মেয়র পদে ইশরাকের শপথ ও দায়িত্ব প্রদান
দাবি না মানা পর্যন্ত সড়কে অবস্থান
নগরভবন থেকে আন্দোলন যমুনার সামনে, রাতভর বিক্ষোভ * ৬ দিন ধরে বন্ধ নগর সেবা * মেয়র ঘোষণার গেজেট স্থগিতের রিটের আদেশ আজ * সড়কে তীব্র যানজট জনদুর্ভোগ
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২২ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দাবি না মানা পর্যন্ত সড়কে অবস্থান করবেন বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনের সমর্থকরা। তাকে মেয়রের শপথ পড়ানো এবং দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার দাবিতে টানা ৬ দিন ধরে আন্দোলন করছেন সমর্থকরা। নগরভবনে শুরু হওয়া আন্দোলন এখন স্থানান্তর হয়েছে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যুমনার সামনে। সমর্থকদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন ইশরাক হোসেনও।
বুধবার সন্ধ্যার পর থেকে হাজারো নেতাকর্মী ইশরাকের নেতৃত্বে ‘যমুনা’র সামনে অবস্থান নেন। এর ফলে হেয়ার রোড, মৎস্য ভবনের মোড়, কাকরাইল ও সার্কিট হাউজ সড়কসহ আশপাশের সব সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। পুরো এলাকা কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। রাত দেড়টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তারা সেখানেই অবস্থান করছিলেন।
গত সপ্তাহের বুধবার প্রথমে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান কার্যালয়ে তারা আন্দোলন শুরু করেন। সেই থেকে নগর সেবা কার্যক্রম কার্যত বন্ধ হয়ে পড়েছে। এ নগর সংস্থার প্রধান কার্যালয়, আঞ্চলিক কার্যালয় ও ওয়ার্ড কার্যালয় সবই তালাবদ্ধ। নগরবাসী সেবা পাচ্ছেন না। ভেঙে পড়েছে বর্জ্য অপসারণ, মশক নিয়ন্ত্রণ, সড়কবাতি প্রজ্বালন এবং সড়ক সংস্কারসহ অন্যান্য কার্যক্রম।
বুধবার থেকে ইশরাক সমর্থকদের আন্দোলন নগরভবন থেকে স্থানান্তর হয়ে প্রেস ক্লাব, মৎস্যভবন, কাকরাইল এবং প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। নগরীর ব্যস্ততম সড়কে ইশরাক সমর্থকদের অবস্থান করার কারণে সংযোগ সড়কগুলোয় তীব্র যানজট ও জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয়। অন্যান্য দিনের আন্দোলন সকালে শুরু হয়ে বিকালে শেষ হলেও বুধবার সকাল থেকে সমর্থকদের অবস্থান কর্মসূচি সন্ধ্যায় সমাপ্ত না করে তা বিরতিহীনভাবে চালানোর ঘোষণা দেন তারা। গতকাল সন্ধ্যায় সমর্থকদের আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনও রাজপথে অবস্থান শুরু করেছেন। তাদের ন্যায্য দাবি মেনে নেওয়ার আগ পর্যন্ত তারা মাঠ ছাড়বেন না বলে ঘোষণা করেছেন।
এদিকে ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র হিসাবে ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) গেজেটের কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে করা রিটের ওপর আদেশ ঘোষণা পিছিয়েছে। বৃহস্পতিবার (আজ) আদেশের জন্য দিন রেখেছেন হাইকোর্ট। সরেজমিন আন্দোলনস্থল ঘুরে দেখা গেছে, ইশরাক সমর্থকদের দেওয়া আলটিমেটাম বুধবার সকাল ১০টার মধ্যে বাস্তবায়ন না হওয়ার পর তারা আবারও সড়কে নেমে পড়েন। গতকাল প্রথমে তারা নগরভবনের সামনে জড়ো হন; এরপর সেখান থেকে কাকরাইল ও মৎস্যভবন এলাকা অবরোধ করেন। সকাল ১০টা থেকে হাজারও সমর্থক মিছিল নিয়ে কাকরাইল ও মৎস্যভবনের সামনের সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। সন্ধ্যা ৬টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বৃষ্টি উপেক্ষা করে তাদের অবরোধ চালিয়ে যেতে দেখা যায়। এতে দিনভর ওই সড়কটিতে যান চলাচল বন্ধ থাকায় শাহবাগ, মগবাজার ও পল্টনসহ আশপাশের এলাকায় যানজট ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ভোগান্তিতে পড়েন বিভিন্ন গন্তব্যে বের হওয়া হাজারো মানুষ।
আরও দেখা গেছে, গতকাল সকাল থেকে কাকরাইল ও মৎস্যভবন এলাকায় ইশরাক সমর্থকরা ‘অবিলম্বে ইশরাক হোসেনকে মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দাও, দিতে হবে’, ‘দফা এক দাবি এক, আসিফের পদত্যাগ’, ‘নো মোর আসিফ’ আসিফ ভূঁইয়ার কালোহাত, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও, ‘শপথ নিয়ে টালবাহানা চলবে না চলবে না’, ‘ক্ষমতা না জনতা, ক্ষমতা, ক্ষমতা’সহ নানা প্রতিবাদী স্লোগান দেন ইশরাকের হাজারো সমর্থক।
কাকরাইল এলাকায় আন্দোলনে অংশ নেওয়া বিএনপিকর্মী কবির মিয়া বলেন, ইশরাককে মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত তারা ওই জায়গা ছাড়বেন না। ইশরাক হোসেনকে মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতেই হবে। না হয় তারা আরও কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলবেন। যারা তাকে মেয়রের চেয়ারে বসতে বাধা দিচ্ছেন তাদের তারা বিচার চান। আরেক বিক্ষোভকারী হাবিবুর রহমান বলেন, ইশরাক হোসেনকে মেয়রের শপথ না পড়িয়ে তারা ঘরে ফিরবেন না। তাদের দাবি না মানা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। অন্যায়ভাবে তাদের নেতা ইশরাককে মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। অন্তর্র্বর্তী সরকারকে তারা হুঁশিয়ার করে দিতে চান। তাদের দাবি না মানলে আন্দোলন করে ঢাকা অচল করে দেওয়া হবে।
আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া সাবেক সচিব মশিউর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ২০২০ সালের সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ইশরাক হোসেন বিপুল ভোট পেয়েছিলেন। কিন্তু তৎকালীন নির্বাচন কমিশন ইশরাক হোসেনের পরিবর্তে শেখ ফজলে নূর তাপসকে বিজয়ী ঘোষণা করেন। এখন সেই নির্বাচন বাতিল করে ইশরাক হোসেনকে বিজয়ী করে গেজেট প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ইশরাক হোসেনকে শপথ পড়াচ্ছে না। এ কারণেই তারা সড়কে অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।
অবরোধের ফলে পল্টন মোড়ে আটকে যান বেসরকারি চাকরিজীবী আব্দুস সাত্তার। তিনি বলেন, বাসে শাহবাগ যাচ্ছিলেন ডাক্তার দেখাতে। কাকরাইলে তাদের অবরোধের কারণে গাড়ির জট লেগে গেছে তাই হেঁটে যাচ্ছেন। আন্দোলন করুক সমর্থন আছে। কিন্তু এভাবে রাস্তা বন্ধ করে হাজার হাজার মানুষকে কষ্ট দিয়ে আন্দোলন করবে কেন? গাড়িতে শিশু, বৃদ্ধ ও রোগীরা থাকেন। তাদের কথা চিন্তা করে রাস্তা অবরোধ কর্মসূচি সবার পরিহার করা উচিত।
বিকালে মতিঝিলের অফিস থেকে মগবাজারের বাসায় ফিরছিলেন আবুল কালাম আজাদ। তিনি বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন, অফিস থেকে বের হয়ে দেখি অবরোধের কারণে পুরো রাস্তা বন্ধ। মতিঝিল থেকে মিন্টো রোডে আসতেই ১ ঘণ্টা চলে গেল। এরকম হুটহাট রাস্তা বন্ধ করার কারণে তাদের মতো অনেকেরই বিপদে পড়তে হয়। রাস্তা অবরোধ কর্মসূচি আগে থেকে জানা থাকলে অনেকেরই উপকার হয়।
বুধবার দুপুরে বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন এক ফেসবুক পোস্টে ডিএসসিসি মেয়র পদে শপথ ইস্যুতে রাজপথ না ছাড়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি জানান, নির্দেশ একটাই যতক্ষণ দরকার রাজপথে থাকবেন। রাজপথে থেকে উঠে আসা যাবে না। গতকাল সন্ধ্যায় পুনরায় ফেসবুকে আরেক পোস্টে জানান, সমর্থকদের সঙ্গে তিনি রাজপথে থাকবেন। তিনি লেখেন-আন্দোলনকারী জনতার প্রতি সর্বাত্মক সংহতি জানাতে এবং তাদের সঙ্গে যতদিন প্রয়োজন রাজপথে সহাবস্থান করার জন্যে অল্প সময়ের মধ্যেই হাজির হবেন ইনশাআল্লাহ। সন্ধ্যায় ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন কাকরাইলের অবস্থান কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে বলেন, এটা শুধু মেয়রের চেয়ার বা একজন ব্যক্তির জন্য আন্দোলন নয়। এই আন্দোলনের মাধ্যমে পরিষ্কার হবে জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত হবে কিনা। ডিসেম্বরের মধ্যে মানুষ ভোটাধিকার পাবে কিনা। গত সপ্তাহের বুধবার থেকে আন্দোলন চলছে। এ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা রোদে পুড়ে, ঝড়-বৃষ্টিতে ভিজেও সক্রিয় রয়েছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান এ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন। ন্যায্য অধিকার ও ভোটাধিকার নিশ্চিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তারা সেখানে অবস্থান কর্মসূচি পালন করবেন বলে জানান।
এছাড়া গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবে পেশাজীবী জোটের উদ্যোগে আয়োজিত সভায় বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ডিএসসিসি মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম। তিনি বলেন, গত ৭ দিন ধরে ঢাকা মহানগর বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজন ইশরাক হোসেনকে মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন করছেন। সরকারকে আমি বলতে চাই, কেন দেশটাকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। দু-একজন উপদেষ্টার কারণে কি এই সরকার ব্যর্থ হবে? কোর্ট রায় দিয়েছেন, নির্বাচন কমিশন গেজেট প্রকাশ করেছে। এখন যদি ইশরাক মেয়রের চেয়ারে বসেন, তাহলে কার স্বার্থে আঘাত লাগবে?
রিটের আদেশ আজ : বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ডিএসসিসির মেয়র হিসাবে ঘোষণা করে ইসির গেজেটের কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে করা রিটের ওপর আদেশ ঘোষণা পিছিয়েছে। বৃহস্পতিবার আদেশের জন্য দিন রেখেছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি মো. আকরাম হোসেন চৌধুরী ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বুধবার শুনানি নিয়ে আদেশের নতুন এই দিন ধার্য করেন।
রিটের ওপর শুনানি নিয়ে মঙ্গলবার আদালত গতকাল আদেশের জন্য দিন ধার্য করেছিলেন। রিটটি আদেশের জন্য আদালতের বুধবারের কার্যতালিকায় ১১ নম্বর ক্রমিকে ওঠে। বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টায় সময় নির্ধারিত ছিল। ক্রম অনুসারে সাড়ে ১২টার দিকে বিষয়টি উঠলে ইশরাকের আইনজীবী, রিট আবেদনকারীর আইনজীবী ও রাষ্ট্রপক্ষ শুনানিতে অংশ নেন। রিট আবেদনকারীর পক্ষে সম্পূরক আবেদন দাখিল করেন। দুপুর সোয়া ১টা পর্যন্ত শুনানি চলে। এরপর আদালত আদেশের জন্য বৃহস্পতিবার সকালে সময় নির্ধারণ করেন।
২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হয়। আওয়ামী লীগের (বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ) প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস মেয়র নির্বাচিত হন। একই বছরের ২ ফেব্রুয়ারি ভোটের ফলের গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন। শপথ নিয়ে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন ব্যারিস্টার তাপস।
নির্বাচনে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ফলাফল বাতিল চেয়ে ২০২০ সালের ৩ মার্চ মামলা করেন ইশরাক। তিনি বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক কমিটির সদস্য। গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। একই বছরের ১৯ আগস্ট ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়রদের অপসারণ করা হয়। এর মধ্যে ইশরাকের করা নির্বাচনি মামলায় চলতি বছরের ২৭ মার্চ রায় দেন ঢাকার প্রথম যুগ্ম-জেলা জজ ও নির্বাচনি ট্রাইব্যুনাল। রায়ে তাপসকে নির্বাচিত ঘোষণা বাতিল করে ইশরাককে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র ঘোষণা করা হয়। আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ইশরাককে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ঘোষণা করে ২৭ এপ্রিল গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। মেয়র হিসাবে ইশরাকের শপথের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে নির্বাচন কমিশন থেকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়। চিঠির পরও কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় ইশরাকের সমর্থকরা নগরভবনের সামনে ১৪ মে থেকে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। এর আগে নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালের রায় ও ইসির গেজেট প্রকাশ নিয়ে মো. মামুনুর রশিদ নামে সুপ্রিমকোর্টের এক আইনজীবী ১৩ মে রিট করেন। সেই রিটের ওপর মঙ্গলবার ও বুধবার শুনানি হয়।
