Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

পাইলটের দক্ষতায় ৭১ যাত্রীর প্রাণরক্ষা

আকাশে খুলে পড়ল বিমানের চাকা

Icon

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১৭ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আকাশে খুলে পড়ল বিমানের চাকা

কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট উড্ডয়নের পর পেছনের একটি চাকা খুলে নিচে পড়ে যায়। তবে শেষ পর্যন্ত ঢাকায় হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিরাপদে জরুরি অবতরণ করেছে বিমানটি। শুক্রবার দুপুর ১টা ২০ মিনিটে কক্সবাজার থেকে ছেড়ে আসে বিজি ৪৩৬ ফ্লাইটটি। এটি ড্যাশ ৮-৪০০ মডেলের একটি উড়োজাহাজ। এতে শিশুসহ ৭১ জন যাত্রী ছিলেন। এই ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিমান ম্যানেজমেন্ট। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের চিফ অব সেফটি ক্যাপ্টেন এনাম তালুকদারকে প্রধান করে এই কমিটি গঠন করা হয়।

উড্ডয়নের কিছুক্ষণের মধ্যেই পাইলট ঢাকার এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলকে (এটিসি) জরুরি বার্তা পাঠিয়ে জানান, তিনি জরুরি অবতরণ করতে চান। বার্তা পাওয়ার পর হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জরুরি প্রস্তুতি নেওয়া হয়। রানওয়ের পাশে প্রস্তুত করে রাখা হয় ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্স, ডাক্তারসহ উড়োজাহাজ রিকভারি দল।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) এবিএম রওশন কবীর যুগান্তরকে বলেন, ‘কক্সবাজারের রানওয়ে থেকে উড্ডয়নের পরপরই পেছনের একটি চাকা খুলে নিচে পড়ে যায়। বিষয়টি জানার পর আমরা জরুরি অবতরণের ঘোষণা দেই। ইঞ্জিনিয়ারিং টিম রানওয়ের পাশে অবস্থান নেয়।’ তিনি আরও জানান, ‘দুপুর ২টা ২০ মিনিটে ফ্লাইটটি হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করে। যাত্রীরা সবাই অক্ষত ছিলেন। সবাইকে উড়োজাহাজ থেকে নামানো হয়েছে। তবে এয়ারক্রাফটের ভেতর যাত্রীদের কিছুই জানানো হয়নি। ফ্লাইটটি অবতরণের কিছু সময় আগেই যাত্রীদের জানানো হয়েছে যে, বিমানটি জরুরি অবতরণ করা হবে-সবাই যেন সিটবেল্ট বেঁধে রাখেন। বিমান অবতরণের পরও যেন কেউ সিটবেল্ট না খোলেন। এখন বিমানের যান্ত্রিক ত্রুটিগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’

রওশন কবীর আরও বলেন, দুর্ঘটনা কবলিত ওই ফ্লাইটের পাইলট-ইন-কমান্ড ছিলেন ক্যাপ্টেন জামিল বিল্লাহ। ক্যাপ্টেন জামিল বিমানের খুবই দক্ষ একজন পাইলট। এ পর্যন্ত ক্যাপ্টেন জামিল বিল্লাহর ৮০০০ ঘণ্টা ফ্লাইংয়ের অভিজ্ঞতা রয়েছে। ড্যাস-৮ এর পাইলট হওয়ার আগে ক্যাপ্টেন জামিল বোয়িং ৭৩৭ ও বোয়িং ৭৮৭-এর ফার্স্ট অফিসার ছিলেন। মূলত জামিল ও তার ক্রুদের দক্ষতা ও বিচক্ষণতায় ফ্লাইটটি নিরাপদে অবতরণ করে। পাইলট প্রথম চেষ্টাতেই নিরাপদে অবতরণে সক্ষম হয়েছেন।

বিমান বিশেষজ্ঞদের মতে-পেছনের এক চাকাতেও নিরাপদে অবতরণ করা সম্ভব। তবে আকাশে উড়ন্ত এয়ারক্রাফটের চাকা খুলে যাওয়া খুবই বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ খুলে যাওয়া চাকাটিও বিমানের একই বেগে আকাশে উড়তে থাকে। এ সময় দ্রুতবেগে যাওয়া চাকাটি যদি বিমানের গায়ে বা অন্য কোথাও আঘাত লাগে তাহলে বিমান ক্র্যাশ করার মতো ঘটনা ঘটতে পারত। তারা এ ঘটনার জন্য বিমানের প্রকৌশল শাখাকে দায়ী করেছেন। কারণ বিমানটি কক্সবাজার বিমানবন্দরে অবতরণ করার সঙ্গে সঙ্গে বিমানের প্রকৌশল শাখার ইঞ্জিনিয়াররা পুরো ফ্লাইটটি তন্ন তন্ন করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। ফ্লাইট উড্ডয়নের আগে প্রতিটি চাকার নাট-বল্টু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখে বিমানের লগ বইতে ‘এয়ারক্রাফট ফিট ফর ফ্লাই’ লিখতে হয়। প্রকৌশলীদের স্বাক্ষর করা লগ বই দেখার পর ওই ফ্লাইটের পাইলটও একইভাবে পুরো বিমানের সবকিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেন। এরপরই ল্যান্ডিং গিয়ারের লগ খোলার অনুমতি দেন পাইলট।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে খোদ বিমানের একজন সিনিয়র পাইলট যুগান্তরকে বলেন, বর্তমানে বিমানের বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীর খুবই অভাব রয়েছে। বিশেষজ্ঞ পাইলটদের অধিকাংশ বিভিন্ন এয়ারক্রাফটে চলে গেছেন। অনেকে অবসরে গেছেন। কিন্তু এই শূন্যতা পূরণের কোনো ব্যবস্থা করেনি বিমান ম্যানেজমেন্ট। তাছাড়া বেশির ভাগ নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতি আর ঘুস বাণিজ্যের কারণে দক্ষ প্রকৌশলীরা নিয়োগ পান না। ঘুস দিয়ে অদক্ষরা বিমানের বড় বড় ইঞ্জিনিয়ার হয়ে যাচ্ছেন। ওই পাইলট আরও বলেন, বর্তমানে বিমানের অধিকাংশ প্রকৌশলী মেকানিক থেকে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে আছেন। অনেকে প্রকৌশল শাখায় টুকটাক কাজ করতে করতে এখন ইঞ্জিনিয়ার হয়ে গেছেন। এদের কাছে হাজার কোটি টাকার একটি বিমান খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে আছে বলে তিনি দাবি করেন। তিনি এই ঘটনায় যথাযথ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান।

বিমানটি অবতরণের সময় এটিসি থেকে ভিডিও ধারণ করা হয়েছে। সেই ভিডিও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে শেয়ার করা হয়। সেখানে দেখা যায়, বিমানটি যখন রানওয়ে স্পর্শ করে তখন এক পাশে কিছুটা হেলে স্লিপ করছিল। দেখে মনে হচ্ছিল, পাইলট এক চাকার ওপর যেন বেশি প্রেসার না পড়ে সেজন্য বিমানটি কিছুটা কাত করে রানওয়ে স্পর্শ করিয়েছেন।

হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, দুপুর ১টা ৩৫ মিনিটে কক্সবাজার থেকে ছেড়ে আসার পরপরই চাকাটি খুলে বিমানবন্দরের রানওয়ের পাশে পড়ে যায়। পাইলটরা বিষয়টি সঙ্গে সঙ্গে কন্ট্রোল টাওয়ারকে জানান। তাৎক্ষণিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। পরে ফ্লাইটটি দুপুর ২টা ২২ মিনিটে ঢাকায় নিরাপদে অবতরণ করে। যাত্রী এবং ক্রু সবাই সুস্থ ও নিরাপদ রয়েছেন। তিনি বলেন, ফ্লাইটটি অবতরণের পর অল্প কিছু সময়ের জন্য বিমান চলাচল বন্ধ ছিল। দুর্ঘটনা কবলিত বিমানটি বে এলাকায় আসার পরপর বিমান চলাচল স্বাভাবিক হয়ে যায়।

বিমানটিতে ছিলেন এমন একজন যাত্রী যুগান্তরকে বলেন, এই দুর্ঘটনার জন্য বিমানের পাইলট-ইঞ্জিনিয়ারসহ সবাই দায়ী। কারণ প্রতিটি ফ্লাইটে এয়ারক্রাফট ইঞ্জিনিয়ার থাকেন। যেসব বিমানবন্দরে বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী নেই, সেখানে ফ্লাইট করার জন্য ঢাকা থেকে বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী নিয়ে যাওয়া হয়। এরা যে কোনো ফ্লাইট অবতরণ-উড্ডয়নের আগে বিমানটি চেক করে ফিট আছে কিনা তার রিপোর্ট দেন। কক্সবাজার থেকে বিমানটি উড্ডয়নের আগে তাহলে কি এই তল্লাশি করা হয়নি?

এর আগে ২০১৭ সালে সৈয়দপুর বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইট থেকে চাকা খুলে যায়। ওই বছরের ২৫ অক্টোবর সকালে ঢাকা থেকে আসা বিমানটি সৈয়দপুর বিমানবন্দরে অবতরণ করে। পরে সকাল ৯টায় সৈয়দপুর থেকে ফিরতি ফ্লাইট ঢাকার উদ্দেশে উড্ডয়নের পরই বিমানের পেছনের একটি চাকা রানওয়ের বাইরে খুলে পড়ে যায়। চাকা খুলে যাওয়ার ঘটনা তাৎক্ষণিকভাবে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেন ওই এলাকার বাসিন্দারা। খবর পেয়ে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ টাওয়ারের মাধ্যমে বিমানের পাইলটকে চাকা খুলে পড়ার বিষয়টি জানান। ওই ঘটনায়ও বিমানের পাইলটদের দক্ষতার কারণে ঢাকায় অবতরণ করে।

এছাড়া বিভিন্ন সময়ে একাধিকবার বিমানের চাকা খুলে যায়। দরজা ভেঙে যায়। ল্যান্ডিং গিয়ার ভেঙে যায়। সে সময় এ নিয়ে একাধিক তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু অভিযোগ আছে এসব তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নে বিমান ম্যানেজমেন্ট বাস্তবে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিমানের প্রকৌশল বিভাগের একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, এই বিভাগে বিমানের চাকা ক্রয়-বিক্রয় নিয়ে একটি দেশি-বিদেশি শক্তিশালী সিন্ডিকেট কাজ করছে। এই সিন্ডিকেট বিমানকে চাকা সরবরাহ করে থাকে। প্রতি মাসে যত বেশি চাকা বিক্রি করতে পারে ততই এই সিন্ডিকেটকে কমিশন দেওয়া হয়। এ কারণে বিমানের এই চাকা নিয়ে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ আছে। একটি চক্র আছে যারা বিমানের নতুন নতুন চাকা নষ্ট করে দেয়। কেটে দেয়। পাইলটরা জানান, কোনো এয়ারক্রাফট হ্যাঙ্গারে গেলে ওই এয়ারক্রাফটের চাকা বেশি দিন টেকে না। কারণ চাকা কেনাবেচার ওই সিন্ডিকেট সদস্যদের বেশিরভাগ হ্যাঙ্গারে কাজ করে থাকে। এছাড়া বিমানের পুরোনো চাকা বিক্রিরও একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট আছে বিমানে। এরা বিমান থেকে কম দামে পুরোনো চাকা কিনে নিয়ে বাইরে বেশি দামে বিক্রি করে দেয়। এ কারণে প্রায় বিমানে চাকা নিয়ে নানা দুর্ভোগে ভোগেন পাইলটরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন পাইলট যুগান্তরকে বলেন, বিষয়টি তারা একাধিকবার শীর্ষ ম্যানেজমেন্টকে জানালেও তারা কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। কারণ ম্যানেজমেন্টেরও অনেক শীর্ষ কর্তা এই অর্থের ভাগ পান। জানা গেছে, বছরে বিমানের এই চাকা বিক্রি করে সিন্ডিকেট মোটা অঙ্কের টাকা আয় করছে।

কক্সবাজার বিমানবন্দর

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম