চট্টগ্রামে তারুণ্যের সমাবেশে মির্জা ফখরুল
দেশের মানুষ আ.লীগকে দেখতে চায় না
শেখ হাসিনার প্রেতাত্মারা ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে, সফল হবে না * অন্তর্বর্তী সরকার সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছে না * গণতন্ত্র যেন কারও কাছে জিম্মি হয়ে না পড়ে-আমির খসরু
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
তারুণ্যের সমাবেশকে কেন্দ্র করে শনিবার একটি অভাবনীয় দৃশ্যের সাক্ষী হলো বন্দরনগরী চট্টগ্রামের কেন্দ্রস্থল। লাখো তরুণের ঢল। পলোগ্রাউন্ডে তাদের উচ্ছ্বাস প্রমাণ করল-নতুন প্রজন্ম জেগে উঠেছে পরিবর্তনের প্রত্যয়ে। তারা জানিয়ে দিয়েছে-ভবিষ্যৎ নিয়ে আর নির্লিপ্ত নয়, ভোট তাদের অধিকার। সেই অধিকার নিশ্চিত করতেই রাজপথে তাদের জাগরণ। একইসঙ্গে তারা সুষ্ঠু ধারার রাজনীতি চর্চার মধ্য দিয়ে স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেন। প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আওয়ামী লীগের শাসন আমলে হওয়া নানা নির্যাতন ও নিপীড়নের বর্ণনা দিয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান। একইসঙ্গে দেশের গণতন্ত্রকামী ১৮ কোটি মানুষ আওয়ামী লীগকে দেখতে চায় না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তরুণ রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ার লক্ষে বিএনপির তিন অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন-ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের উদ্যোগে শনিবার বিকালে চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ডে ‘তারুণ্যের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার’ এই সমাবেশ হয়। বিকাল সোয়া ৪টায় শুরু হয় সমাবেশ। এ সময় স্লোগানে স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। ‘তরুণদের সিদ্ধান্তেই হবে ভবিষ্যৎ’-এমন নানা বার্তা নিয়ে দলে দলে অংশ নেন তরুণ-তরুণীরা। সমাবেশ চলাকালে বিকাল পৌনে ৬টায় মঞ্চে উপস্থিত হন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক তামিম ইকবাল। পরে বক্তব্যও দেন তিনি। সমাবেশে অংশ নেওয়া একাধিক তরুণ জানান, আমরা আর নীরব দর্শক নই। ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদেরও বলার আছে, সিদ্ধান্ত নেওয়ার আছে। তরুণদের কণ্ঠে ঝরল দৃঢ় প্রত্যয়-ভোট শুধু পছন্দই নয়, এটি তাদের অধিকার।
মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা যখন এই সমাবেশ করছি, তখন ঢাকায় ও চট্টগ্রামের নিউমার্কেটে আরেকটি সমাবেশ হচ্ছে। দাবি হচ্ছে, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে। আমরা যারা মাঠে আছি, বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষ আওয়ামী লীগ দেখতে চায় না। কারণ এই আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে দেশের মানুষকে নির্যাতন করে এসেছে। গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেছে। একদলীয় শাসন ব্যবস্থা-বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেছিল। তারা (আওয়ামী লীগ) শুধু চারটি পত্রিকা খোলা রেখে বাকি সব বন্ধ করে দিয়েছিল। সাংবাদিকদের স্বাধীনতা সেদিন ছিল না। অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। সেই অর্থনীতিকে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান খুলে দিয়েছিলেন।
সংস্কার প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব বলেন, দেশের প্রথম সংস্কার কার্যক্রম করেছিল জিয়াউর রহমান। তিনি একদলীয় শাসনব্যবস্থা থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্রব্যবস্থায় নিয়ে এসেছিলেন। যিনি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিয়েছিলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও অর্থনীতিকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন। আজকে যে অর্থনীতির ভিত্তি গার্মেন্টস ও দেশের বাইরে শ্রমিক পাঠানো এটা শুরু করেছিলেন জিয়াউর রহমান।
মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা একটা অস্বাভাবিক সময় অতিক্রম করছি। ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালিয়েছে। কিন্তু তার প্রেতাত্মারা এখনো আছে। তারা এখনো ষড়যন্ত্র করছে। বাংলাদেশে আবার তাদের রাজ্য, রাজত্ব কায়েম করার ষড়যন্ত্র করছে। কিন্তু তারা তা পারবে না।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, আমাদের দুর্ভাগ্য। আমরা যাদের এখন দায়িত্ব দিয়েছি, এই দেশকে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। তারা সেই দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারছেন না। ফলে মাঝে মাঝেই বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। সেই সমস্যাগুলো তাদের (আওয়ামী লীগ) শক্তিশালী হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে।
তরুণদের নিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্র চায়, তাদের ন্যায্য অধিকারকে উপভোগ করতে চায়। আমাদের তরুণ ছেলেরা চাকরি চায়, ব্যবসা ও কর্মসংস্থান চায়। মায়েরা তাদের ছেলেদেরকে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চায়। আমাদের তরুণরা বিশ্ববিদ্যালয়কে চমৎকার বিদ্যাপীঠে পরিণত করতে চায়। আর দেশে একটা সত্যিকার অর্থে শান্তি বলয় প্রতিষ্ঠা চায়। কৃষক তার ফসলের ন্যায্য মূল্য, শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য মজুরি চায়।
২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানে চট্টগ্রামের প্রথম শহিদ ছাত্রদল নেতা ওয়াসিম আকরাম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পাঠ্যপুস্তকে আবু সাঈদ, মুগ্ধের নাম আছে। ভালো লেগেছে। কিন্তু চট্টগ্রামের ওয়াসিম আকরামের নাম না থাকায় আমরা দুঃখিত হয়েছি। পাঠ্যপুস্তক সংশোধন করে তার নাম যুক্ত করতে তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, গণতন্ত্রের জন্য, বাংলাদেশের মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আমরা সবাই অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছি। সেই গণতন্ত্র যেন কারও কাছে জিম্মি হয়ে না পড়ে, সেজন্য আমাদেরকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
কয়েকটি রাজনৈতিক দলের উদ্দেশে তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষকে জিম্মি করে, কারও স্বার্থ আদায় করা সম্ভব হবে না। তাদের যদি কোনো কর্মসূচি থাকে, দর্শন থাকে তা নিয়ে জনগণের কাছে যেতে হবে। বাংলাদেশে নির্বাচনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে বলেও মন্তব্য করেন আমির খসরু। তিনি বলেন, এই নির্বাচন কেউ বানচাল করতে পারবে না। আপনাদের (তরণ সমাজ) সবাইকে চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। গণতন্ত্রের পথ কেউ যেন রুদ্ধ করতে না পারে।
এ সময় নেতাকর্মীদের কোনো ধরনের উসকানিতে পা না দিতে আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, তারেক রহমানের নির্দেশনা-আমাদেরকে সহনশীল হতে হবে। একে অপরকে শ্রদ্ধা করতে হবে।
আগামী নির্বাচনে ৩১ দফার ভিত্তিতে বিএনপি জনগণের ম্যান্ডেট চাইবে জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণ যদি আমাদের ম্যান্ডেট দেন ৩১ দফার মাধ্যমে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত করার জন্য তারেক রহমান যে ঘোষণা দিয়েছেন, তা বাস্তবায়ন করা হবে। যারা রাস্তায় আমাদের সঙ্গে প্রাণ দিয়েছে, জেলে গেছে তাদেরকে নিয়ে একটি জাতীয় সরকার হবে জানিয়ে তিনি বলেন, এই সরকার সেই ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করবে।
জাতীয়তাবাদী যুবদল সভাপতি আবদুল মোনায়েম মুন্না বলেন, তরুণ প্রজন্ম স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন বাস্তবায়নে দৃঢ়তা ও শক্তি রাখে। গত জুলাই-আগস্টে যে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে, সেখানে আপনারাই ছিলেন অগ্রসৈনিক। স্বৈরাচারের হামলা, মামলা, নির্যাতন, রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আপনারাই বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছেন। জাতীয়তাবাদী যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, ছাত্রদল সব সময় তরুণদের সামনের সারিতে ছিলেন। প্রতিটি সংগ্রামে আমরাই রাজপথে নেতৃত্ব দিয়েছি, রক্ত দিয়েছি, আত্মত্যাগ করেছি কিন্তু পিছপা হয়নি। তিনি বলেন, বিএনপি শুধু তরুণদের ভোট নয়, তাদের নেতৃত্বও চায়। রাষ্ট্র গঠনে তাদের অংশীদারত্ব চায়।
যুবদলের সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নয়ন বলেন, এক সময় গণতন্ত্রকে উন্নয়নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এখন দেখছি গণতন্ত্রকে সংস্কারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সংস্কারের নামে নির্বাচন বিলম্বিত করা দেশের তরুণ সমাজ মেনে নিবে না।
সমাবেশে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহিদ ওয়াসিমের বাবা শফিউল আলম বলেন, আমার ছেলে শহিদ হয়েছে। আমার ছেলের সঙ্গে সব হত্যার বিচার চাই। বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা আমাদের পাশে আছেন। আমাদের খোঁজখবর রাখেন তারা।
স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি এসএম জিলানীর সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহসান ও ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন নাছিরের সঞ্চালনায় আরও বক্তব্য দেন ছাত্রদল সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব, যুবদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি রেজাউল করিম পল, স্বেচ্ছাসেবক দলের সিনিয়র সহসভাপতি ইয়াসিন আলী, ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শ্যামল মালুম। এসময় উপস্থিত ছিলেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা ড. মাহদি আমিন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন, বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান শামীম, অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়া, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মীর হেলাল, হারুনুর রশিদ হারুন, চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মো. এরশাদুল্লাহ, সদস্যসচিব নাজিমুর রহমান নাজিম প্রমুখ।
তারুণ্যের সমাবেশে তামিম ইকবাল : সমাবেশে চট্টগ্রামের খেলোয়াড়দের জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া নিয়ে কথা বলেন তামিম ইকবাল। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম থেকে খেলোয়াড় পাচ্ছি না। আজ থেকে ১০-২০ বছর আগে, অনেকেই চট্টগ্রাম থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্পোর্টসে প্রতিনিধিত্ব করত। আশা করছি, আমরা আবারও ওই জায়গাটা ফেরত পাব।
বিকাল ৫টা ৪২ মিনিটে তামিম ইকবাল মঞ্চে উঠেন। এ সময় মঞ্চে তাকে স্বাগত জানান মির্জা ফখরুল। পরে নেতাদের প্রথম সারিতে তামিমকে বসানো হয়। সন্ধ্যা ৬টা ৩ মিনিটে বক্তব্য দেওয়ার জন্য মাইক্রোফোনে তামিমের ডাক পড়ে।
বিএনপির নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত কথা হওয়ার বিষয়টিও বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন তামিম। তিনি বলেন, চট্টগ্রামের খেলাধুলা নিয়ে আমার সঙ্গে বিএনপি নেতাদের নিয়মিত কথা হয়। আমরা কীভাবে চট্টগ্রামের খেলাধুলাকে আগের জায়গায় নিয়ে আসতে পারি, সে ব্যাপারে আলোচনা হয়।
তামিম আরও বলেন, আমি নিশ্চিত, তারা যখন সুযোগ পাবেন সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন চট্টগ্রামকে এগিয়ে নিতে। সেটি যে ধরনের খেলাধুলাই হোক না কেন। ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন- যে কোনো ইভেন্ট প্রোমোট করবেন।
পরে নিজের অসুস্থতার কথা উল্লেখ করে বক্তব্য শেষ করেন তামিম ইকবাল। তিনি বলেন, আজ আপনাদের ভালোবাসা পেয়ে খুশি। আপনারা জানেন আমি অসুস্থ। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছি। বেশি কথা বলা উচিত নয়।

