নাগরিক কোয়ালিশনের অনুষ্ঠানে আইন উপদেষ্টা
প্রধানমন্ত্রীর দুই মেয়াদ সমাধান নয়, ক্ষমতা কমানো জরুরি
নতুন সংবিধান প্রণয়নে ২-৩ বছর লাগতে পারে * নতুন সংবিধান প্রণয়ন ছাড়া নতুন বাংলাদেশ বলার প্রয়োজন নেই -নাহিদ ইসলাম
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১২ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে রোববার নাগরিক কোয়ালিশন অনুষ্ঠানে অতিথিরা -যুগান্তর
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে ২ থেকে ৩ বছর সময় লাগতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। এ সময়ে ১৯৭২ সালের সংবিধানে কিছু সংশোধনী আসবে বলেও জানান তিনি। ‘সংবিধান সংস্কারে নাগরিক জোটের সাত প্রস্তাব’ নিয়ে রোববার রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। আইন উপদেষ্টা বলেন, গণপরিষদ নতুন সংবিধান প্রণয়নের কাজ করবে। এটা করতে আমার ধারণা ২-৩ বছর লাগতে পারে। এই ২-৩ বছর কি ৭২-এর সংবিধান বহন করব। এই ২-৩ বছর যারা জাতীয় সংসদ হিসাবে কাজ করবেন, তখন তারা কিছু ফান্ডামেন্টাল অ্যামেন্ডমেন্ট আনবেন। যেমন: প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা, ৭০ অনুচ্ছেদ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা-এ সংক্রান্ত কিছু ফান্ডামেন্টাল জিনিস নিয়ে সমাজে বহু বছর ধরে ঐক্য আছে। নতুন সংবিধান প্রণয়ন কবে হবে-এজন্য আমি এই ৭২-এর বোঝা কেন বহন করব।
প্রধানমন্ত্রীর দুই মেয়াদে থাকা নিয়ে আসিফ নজরুল বলেন, এটা জনপ্রিয় দাবি। আমারও দাবি। প্রধানমন্ত্রী দুই মেয়াদে বললে তো হবে না, আপনাকে কনভিন্সিং তর্ক করতে হবে। পৃথিবীর আর কোন কোন দেশে এটা আছে বের করেন। প্রধানমন্ত্রীর দুই মেয়াদ কোথাও নেই আসলে। ভারত বলেন, যুক্তরাজ্য বলেন, কোথাও নেই। দুই মেয়াদ সমাধান না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাটা কমিয়ে নেওয়া।
আলোচনায় জুলাই সনদের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, জুলাই সনদে কি এতকিছু থাকবে যেটা সংবিধানের ভিত্তি হবে, তাহলে জুলাই সনদ আর হবে কি না, আমার সন্দেহ আছে। জুলাই সনদের ওপর অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এমন হতে পারে-জুলাই সনদে মোস্ট ফান্ডামেন্টাল কিছু জিনিস রাখা সম্ভব হতে পারে।
সংসদের উচ্চকক্ষ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এত ক্ষমতা যদি উচ্চকক্ষকে দেন, তাহলে উচ্চকক্ষে বিএনপি, জামায়াত ও নাহিদের দল তাদেরই নিয়োগ দেবে, যারা দলদাস হবে। উচ্চকক্ষ যদি এত ক্ষমতাশালী হয়, বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানে একটামাত্র ব্যক্তিকে স্বাধীনভাবে নিয়োগ করা যায়-চিফ জাস্টিস। রাষ্ট্রপতি স্বাধীনভাবে নিয়োগ করতে পারে এবং বাংলাদেশের সংবিধানে চিফ জাস্টিসের অসীম ক্ষমতা। আপনারা শুধু প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা দেখেন, বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সবচেয়ে দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি হচ্ছেন চিফ জাস্টিস।
আসিফ নজরুল বলেন, নতুন নতুন অনেক কমিশনের প্রস্তাব করা হয়েছে। আমরা সব সময় যে জিনিসটা বিশ্বাস করি, যখন যে কোনো সংস্কার ভাবনাতে যাই, তখন আমরা বলি সব সময় নতুন নতুন কমিশন করতে হবে। আসলে উচ্চ আদালত আর সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকে যদি ঠিকমতো গঠন করা যায়, ক্ষমতা দেওয়া হয়, তাহলে আমাদের এত নতুন নতুন কমিশন লাগে না।
অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জনগণ ও শহিদদের রক্তের প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষা, এদেশে আর কখনো যেন স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের উৎপাদন না হয়। এজন্য যে সংশোধনীগুলো আপনারা প্রস্তাব করলেন, আমার ভাই আফিস নজরুল আইনের অধ্যাপক, তিনি অনুধাবন করেছেন জুডিশিয়ারির যে ক্ষমতা এবং লেজিস্লেচারের যে অনেক ক্ষেত্রে ভারসাম্য তৈরি করার জন্য স্থায়ী কমিটিতে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স আনানো। এছাড়া অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় যেন ভারসাম্য সৃষ্টি হয়, সে বিষয়ে আপনাদের আরও বেশি ব্রেইনস্টর্মিং করতে হবে।
তিনি বলে, সব দোষ লেজিস্লেচারের, সব দোষ এক্সিকিউটিবের, সুতরাং এ দুইটিকে ধর-এই মানসিকতা আমাদের সংশোধন করতে হবে। মন্টেসকোর সেফারেশন অব পাওয়ার থিয়োরির এসেন্সটা কী? সেটা হলো-‘হারমোনিয়াস কো-অপাররেশন ইন বিটুইন অল অর্গান ইজ দিস স্টেস।’ সেই ভারসাম্যটা সৃষ্টির চেষ্টা করেন। সেই ভারসাম্য, কো-অপারেশন, সেই মধুর সহযোগিতা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সটা প্রতিষ্ঠিত হবে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি ড. আলী রীয়াজ বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভায় রাজনৈতিক দলগুলো অনেক নমনীয়তা দেখাচ্ছে। দলগুলো একটি জাতীয় ঐক্যে পৌঁছাতে চায়। একটি জাতীয় সনদ তৈরি করতে চায়। এটা নিয়ে সংশয় নেই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার এ যুক্তিটা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না; যেহেতু ওয়েস্ট মিনিস্টার স্টাইলে প্রাইম মিনিস্টারের টার্ম লিমিট করা যায় না। সেহেতু বাংলাদেশ এটা করতে পারবে না। বাংলাদেশ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করেছে। আমাকে কে বলতে পারবে, ১৯৯১ সালের আগে পৃথিবীর কোথায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল? রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই প্রশ্নগুলো উঠছে এবং এ প্রশ্নগুলোকে আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতা হিসাবে বিবেচনা করতে হবে।
বাংলাদেশে একটি রিপাবলিক তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনে শহিদ এবং আহতদের প্রতি দায় থেকে নতুন রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা করা। তবে শুধু বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ নির্মাণ করা যাবে না। সংবিধানের মধ্যে শেখ হাসিনা তৈরিতে কোনো বাধা ছিল না। সাংবিধানিকভাবেই স্বৈরতন্ত্র কায়েম করে গেছে। আলী রীয়াজ বলেন, উচ্চকক্ষের দায়িত্ব থাকবে মনিটরিং করা, এর বেশি ক্ষমতা দিলে নিম্নকক্ষের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থান তৈরি হতে পারে।
‘নতুন সংবিধান প্রণয়ন ছাড়া নতুন বাংলাদেশ বলার প্রয়োজন নেই’ মন্তব্য করে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম বলেন, বিগত সময়ের সংবিধান মানবাধিকার রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। নতুন সংবিধানের মাধ্যমে রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে আস্থা ও সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভব। আমাদের মৌলিক সংস্কারের দিকে এগোতে হবে। মৌলিক বিষয়ে একমত না হয়ে গুরুত্বহীন বিষয় নিয়ে একমত হওয়া ফলপ্রসূ হবে না।
তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপে শুধু সংবিধান নয়, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সংস্কারও করতে হবে এবং সংবিধানের মূলনীতি দলীয় মূলনীতির বাইরে বের করতে হবে। আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ প্রসঙ্গে নাহিদ বলেন, বিচার কার্যক্রমের একটি অংশ ইতোমধ্যে এগিয়েছে। এখন প্রয়োজন বিচারিক রোডম্যাপকে স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করা। এতে জনগণের মধ্যে আস্থা জন্মাবে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, যে কাঠামো, যে প্রতিষ্ঠান, যে বিধিবিধান স্বৈরাচার তৈরি করে, এগুলোর মধ্যে যদি আমরা পরিবর্তন না আনি, তাহলে আবারও স্বৈরাচারের ফিরে আসার সম্ভাবনা কি উড়িয়ে দিতে পারি? কোনোভাবেই পারি না। এ পরিবর্তনের জন্য আমাদের রাষ্ট্র মেরামত করতে হবে। এজন্যই কতগুলো মৌলিক সংস্কারের দরকার।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রথম পর্যায়ে আমরা যেটা দেখেছি, আমাদের প্রায় শতভাগ প্রস্তাব, সিংহভাগ দল সম্পূর্ণ একমত। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো সামান্য অবজারভেশন আছে। এটা তো আমাদের জন্য বিরাট সুসংবাদ। সব রাজনৈতিক দল জাতীয়ভাবে বলছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তারা একমত। এটা কিন্তু এর আগে এভাবে কেউ বলেনি। এটা আমার খুব উচ্ছ্বসিত হওয়ার কথা। কিন্তু আমি হতে পারছি না। কারণ, বাস্তবতা ভিন্ন।
অনুষ্ঠানে সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাইম জবিউল্লাহ, এবি পার্টির সভাপতি মুজিবুর রহমান মুঞ্জু, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা মাহদী আমিন, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জুনায়েদ সাকি, সাংবাদিক আশরাফ কায়সার, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কায়উম, এনডিএম-এর চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ, জামায়াতে ইসলামীর সূরা সদস্য ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও ঢাকা মহানগর উত্তরের আমির মো. সেলিম উদ্দিন, গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য দেন আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। অনুষ্ঠানের সাত দফার বিস্তারিত তুলে ধরেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ সাহান। পথরেখা তুলে ধরেন জিয়া হাসান। অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিভিন্ন সেক্টরের মানুষদের কাজ থেকে নাগরিক কোয়ালিশন কী চায়, এর বিস্তারিত তুলে ধরনে সংগঠনের সদস্য আয়রিন খান।
