মিণী ডা. জোবাইদা রহমান এবং ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর সহধর্মিণী সৈয়দা শর্মিলা রহমান। বিমানবন্দরে তাদের ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানান বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমেদ, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, সেলিমা রহমান, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ সিনিয়র নেতারা। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে বেলা ১১টা ২০ মিনিটের দিকে খালেদা জিয়ার গাড়িবহর গুলশানের বাসভবন ফিরোজার উদ্দেশে যাত্রা করে। এ সময় পতাকা নেড়ে দলীয় প্রধানকে শুভেচ্ছা জানান নেতাকর্মীরা। পথে পথে তাকে অভ্যর্থনা জানান লাখো মানুষ। সড়কের দুই পাশে নেতাকর্মীদের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস ঠেলে দুপুর ১টা ২৫ মিনিটে খালেদা জিয়াকে বহনকারী গাড়িটি ফিরোজায় পৌঁছায়। পরে গাড়ি থেকে নেমে বড় পুত্রবধূর হাত ধরে হুইলচেয়ার ছাড়াই হেঁটে বাসায় প্রবেশ করেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। ফিরোজায় খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানান বোন সেলিমা ইসলাম, ভাই শামীম ইস্কান্দার ও তার সহধর্মিণী কানিজ ফাতেমা, জোবাইদা রহমানের বড় বোন শাহীনা জামান বিন্দুসহ পরিবারের সদস্যরা। 

খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, লন্ডনে চিকিৎসার পর শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ আছেন খালেদা জিয়া। তবে ১৪ ঘণ্টার বিমানযাত্রার কারণে উনি শারীরিকভাবে ক্লান্ত। খালেদা জিয়ার এই সুস্থতা যাতে অব্যাহত থাকে, সেজন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চান তিনি। জাহিদ হোসেন বলেন, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই দেশে ফিরবেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। 

জোবাইদা রহমান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১৭ বছর পর তিনি এসেছেন। দেশে আসবেন, এটাই স্বাভাবিক। তার স্বামী-সন্তান এখনো বিদেশে। সময় বলে দেবে তিনি কতদিন থাকবেন। তবে আবার সেখানে ফিরে গিয়ে স্বামী ও মেয়েকে নিয়ে সবকিছু গুছিয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করবেন। এ সময় কাতার সরকারের প্রতি তিনি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ডা. জাহিদ বলেন, কাতার সরকার শুধু এয়ার অ্যাম্বুলেন্সই প্রদান করেনি, ওষুধ ও চিকিৎসা সেবার সবকিছু নিশ্চিত করেছে। এই মানবিক সহায়তা দেশনেত্রীর সুস্থতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এজন্য খালেদা জিয়া কাতার সরকারকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়েছেন। বিএনপির পক্ষ থেকে সেনাবাহিনী, র‌্যাব, পুলিশ এবং অন্য সরকারি সংস্থাগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি। সরেজমিন দেখা যায়, খালেদা জিয়ার দেশে ফেরার খবরে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে আগত বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা বিমানবন্দর থেকে গুলশানের বাসা ফিরোজা পর্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে বিভিন্ন সড়কের পাশে অবস্থান নেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিতির সংখ্যা বাড়তে থাকে। খালেদা জিয়া বিমানবন্দর পৌঁছালে ওই এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। নেতাকর্মীরা জাতীয় ও দলীয় পতাকা, ব্যানার, ফেস্টুন এবং ব্যান্ড পার্টি নিয়ে সড়কের দুই পাশে দাঁড়ান। তাদের স্লোগানে স্লোগানে মুখর হয় ওঠে পুরো এলাকা। দলের নির্দেশনা অনুযায়ী বিমানবন্দর থেকে লা মেরিডিয়ান হোটেলের পাশে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপি, লা মেরিডিয়ান হোটেল থেকে খিলক্ষেত পর্যন্ত ছাত্রদল, খিলক্ষেত থেকে হোটেল র‌্যাডিসন পর্যন্ত যুবদল, হোটেল র‌্যাডিসন থেকে আর্মি স্টেডিয়াম পর্যন্ত ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপি, আর্মি স্টেডিয়াম থেকে বনানী কবরস্থান পর্যন্ত স্বেচ্ছাসেবক দল, বনানী কবরস্থান থেকে কাকলী মোড় কৃষক দল, কাকলী মোড় থেকে বনানী শেরাটন হোটেল শ্রমিক দল, শেরাটন হোটেল থেকে বনানী কাঁচাবাজার, ওলামা দল, তাঁতীদল, জাসাস, মৎস্যজীবী দলের নেতাকর্মীদের ঢল নামে। গাজীপুর সদর থেকে আসা রফিকুল ইসলাম বলেন, স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে ফজরের নামাজ পড়েই রওয়ানা দিয়েছি। প্রায় চার মাস পর নেত্রীর দেখা। তিনি অসুস্থ ছিলেন, প্রতিদিন তার জন্য দোয়া করেছি। সৃষ্টিকর্তার মেহেরবানিতে তিনি সুস্থ হয়ে দেশে ফিরেছেন, এর চেয়ে বড় কিছু হতে পারে না। সাভার থেকে আসা মহিলা দলের নাজনীন আক্তার বলেন, রাস্তার ওপরে না দাঁড়ানোর নির্দেশনা রয়েছে। তাই সুশৃঙ্খলভাবে রাস্তার ফুটপাতে দাঁড়িয়েছি, যাতে কারও কোনো ভোগান্তি না হয়?। তিনি বলেন, আমাদের আনন্দের দিন। গণতন্ত্রের মা দেশে ফিরছেন, নেতাকর্মীদের আগমনে ভরে গেছে ঢাকা শহর। 

পথে পথে বিএনপি চেয়ারপারসন গাড়ি থেকে হাত তুলে নেতাকর্মীদের শুভেচ্ছা জানান। এ সময় বেশ কয়েকবার খালেদা জিয়াকে হাসিমুখে দেখা গেছে। তার মুখে হাসি দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েন উপস্থিত নেতাকর্মীরাও। ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের ফুটপাত থেকে সড়কে উপচে পড়ে নেতাকর্মীদের ভিড়। জনস্রোতের কারণে বনানী থেকে গুলশানগামী সড়ক বন্ধ করে দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এদিকে খালেদা জিয়ার আগমন উপলক্ষ্যে মঙ্গলবার সকাল থেকেই গুলশানে তার বাসভবন ফিরোজা ঘিরে দলের নেতাকর্মী ও উৎসুক জনতার ভিড় লক্ষ করা যায়। বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর চাপ সামলে ধীর লয়ে চলে খালেদা জিয়ার গাড়িবহর। এর ফলে প্রায় ১০ কিলোমিটার পথ যেতে দুই ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে। তার গাড়িবহর বনানী এলাকায় পৌঁছালে নেতাকর্মীর ভিড় থাকায় নির্ধারিত রুট পরিবর্তন করে গুলশানের বাসভবনে যান। 

এর আগে সকাল ৯টার পর থেকে ফিরোজার প্রবেশপথ গুলশান-২ নম্বরের ৭৯ নম্বর সড়কের সামনে ব্যারিকেড দিয়ে রাখা হয়। সড়কটির দুই পাশেই কড়া নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিলেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। পুলিশ ও র‌্যাবের সদস্যরাও ছিলেন সেখানে। গণমাধ্যমকর্মী ছাড়া সেখানে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। 

নিরাপত্তায় কোনো ঘাটতি রাখেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী : খালেদা জিয়ার দেশে ফেরা উপলক্ষ্যে নিরাপত্তায় কোনো ঘাটতি রাখেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিমানবন্দর থেকে গুলশানের বাসভবন পর্যন্ত নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিলেন সেনা, নৌ, বিমানবাহিনী, পুলিশ, র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অসংখ্য সদস্য। দলের পক্ষ থেকে যানজটের ভোগান্তি এড়াতে ছিল কড়া নির্দেশনা। তবে শেষ পর্যন্ত নেতাকর্মীদের বাঁধভাঙা ঢল নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়নি। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ। পুরো পথে খালেদা জিয়ার গাড়িবহর ঘিরে ছিল সেনাবাহিনী, পুলিশসহ তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাহিনী। এছাড়াও যানজট পরিস্থিতি সামাল দিতে ভোর থেকেই পুলিশের পাশাপাশি ছিল সেনা সদস্যদের তৎপরতা। 

সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও তার পুত্রবধূ ডা. জোবাইদা রহমানের নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিয়েছে ডিএমপি। ডিএমপি জানিয়েছে, পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এবং বিশেষ শাখার (এসবি) সদস্যদেরও মোতায়েন করা হয়েছে।

১৭ বছর পর মাকে স্পর্শ করলেন জোবাইদা রহমান : এদিকে ১৭ বছর পর দেশে ফিরেই মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মা সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানুকে দেখতে ছুটে যান ডা. জোবাইদা রহমান। সেখানে মাকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান তিনি। এ সময় আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তারা।

সেই বাবুর্চির হাতে খালেদা জিয়া ও তার দুই পুত্রবধূর জন্য বিশেষ রান্না : লন্ডনে চার মাস চিকিৎসা নেওয়ার পর দুই পুত্রবধূকে নিয়ে দেশে ফেরেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। তাদের দেশে ফেরা উপলক্ষ্যে খালেদা জিয়ার গুলশানের বাসভবনে আয়োজন করা হয় বিশেষ ভোজের। ফিরোজায় রান্নার বিশেষ দায়িত্ব পেয়েছেন শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বাবুর্চি। বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত বাবুর্চি বিশেষ ভোজের আয়োজন করেন। জিয়াউর রহমানের সময় থেকে যিনি রান্না করতেন, তিনিই রান্না করেছেন। পরিবারের সবাই দুপুরে একসঙ্গে বসে খেয়েছেন।

১৭ বছর পর মাহবুব ভবনে ডা. জোবাইদা : হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মা সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানুর সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে ধানমন্ডিতে বাবার বাড়িতে গেলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমান। ১৭ বছর পর মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার সময় ধানমন্ডির ৫ নম্বর সড়কে অবস্থিত ‘মাহবুব ভবন’-এ প্রবেশ করেন তিনি। এ সময় ডা. জোবাইদা রহমানের গাড়ির সঙ্গে আরও বেশ কয়েকটি গাড়ি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কড়া নিরাপত্তায় দেখা গেছে। 

মা সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানুর হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বাবার বাড়িতে ডা. জোবাইদা রহমানকে স্বাগত জানান। বিএনপি মিডিয়া সেলের সদস্য আতিকুর রহমান রুমন জানান, সন্ধ্যায় হাসপাতালে পৌঁছার পর তিনি মায়ের সঙ্গে সময় কাটান। পরে রাত সাড়ে ৯টার দিকে তিনি বাবার বাড়ি ধানমন্ডি ৫ নম্বর সড়কের মাহবুব ভবনে পৌঁছান। সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থান করে রাতেই গুলশানে ফিরোজায় ফিরে যান তিনি।


বিএনপি খালেদা জিয়া তারেক রহমান

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম