ড. ইউনূসের প্রতি দলগুলোর আস্থা পুনর্ব্যক্ত
দায়িত্বে থেকেই নির্বাচন ও সংস্কারের রোডম্যাপ দিন
পদত্যাগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসায় ধন্যবাদ, পদত্যাগ করলে সংকট আরও ঘনীভূত হবে এবং দেশ অনিশ্চিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৬ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি নিজেদের আস্থার কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা। পদত্যাগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসায় তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে তারা বলেন, আপনি দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ালে বা পুরো উপদেষ্টা পরিষদ পদত্যাগ করলে সংকট আরও ঘনীভূত হবে। দেশ এক অনিশ্চিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে। এর পরিবর্তে ড. ইউনূসকে তার দায়িত্বে থেকেই যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন, সংস্কার ও বিচারের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। রোববার সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তার সরকারি বাসভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা এসব কথা বলেন।
দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দ্বিতীয় দিনে দুই ধাপে ১৯টি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতার সঙ্গে বৈঠক করেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান। আলোচনায় গৃহায়ন উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খানসহ একাধিক উপদেষ্টা ছিলেন। প্রথমে সন্ধ্যা পৌনে ছয়টা থেকে ১০ দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। তাদের সঙ্গে এক ঘণ্টার বেশি সময় আলোচনা হয়। পরে ইসলামি ও সমমনা আরও নয়টি দলের সঙ্গে তিনি বৈঠক করেন। এ সময় প্রধান উপদেষ্টার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে প্রয়োজনে বিদ্যমান উপদেষ্টা পরিষদ রদবদলেরও পরামর্শ দেন কেউ কেউ। বৈঠক থেকে বেরিয়ে রাজনৈতিক নেতারা জানান, বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে এবং জাতীয় স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান। তিনি বলেছেন, তার মূল লক্ষ্য একটা সুষ্ঠু ও ঐতিহাসিক নির্বাচন দেওয়া।
এর আগে শনিবার বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। দুই দিনে ২২টি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বসলেন তিনি। দ্বিতীয় দিনের প্রথম দফার বৈঠকে অংশ নেন এলডিপির প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) অলি আহমদ, সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ূম, এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু, জাতীয় গণফ্রন্টের সমন্বয়ক টিপু বিশ্বাস, ভাসানী জনশক্তি পার্টির চেয়ারম্যান শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু এবং জেএসডি’র সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন।
দ্বিতীয় দফার বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম, ইসলামি বক্তা সাদিকুর রহমান, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মামুনুল হক, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির মহাসচিব মুসা বিন ইযহার এবং ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব সাখাওয়াত হোসাইন রাজী।
বৈঠক শেষে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, সংস্কার অর্থবহ করতে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। আর জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিতের একমাত্র পথ অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। তাই নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য যতটুকু সংস্কার প্রয়োজন সেটুকু করে নির্বাচন দিতে প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছেন। তিনি বলেন, রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে জনগণের মধ্যে বিরূপ মনোভাব রয়েছে। তাই এরশাদের পতনের পর যেভাবে রাজনৈতিক দলগুলো আচরণবিধি তৈরি করেছিল, সেভাবে বর্তমানেও রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে একটি আচরণবিধি করতে হবে।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম জানান, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি এবং রাজনীতির গতিধারা নিয়ে খোলামেলা আলাপ করেছেন তারা। তিনি বলেন, তারা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছেন, পরিস্থিতির দিকে নজর রাখতে হবে। দেশের ভেতরে-বাইরে হওয়া নানা ষড়যন্ত্র থেকে দেশকে রক্ষা করতে না পারলে রক্তের সঙ্গে বেইমানি করা হবে।
মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, প্রফেসর ইউনূস আলোচনাটা শুরু করেছেন এই কথা বলে যে, অনেক বড় সংকটের মধ্যে আমরা আছি। এই সংকট বলতে ওনি প্রধানত ভারতীয় আধিপত্যবাদের ষড়যন্ত্রের কথা বলেছেন। ভারতীয় আধিপত্যবাদ আমাদের এই পরিবর্তন একেবারেই স্বীকার করতে চায় না। পারলে আমাদের একদিনে ধ্বংস করে দিতে চায়। এজন্য যা যা করার দরকার সব তারা করছে। এই ছিল তার কথা। এজন্য তিনি বেশ চিন্তিত। তিনি চাইছেন জাতির ঐকমত্য হওয়া দরকার। সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐকমত্য হওয়া দরকার। কিন্তু দিন দিন এই ঐক্য দুর্বল হচ্ছে, এজন্য তিনি চিন্তিত এবং বেশ খানিকটা হতাশ। তিনি আরও বলেন, আমরা বলেছি-এই প্রশ্নে আমরা সবাই এক থাকব। আমাদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকবে কিন্তু মূল জাতীয় ইস্যুগুলোতে আমরা ঐকমত্য থাকব। ওনি মোটামুটিভাবে আশ্বস্ত হয়েছেন।
সাইফুল হক বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়েছি। তিনি বলেন, গত কয়েকদিনের ঘটনায় প্রধান উপদেষ্টা বিব্রত হয়েছিলেন। তাই পদত্যাগের কথা ভাবছিলেন। আমরা বলেছি, এতে রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হবে। তিনি আরও বলেন, মাঝনদীতে মাঝি বদলাতে হয় না। আপনার সরকারের ওপর আমরা আস্থা রাখতে চাই। এক সরকারের মধ্যে অনেক সরকার দেখতে চাই না। আপনাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখা যাচ্ছে। একেক উপদেষ্টার একেক রকম মন্তব্য। সবকিছু ঠিক করা জরুরি।
মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, এবি পার্টির পক্ষ থেকে কয়েকটা দাবি লিখিতভাবে দিয়েছি। সংস্কার, বিচার ও নির্বাচনের যথাসম্ভব দ্রুত রোডম্যাপ দিতে বলেছি। তিনি আরও বলেন, আমরা অনেকেই মতপ্রকাশ করেছি, এটাই বেটার হয়, এই নির্বাচনটা ৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে করা। তিনি আরও বলেন, আমরা বলেছি, আপনি দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ালে কিংবা পুরো উপদেষ্টা পরিষদ পদত্যাগ করলেও কোনো লাভ হবে না বরং দেশ এক অনিশ্চিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে। আমরা মনে করি বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে সঠিক উপলব্ধি, ছাড় দেওয়ার মনোভাব প্রদর্শন, ইগো পরিত্যাগ ও সমঝোতামূলক পদক্ষেপই উত্তম সমাধান।
জোনায়েদ সাকি বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে বলেছি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে ঐতিহাসিক দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, যেখানে একদিকে হত্যাকারীদের বিচার এবং জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত করার জন্য যে গণতান্ত্রিক সংস্কারে যাওয়ার প্রয়োজন, এতে যে দায়িত্ব নেওয়ার দরকার সেটা আপনার সরকারকেই নিয়ে যেতে হবে। অন্যথায় আর কোনো সুযোগ নেই।
ছাত্র প্রতিনিধি দুই উপদেষ্টাকে অপসারণ করা বা তাদের বুঝিয়ে পদত্যাগের দিকে যাওয়ার জন্য সরকারকে বলেছেন বলে জানিয়েছেন গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর। তিনি বলেন, আন্দোলনকারী ছাত্র নেতৃত্বের মধ্যে যারা উপদেষ্টা রয়েছেন, তারা যেহেতু একটি দল করেছেন, বাইরে এ কথাটি প্রচলিত আছে যে, এই দলটি সরকারের সুবিধা পাচ্ছে। সরকার পৃষ্ঠপোষকতা করছে। দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এনসিপির দুজনকে অপসারণ করা বা তাদের বুঝিয়ে পদত্যাগের দিকে যাওয়া সরকারের দিক থেকে একটি ভালো দিক হবে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি রেজাউল করীম (চরমোনাই পির) বলেন, আমরা দেশ ও জনগণের প্রয়োজনে আপনাকে নিয়ে এসেছিলাম একটা সুন্দর দেশ গড়ার জন্য। আপনার ওপর যে বিভিন্ন রকমের মানসিক নির্যাতন চলছে তা আমরা অনুভব করছি। আপনাকে যে সহজভাবে কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না তাও বুঝতে পারছি। আমরা উনাকে বলেছি, আপনি যদি পরাজিত হন তাহলে আমরাও পরাজিত হব। তবে মাঝপথে আপনি আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন এটা কোনোভাবেই হতে পারে না, এটা আপনি মাথায় আনবেন না।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক বলেন, প্রধান উপদেষ্টা আশ্বস্ত করেছেন, আমরা সবাই যদি উনাকে সহযোগিতা করি তাহলে উনি দেশ ও জাতিকে একটা গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে উনার দায়িত্ব শেষ করবেন। পাশাপাশি দেশ ও আন্তর্জাতিক মহলের সবার কাছে তিনি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে চান। উনি আমাদের কাছে কঠিনভাবে ব্যক্ত করেছেন ২০২৬ সালের জুনের ৩০ তারিখের পর এক ঘণ্টাও উনি ক্ষমতায় থাকবেন না। এর আগেই তিনি নির্বাচন শেষ করবেন।
হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব সাজিদুর রহমান বলেন, আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি, আগামী ছয় মাসের মধ্যে যেন আমাদের মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হয়। পাশাপাশি আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি, কুরআন=সুন্নাহর বাইরে কোনো প্রস্তাবনা বাংলাদেশে পাশ হবে না।
জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মনজুরুল ইসলাম আফেন্দী বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে নির্বাচনবিষয়ক খোলামেলা কথা বলেছি। প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি, অনেক আশাভরসা নিয়ে আপনাকে এখানে বসিয়েছি। আপনি সব চক্রান্ত রুখে দিয়ে একটি জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করবেন। আপনি কোনোরকম ধৈর্যহারা হবেন না। আমরা সার্বিক সহযোগিতা করার জন্য আশ্বস্ত করছি।
