Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

৯ মাসেও দৃষ্টিশক্তি না ফেরায় ক্ষোভ-হতাশা

আত্মাহুতি দিতে চেয়েছিলেন ৭ জুলাই যোদ্ধা

Icon

জাহিদ হাসান

প্রকাশ: ২৭ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আত্মাহুতি দিতে চেয়েছিলেন ৭ জুলাই যোদ্ধা

জুলাই আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে চোখে মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে দৃষ্টিশক্তি হারান শত শত আন্দোলনকারী। তাদের অনেককে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন হাসপাতাল চিকিৎসা দেওয়া হয়। কিন্তু একজনেরও পরিপূর্ণ দৃষ্টিশক্তি ফেরেনি।

উলটো অনেকের দৃষ্টিশক্তি আরও কমে গেছে। জুলাই যোদ্ধাদের দাবি পরিবর্তিত পরিস্থিতির ৯ মাস পার হয়ে গেলেও আহতদের উন্নত চিকিৎসায় তেমন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। অনেকেই তাদের দৃষ্টিশক্তি পুরোপুরি হারাতে বসেছেন। ইতোমধ্যে অনেকের চোখ তুলে ফেলা হয়েছে। তাদের স্বজনদের দাবি, উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলে অনেকের চোখ বেঁচে যেত। তারা অভিযোগ করেন, সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতায় আত্মাহুতি ছাড়া তাদের সামনে কোনো পথ খোলা নেই।

এরই অংশ হিসাবে চার জুলাই যোদ্ধা রোববার দুপুরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালকের কক্ষের সামনে বিষপান করেন।

এরা হলেন-আলী হামজা শিমুল (১৯), মো. সাগর (১৮), আখতার হোসেন (আবু তাহের)। (২২) ও মারুফ আহমেদ (২১)। বর্তমানে তারা শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বিষপানে অসুস্থ হয়ে চিকিৎসাধীন সবার শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। জানা গেছে, এই তালিকায় ছিলেন সাতজন। তবে চারজনের বিষয়টি জানাজানি হয়ে পড়ায় বাকিরা আর সে পথে হাঁটতে পারেননি।

সোমবার দুপুরে যুগান্তরকে বলেন, অসুস্থরা হাসপাতালের পাঁচতলার ৫২৬ নম্বর ওয়ার্ডের ৬, ৭, ১০ ও ২৭ নম্বর শয্যায় ভর্তি রয়েছেন। সবাইকে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। সবাই বর্তমানে ঝুঁকিমুক্ত। আমরা সর্বোচ্চটুকু দিয়ে তাদের সেবা ও পরিচর্যা করছি। কারও কোনো শারীরিক জটিলতা না থাকলে কাল (মঙ্গলবার) সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা ছাড়পত্র দিতে পারেন।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ক্ষোভ ও হতাশা থেকেই বিষপান করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন চোখ হারানো চারজন। এজন্য আগের দিন স্থানীয় একটি কাঁচাবাজার থেকে পোকামাকড় মারার নাইট্রো নামের রাসায়নিক কেনেন তারা। আত্মাহুতি দিতে চেয়েছিলেন মোট সাতজন। বিষপানে আত্মহননের চেষ্টা করেন চারজন। পরে বাকি তিনজনের কাছ থেকে রাসায়নিকের বোতল কেড়ে নেওয়া হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রোববার দুপুরে রাজধানীর জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালকের কক্ষে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সিইও (অবসরপ্রাপ্ত) লেফটেন্যান্ট কর্নেল কামাল আকবরের সঙ্গে মতবিনিময় করছিলেন জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালকরা। সভায় জুলাই যোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা, সামাজিক মর্যাদা ও ভবিষ্যৎ জীবনমান নিয়ে আলোচনা হয়।

আহতদের নানাবিধ সমস্যা, উদ্বেগ এবং সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়। আলোচনার লক্ষ্য ছিল, জুলাই যোদ্ধাদের প্রতি কোনো প্রকার অবহেলা বা অবমূল্যায়ন যেন না হয়, তা নিশ্চিত করা। সভায় আহতদের জীবনমান উন্নয়নে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবও গৃহীত হয়। সে সময় ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জুলাই যোদ্ধারা পরিচালকের কক্ষে ঢুকে ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম হতাশা, দুশ্চিন্তা ও নিরাপত্তাহীনতায় ভোগার কথা জানান। তখন চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক তাদের সঙ্গে পরে কথা বলবেন বলে জানান। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বাইরে বের হয়ে পরিচালকের কক্ষের সামনেই বিষপান করে আত্মাহুতির চেষ্টা করেন চারজন।

এ ঘটনার পরপরই তাৎক্ষণিকভাবে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এবং হাসপাতালের ব্যবস্থাপনায় দ্রুত অ্যাম্বুলেন্সে করে আহত যোদ্ধাদের পাশেই সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আইভি ফ্লুইড দিয়ে পেট পরিষ্কার করা হয়। ঝুঁকিমুক্ত হওয়ার পর রাতে তাদের জরুরি বিভাগ থেকে ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়। এদের মধ্যে একজন কিছু দিন আগে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফিরেছেন। তবে তাতে তার চোখের উন্নতি হয়নি।

বিষপান করে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মেডিসিন ইউনিটের ৯নং শয্যায় চিকিৎসাধীন একজন যুগান্তরকে বলেন, তিনি গত ১৯ জুলাই সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আন্দোলনে অংশ নেন। পুলিশের ছোড়া ছররা গুলি তার গলায় ও ডান চোখে লাগে। প্রথমে সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজে চোখের অস্ত্রোপচার হয়। এরপর বেসরকারি একটি হাসপাতালে কয়েক মাস চিকিৎসা নেন। সেখান থেকে জানানো হয় কয়েক দফা অস্ত্রোপচারের পর চোখের আলো ফিরতে পারে।

এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে এলে চিকিৎসকরা জানান, আরেক দফা অস্ত্রোপচার হলে দেখতে পাবে। কিন্তু কোনো উন্নতি হয়নি।

আলী হামজা শিমুল নামে আরেক অসুস্থ ব্যক্তি যুগান্তরকে বলেন, ৫ আগস্ট কুষ্টিয়া মডেল থানার সামনে পুলিশের গুলিতে আহত হন। তার বাঁ চোখে পুলিশের ছররা গুলি এসে লাগে এবং সেটি এখনো মাথায় রয়ে গেছে। এরপর থেকে তিনি সেই চোখে ঝাপসা দেখেন।

আলী হামজা বলেন, আমরা হঠাৎ করে একদিনে এই সিদ্ধান্ত নিইনি। আমরা এটি করতে চাইনি। ১০ মাস ধরে ভোগান্তির শিকার হচ্ছি হাসপাতালে। উন্নত চিকিৎসা তো দিচ্ছেই না, বরং ফলোআপে রেখে চোখের আরও বেশি ক্ষতি করছে। বাংলাদেশে চিকিৎসা শেষ। তখন আমি তাকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য রেফার করতে অনুরোধ জানাই। তিনি কাগজপত্র প্রস্তুত করতে বলেন। এর কদিন পরে তিনি রেফার করতে পারবেন না বলে জানিয়ে বলেন, তোমরা যা খুশি তাই করো। এটা বলার পর আমরা বাইরে এসে বিষপান করি। আলী হামজা বলেন, এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো। তাই আগের দিন বিষ কিনে আনা হয়েছে। তবে কোথা থেকে রাসায়নিকটি কেনা হয়েছে সেটি তিনি বলতে চাননি।

কয়েক দিন আগে সিঙ্গাপুর থেকে চোখের চিকিৎসা করে দেশে ফিরেছেন সিলেটের বিশ্বনাথের বাসিন্দা আখতার হোসেন। তিনিও বিষপান করে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। তিনি বলেন, আমাদের পুনর্বাসন মার্চ মাস থেকে শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু এখন মে মাস চলছে। এখনো কিছু হয়নি। আমার বাম চোখে গুলি লেগেছে। সেই চোখে শুধু আলো দেখি। আর কিছু দেখি না।

আহতদের দেখভালে নিয়োজিত জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবক নাদিয়া বলেন, কারও না কারও আঘাতপ্রাপ্ত চোখের দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার আশা একেবারে ছেড়ে দিয়েছেন চিকিৎসকরা।

এদিকে গুলি লাগা অনেকের চোখের সংক্রমণ ভালো চোখও আক্রান্ত করতে শুরু করছে। উন্নত ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ঘাটতিতেই এমনটা হচ্ছে। আহতদের মধ্যে ভীতি ও শঙ্কা কাজ করছে। চিকিৎসকরাও কোনো আশা দিতে পারছেন না। এসব কারণেই সংক্ষুব্ধ আহতদের চারজন বিষপান করে আত্মাহুতির চেষ্টা করে। সরকারের উচিত এ থেকে ধারণা নিয়ে আহতদের উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিতকরণ, পুনর্বাসন ও দ্রুত জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা।

জুলাই যোদ্ধা দৃষ্টিশক্তি

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম