Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

পরিস্থিতি ঘোলাটে দেখছে বিএনপি

মিত্রদের নিয়ে ‘কনভেনশন’ ডাকার পরিকল্পনা

তারিকুল ইসলাম

তারিকুল ইসলাম

প্রকাশ: ২৪ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পরিস্থিতি ঘোলাটে দেখছে বিএনপি

নানা ইস্যুতে দেশে তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা। ধীরে ধীরে সংকট প্রকট হচ্ছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে খুব দ্রুততার সঙ্গে একের পর এক ঘটনা ঘটছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্য উপদেষ্টাদের সঙ্গে এক অনির্ধারিত বৈঠকে তার পদত্যাগের ভাবনার কথা বলেছেন। এমন প্রেক্ষাপটে দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ঘোলাটে বলে মনে করছে বিএনপি। জাতীয় নির্বাচন, রাখাইনে মানবিক করিডর, চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যবস্থাপনা বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া, ছয় উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিসহ আরও কয়েকটি ইস্যুতে জুলাই অভ্যুত্থানের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভাজনের কারণে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করে দলটি। সিনিয়র নেতারা মনে করেন, এ ঘোলাটে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হচ্ছে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করা। সেই রোডম্যাপ যত দ্রুত ঘোষণা করা হবে, তত দ্রুত ঘোলাটে পরিস্থিতি পরিষ্কার হবে বলে মনে করেন নেতারা।

এদিকে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে দুই দিন ধরে মিত্র রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলছে বিএনপি। এর মধ্যে কোনো কোনো দলের সঙ্গে সরাসরি বৈঠকও করেছে দলটি। একটি সূত্র জানিয়েছে, দু-একদিনের মধ্যে মিত্রদের সঙ্গে একটি বৈঠক হতে পারে বিএনপির। মিত্র দলগুলো নিয়ে একটি কনভেনশন ডাকার জন্য ইতোমধ্যে বিএনপিকে পরামর্শ দিয়েছে বেশ কয়েকটি দল, যা যুগান্তরকে নিশ্চিত করেছেন ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সেসব দল রাজপথে ছিল এবং প্রাসঙ্গিক আরও কয়েকটি দল নিয়ে এই কনভেনশন করার কথা বলা হয়েছে। যেখানে সম্মিলিতভাবে দলগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ চাইবে। সূত্র আরও জানিয়েছে, চলমান পরিস্থিতিতে করণীয় নিয়ে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে জামায়াতেরও আলাপ হয়েছে।

সূত্রমতে, বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বুধবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার কথা ছিল বিএনপির। অজ্ঞাত কারণে সেই সাক্ষাৎ হয়নি। এরপরও কয়েকদফা সাক্ষাতের চেষ্টা করা হলেও প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎ পায়নি। জানা যায়, সাক্ষাতে বিএনপির তরফ থেকে একটি লিখিত দেওয়ার কথা ছিল। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ওই সাক্ষাৎ না হওয়ায় বৃহস্পতিবার গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে দলের অবস্থান তুলে ধরে দলটি। সেখানেও একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে একটি জাতীয় সংসদ গঠনের জন্য অবিলম্বে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানায়। সূত্র আরও জানায়, জামায়াতে ইসলামীর তরফেও বারবার সর্বদলীয় বৈঠক আহ্বানের জন্য প্রধান উপদেষ্টকে তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কোনো অনুরোধেই তিনি সাড়া দেননি।

জানতে চাইলে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা এই সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে চাই না। জাতীয় নির্বাচনের কথা বললে তারা সময় লাগবে বলছেন। কত সময় লাগবে? ডিসেম্বর না জুন-পরিষ্কার করতে হবে।’

বৃহস্পতিবার স্থায়ী কমিটির এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির অবস্থান জানানো হয়। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিতে হবে। এ লক্ষ্যে অবিলম্বে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে। অন্যথায় বিএনপির পক্ষে অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রতি সহযোগিতা অব্যাহত রাখা কঠিন হবে। একই দিন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক সংকট দূর করার একমাত্র পথ অতি দ্রুত নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করা। এখানে অন্য কথা বলে লাভ নেই। কারণ, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া।

বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা বলেন, নতুন করে সংবিধান লেখা, গণভোট, জুলাই সনদ এবং রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বিভক্তি প্রকাশ্যে আসে। সবচেয়ে বড় বিভক্তি দেখা দেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। নির্বাচনের পক্ষে-বিপক্ষের এ ইস্যুতেই দলগুলোর বিভেদই সংকটের মূল কারণ। দলটির নেতারা বলেন, অন্তর্র্বর্তী সরকার গঠনের পর নির্বাচন কমিশন সার্চ কমিটি গঠনের মাধমে গঠিত হয়েছে। সেই কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তা পুনর্গঠনের দাবিতে আন্দোলন করছে এনসিপি। শুধু তাই নয়, জুলাই সনদও চায় তারা। জামায়াত এই জুলাই সনদ তৈরিতে গণভোট দাবি করেছে। বিএনপির প্রশ্ন-দেশে তো ১৯৭১ সালের একটি সনদ বা ঘোষণাপত্র আছে। তাহলে একটি সরকার পতনের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কেন সনদ করতে হবে? দেশে এর আগে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর বিপ্লব ও সংহতি দিবস, নব্বইয়ের ছাত্র গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে। তখন তো সনদ নিয়ে কথা হয়নি। তাদের মতে, এসব সনদের মূল উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধকে মুছে দেওয়া, যার মাধ্যমে ৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িতদের ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়া। এমন কোনো কিছুর সঙ্গে বিএনপি থাকবে না বলে জানান দলটির নেতারা।

নেতারা আরও বলেন, রাষ্ট্র সংস্কার, জাতীয় নির্বাচন, মব জাস্টিসসহ দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেছেন সেনাপ্রধান। বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা বলেছেন, সেনাপ্রধান যা বলেছেন, তা জনগণের মনের কথা। তার এ বক্তব্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটি বার্তা পাওয়া গেছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা বিএনপি একটি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তৈরির জন্য এতদিন অপেক্ষা করছিল। বিভিন্ন পক্ষ থেকে সমর্থন পাওয়ার পর বিএনপি ইশরাক হোসেনের মেয়র পদে শপথ গ্রহণ ইস্যুতে আন্দোলন সেই গতি বাড়িয়েছে। বুধবার সেনাবাহিনী প্রধানের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে রাজনীতির মাঠে নাটকীয় পরিবর্তন শুরু হয়েছে। ফলে দ্রুত নির্বাচনের দাবি আদায়ে বিএনপি এখন সরকারের ওপর চাপ তৈরি করছে। বিশেষ করে ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনের মেয়র পদে শপথগ্রহণ ইস্যুতে বড় ধরনের শক্তি দেখিয়েছে দলটি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, যে কোনো পরিস্থিতিতে বিএনপি যে দাবি আদায়ে সক্ষম, গত কয়েকদিনের ধারাবাহিক আন্দোলনে সেই অবস্থান জানান দেওয়া হয়েছে। দাবি আদায়ের আন্দোলনের প্রাথমিক বিজয় হিসাবে হাইকোর্ট একটি রিট খারিজ করে বলেছেন, ইশরাকের শপথে কোনো বাধা নেই। এর ফলে সরকার একটি ধাক্কা খেল। পাশাপাশি এনসিপির ওপরও রাজনৈতিক চাপ তৈরি করা হলো, যাতে নির্বাচন পেছাতে ভবিষ্যতে তারা আর কোনো ইস্যু সামনে না আনে।

বিএনপির অবস্থান আরও কয়েকটি দল ও মহলের জন্যও সতর্কবার্তা বলে মনে করছেন রাজনীতিসচেতন ব্যক্তিরা। এ বিষয়ে যুক্তি তুলে ধরে তারা বলছেন, আগে থেকেই বিএনপি নেতাদের সন্দেহ ছিল, সরকারের ভেতরে-বাইরে একাধিক গোষ্ঠী জাতীয় নির্বাচন পেছাতে তৎপর। এনসিপির সঙ্গে ওই দল ও মহলগুলোর যোগাযোগ রয়েছে। তাই ইশরাক ইস্যুতে বিএনপি একই সঙ্গে সরকার ও এনসিপির ওপর চাপ তৈরির কৌশল নেয়।

ইসলামী আন্দোলনসহ ফ্যাসিবাদবিরোধী ৫ দলের জরুরি বৈঠক : দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীমের আহ্বানে ঢাকার পুরানা পল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বৃহস্পতিবার রাতে ফ্যাসিবাদবিরোধী ৫টি দলের শীর্ষ নেতাদের জরুরি বৈঠক হয়। এতে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, এবি পার্টির মহাসচিব ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা জালাল উদ্দিন আহমদ, এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদিবসহ আরও নেতারা উপস্থিত ছিলেন। জানা যায়, বৈঠকে দেশের চলমান রাজনৈতিক ও সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। যে কোনো মূল্যে ফ্যাসিবাদবিরোধী সব রাজনৈতিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ থাকার পাশাপাশি কোনো কুচক্রী মহল যাতে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করতে না পারে, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকার আহ্বান জানানো হয়। এছাড়া আগামী দিনে দেশগঠন এবং দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় আরও ঘনিষ্ঠভাবে ঐক্যবদ্ধ কৌশল গ্রহণের বিষয়ে বৈঠকে বিশদ আলোচনা হয়। অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে সার্বিক সহযোগিতা প্রদানে নেতারা একমত পোষণ করেন। বৈঠকে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান মোবাইল ফোনে এ বিষয়ে একমত পোষণ করেন বলেও জানা গেছে।

বিএনপি প্রধান উপদেষ্টা

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম